জুয়ার ক্যাসিনো: ওপেন সিক্রেটের গল্প

গওহার নঈম ওয়ারা:
জুয়ার আখড়ায় মতান্তরে কথিত ক্যাসিনোতে বিশেষ বাহিনীর তল্লাশি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে কেউ কেউ ‘বসে বসে আঙুল চোষার’ কথা বলেছেন। প্রবল আপত্তি তুলেছেন জুয়া নিয়ে নয়, আঙুল চোষা নিয়ে। আঙ্গুলচোষা নিঃসন্দেহে একটি বদভ্যাস। আমরা কতভাবেই না গ্রহণ করি খাদ্য বা পানীয়—চিবিয়ে, চুষে, চেটে বা গিলে। চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয় একই খানার থালায় বা দস্তরখানায় এই চার ধরনের খাবারের সমারোহ না থাকলে আভিজাত্য প্রমাণিত হয় না। তবে মানবশিশুসহ সব স্তন্যপায়ী প্রাণীই জীবনের প্রথম খাবার চুষেই খায়। তাই অনেক শিশু চিবিয়ে খাওয়ার বয়স চলে গেলেও চোষার অভ্যাস ছাড়তে পারে না। হাতের কাছে কিছু না পেলে তারা নিজের আঙুলই চুষতে থাকে। অনেকের এটা নেশায় পরিণত হয়। বড় হয়েও আর চোষার বদভ্যাস যায় না। প্রকাশ্যে যখন আর আঙুল চোষা যায় না, তখন তারা সুযোগের অপেক্ষায় অলস দিন কাটায়। তাই বুঝি চোখকান বুজে আলস অপেক্ষায় দিন কাটানোকে কটাক্ষ করে ‘আঙুল চোষা’ বলা হয়। তৈরি হয় বাগধারা।

এত দিন কোথায় ছিলেন?
‘এত দিন কোথায় ছিলেন’ কথাটার মধ্যে কবি জীবনানন্দীয় রোমান্টিকতা থাকলেও ‘এত দিন কী আঙুল চুষছিলেন?’ কথার মধ্যে রোমাঞ্চ নেই বরং আছে প্রকাশ্য ভর্ৎসনা। ফকিরাপুলসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গজিয়ে ওঠা ‘লাসভেগাস’ নিয়ে এক প্রায় প্রবীণ তাঁর ফেসবুকের দেয়ালে লিখেছেন, ‘ঢাকায় বড় হওয়া যে কোনো ‘পোলাপাইনই’ জানে আরামবাগ আর মতিঝিলের ক্লাবগুলাতে জুয়ার নিয়মিত আসর বসে। এটা বহু বছরের ট্র্যাডিশন।’ গত ২৪ ঘণ্টায় এই বাণীর বিপক্ষে কোনো বাদপ্রতিবাদ হয়নি। তাহলে তো আঙুল চোষার অভিযোগ তোলাই যায়। বাহিনীদের আঙুল চোষার অভিযোগ ব্যক্ত করার সময় এক বিরক্ত মুরব্বি সাংবাদিকদেরও একটু তেরছা বাড়ি দিয়েছেন। তাঁর শিকায়েত ‘জানেন তো, আমাদের বলেননি কেন?’

তবে সংবাদমাধ্যম জুয়ার আখড়ার বাড়বাড়ন্তের খবর অনেক দিন থেকেই তাদের সাধ্যমতো প্রকাশ করে যাচ্ছিল। আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে কথিত ক্লাবগুলোর নাম ও আবস্থান দিয়ে প্রথম আলোয় একটা বড় প্রতিবেদন ছাপা হয় (১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘বছরের পর বছর ধরে ক্লাবগুলোতে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, রেমি, ফ্ল্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের তাস খেলা বা কথিত “ইনডোর গেমস”-এর নামে জুয়া খেলা চলছে।’ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের ক্লাবগুলোর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল সেই প্রতিবেদন। ঢাকার ক্লাবগুলোর মধ্যে যাদের নাম সে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে, ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ক্লাব প্যাভিলিয়ন ফকিরাপুল, আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, ডিটিএস ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, বিজি প্রেস স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি ক্রীড়াচক্র বিমানবন্দর কমান্ড।

রাজধানীর বাইরের ক্লাবগুলোর মধ্যে ছিল বগুড়ার রহমান নগর ক্রিকেট ক্লাব, চাঁদপুরের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাব, ফ্রিডম ফাইটার (৫ নম্বর গুপ্তি ইউনিয়ন পরিষদ), নোয়াখালীর শহীদ শাহ আলম স্মৃতি সংসদ হলরুম, সোনাইমুড়ী, নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় বর্ণালী সংসদ, বরিশালের সেতুবন্ধন ক্লাব ও লাইব্রেরি, চট্টগ্রামের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নাম।

আইন কী বলে?
জুয়া এ দেশে নিষিদ্ধ। ১৮৬৭ সালে প্রণীত বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইন বাংলাদেশে এখনো প্রযোজ্য। সেই আইন অনুযায়ী, যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তাঁর মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে ক্রীড়ারত (জুয়ারত) বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। পুলিশ জুয়ার সামগ্রীর খোঁজে যেকোনো সময় (বলপ্রয়োগ করে হলেও) তল্লাশি চালাতে পারবে বলেও আইনে উল্লেখ রয়েছে। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘোষণা করার সময়েই এ দেশে সব রকমের রেস জুয়া বন্ধের কথা বলেছিলেন।

প্রচলিত এই আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য জুয়াড়িরা আইনজীবীদের কাছে ধরনা দিয়ে একটা জবরদস্ত ফাঁক বের করেছেন। জুয়া টিকিয়ে রাখতে তাঁরা রিট আবেদন করেন আদালতে। রিটে বিবাদী করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের মহাপরিদর্শক, সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ কমিশনার বা পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), সংশ্লিষ্ট এলাকার র‌্যাব ব্যাটালিয়ন ও ডিবির কর্মকর্তাদের। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত কখনো তিন মাস কখনো এক বছরের জন্য বিবাদীদের যথাযথ আইনিপ্রক্রিয়া ছাড়া আবেদনকারীর ব্যবসায় বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করার জন্য আদেশ দেন। ব্যস হয়ে গেল! তারপর আইন তার নিজের প্রক্রিয়ায় চলতে থাকে, জুয়া বন্ধ হয় না। প্রথম আলোর ২০১৩ সালের সেই প্রতিবেদনে এ রকমের মোট ৫৬টি রিটের কথা বলা হয়েছিল। এত দিনে এই সংখ্যার প্রকৃত অবস্থা কী তা অনুসন্ধানের বিষয়।

গণমাধ্যম কিন্তু আগেই জানিয়েছিল
প্রথম আলোর পর ২০১৭ সালের ৭ জুলাই দৈনিক বণিক বার্তা জুয়ার আখড়ার রমরমা ব্যবসা নিয়ে ‘অবৈধ তবু বড় হচ্ছে’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছিল ক্লাবভিত্তিক রেস্টুরেন্টগুলোতে চলছে পশ্চিমা ধাঁচের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত জুয়াড়ি এনে তাঁদের দিয়ে এসব ক্লাবে প্রতি রাতে বসছে জুয়ার আসর। উড়ছে কোটি কোটি টাকা। এ–সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছেও রয়েছে। উল্লেখ্য ২০১৫ সালে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগে গুলশান লিংক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাবে অভিযান চালান র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে অনুমোদনহীন বিদেশি মদ ও বিয়ার বিক্রির অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও ক্যাসিনোর বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বণিক বার্তার সেই প্রতিবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজধানীর যেসব ক্লাব (ফকিরাপুলসহ) ও রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে। অতএব গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মৌনতার অথবা হঠাৎ জেগে ওঠার অভিযোগ প্রমাণের অভাবে খারিজ হয়ে যাবে। খারিজ হয়ে যাবে, ‘আমি এমপি, আমি সভাপতি আমি এসবের বিন্দু–বিসর্গ জানতাম না’ গোছের আলাপ। বরং প্রশ্ন উঠবে, দেশের মানুষদের নাবালক জ্ঞান করে আবার তাদের হাতে যত পারো চোষো বলে কোনো নতুন লজেন্স কেউ ধরিয়ে দিচ্ছে না তো?

যেমন বড়রা শিশুদের ব্যস্ত রাখার জন্য একেকবার একেকটা লজেন্স ধরিয়ে দিয়ে বলেন ‘তুমি চুষতে থাকো, আমি কাম সারি’।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক।

আরও সংবাদ