পুণ্যভূমি সিলেটে বিমানের ‘দুর্নীতিবাজ’ এনায়েত

দুদকের তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজ ও টিকিট কালোবাজারি চক্রের সদস্য বিমানের মতিঝিল বিক্রয় অফিসের সাবেক সহকারী ম্যানেজার মো. এনায়েত হোসেন সরকারকে সিলেটে পদায়ন করা হয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সিলেটের আপত্তির পরও বিমানের সিলেট অফিসের সহকারী জেলা ব্যবস্থাপক হিসেবে তাকে পদায়ন করা হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর এনায়েত সিলেট অফিসে যোগদানের পর সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

একজন দুর্নীতিবাজ অফিসারকে পুণ্যভূমি সিলেটে পদায়ন করায় বিমান অফিসের কর্মকর্তা, আটাব সদস্য, প্রবাসী ও সচেতন নাগরিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আপত্তি সত্ত্বেও দুদকের তালিকাভুক্ত একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে কার ইশারায় পুণ্যভূমি সিলেটে পদায়ন করা হল?

যে বা যারা এর সঙ্গে জড়িত তারা শুধু বিমানের নয়, সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট করছে। অবিলম্বে এ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে সিলেট থেকে সরিয়ে নেয়া হোক।

আটাব সদস্য ও সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীদের অভিযোগ, টিকিট ও কার্গো কেলেঙ্কারির অভিযোগে ওএসডি হওয়া পরিচালক মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস (ডিএমএস) আশরাফুল আলমের ইশারায় এ পদায়ন হয়েছে। তারা জানান, ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর আটাব সিলেটের চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার জলিল ওএসডি হওয়া ডিএমএস আশরাফুল আলমের কাছে একটি ই-মেইল পাঠান।

ই-মেইলে তিনি জানান, সৌদি আরবের জেদ্দা বিমান অফিসের কন্ট্রোলার সাইফ উদ্দিন চলে আসার পর অধিকাংশ সময় সিলেট-জেদ্দার টিকিট তিনটি ট্রাভেল এজেন্সির নামে বুকিং থাকে। সিলেটের প্রবাসী ও আটাব সদস্যরা ওই তিনটি ট্রাভেল এজেন্সিকে অধিক মূল্য দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে বাধ্য হন। ফলে এ অঞ্চলের প্রবাসী ও আটাব সদস্যরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসবে জড়িত রয়েছেন এনায়েত নামের বিমানের এক কর্মকর্তা।

ই-মেইল পাঠানোর পর কোনো কাজ না হওয়ায় এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ফের লিখিত অভিযোগ করেন সিলেট-১ আসনের এমপি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেনের কাছে। আটাব সিলেট অঞ্চলের পক্ষ থেকে করা অভিযোগে বলা হয়- প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলের ৮০ ভাগ এবং ওমরা ও হজের শতভাগ যাত্রী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে আসা-যাওয়া করতে চান।

বিমানের একটি চক্র ডিএমএসের সহযোগিতায় সিট খালি থাকলেও সিলেটের ফ্লাইট সিসি (টিকিট বুকিং বন্ধ) করে রাখেন। ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের জন্য ঢাকার সাদিয়া ট্রাভেলস, তাইরা ট্রাভেলস, আল-গাজী ট্রাভেলস, স্টার হলিডেজ, হাসেম এয়ার ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের টিকিট বলে অধিক মূল্যে বিক্রি করেন।

এছাড়া বিমানের কর্মকর্তা জিয়া উদ্দিন ঠাকুর, এনায়েত, হাবিবসহ কয়েকজন মিলে ডিএমএসের সহযোগিতায় একটি চক্র সিলেট-জেদ্দা, লন্ডনসহ বিভিন্ন গন্তব্যের সিট ব্লক করে রাখেন ও অধিক মূল্যে বিক্রি করেন।

বিমানের কর্মকর্তাদের এমন আচরণে প্রবাসী, ওমরা ও হজ পালনকারী ও আটাব সদস্যরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ ব্যাপারে বিমানের জেলা ব্যবস্থাপকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা পাওয়া যায়নি।

তাই স্থানীয় এমপি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রমাণসহ ৪টি সমস্যা তুলে ধরছে আটাব সিলেট। সমস্যাগুলো হল- ১. ঢাকা-জেদ্দা ‘ইউ’ ক্লাসে সিট পাওয়া গেলেও সিলেট-জেদ্দা ব্লক করে রাখা হয়। বিমানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে বলা হয় বেশি দামে ‘এ’ ক্লাসে যাওয়ার জন্য।

২. জেদ্দা-সিলেট ফ্লাইটে সিলেটের সিট পাওয়া যায় না অথচ ওই ফ্লাইট সিলেট হয়ে ঢাকা যায় এবং ঢাকার সিট খালি থাকে। ৩. লন্ডন ফ্লাইটে দেড় মাস কোনো সিট নেই কিন্তু বেশি টাকার বিনিময়ে সিট মেলে। ৪. সিলেটের যাত্রীরা দুবাই, ওমান ও কাতারসহ বিভিন্ন ফ্লাইটে এ ধরনের সমস্যা ও অবিচারের শিকার হন। তবুও কোনো কাজ হয়নি।

সর্বশেষ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর বরাবরে লিখিত অভিযোগ করে আটাব সিলেট অঞ্চল। অভিযোগে বলা হয়- ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুর্নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে প্রমাণসহ তথ্য দিয়েছি।

আমাদের অভিযোগে তৎকালীন মতিঝিল বিক্রয় অফিসের সাবেক সহকারী ম্যানেজার মো. এনায়েত হোসেন সরকারের নাম ছিল। দুদকের তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়াতে উনি প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত হন। বিমানের সিলেট অফিসে এনায়েত সাহেবকে পাঠানো হলে বিমানের ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে।

প্রবাসী ও আটাব সিলেটের সদস্যরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেটে দূষণীয় কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে পাঠানো ঠিক হবে না।’ এরপরও এনায়েত হোসেনকে সিলেটে পদায়ন করা হয়।

আটাব সিলেটের চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার জলিল বলেন, যেহেতু দুদকের তদন্তে এনায়েত হোসেন সরকার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। যার বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ করছি তার সঙ্গে কাজ করাও কঠিন হবে। তার মনে আমাদের প্রতি ক্ষোভ থাকবে, আমাদের মনেও তার প্রতি ক্ষোভ রয়েছে।

সিলেট অফিসের সহকারী জেলা ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেয়া মো. এনায়েত হোসেন সরকার যুগান্তরকে বলেন, আটাবের অভিযোগের ব্যাপারে আমি জানি না। পদায়নের বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই।

অভিযোগ অস্বীকার করে বিমানের ওএসডি হওয়া সাবেক ডিএমএস আশরাফুল আলম বলেন, আমি তো অনেক দিন ধরে দায়িত্বে নেই। এসব বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।

বিমানের বর্তমান ডিএমএস সালাহ উদ্দিন বলেন, এনায়েত হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তাকে শাস্তিমূলক দিল্লির পরিবর্তে বরিশাল, সেখান থেকে সিলেটে বদলি করা হয়েছে। অন্য কারও সহকারী জেলা ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি হলে আমরা সিলেট থেকে এনায়েতকে সরিয়ে নেব।

যুগান্তর

আরও সংবাদ