একজন আলোর ফেরিওয়ালা : পলান সরকার
সুরমা নিউজ:
প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাঁধে ঝোলাভর্তি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন একজন মানুষ। মাইলের পর মাইল হেঁটে একেকদিন একেক গ্রামে যেতেন। বাড়ি বাড়ি কড়া নেড়ে আগের সপ্তাহের বই ফেরত নিয়ে নতুন বই পড়তে দিতেন। রাজশাহীর প্রায় ২০টি গ্রামজুড়ে যিনি ছড়িয়েছিল বইয়ের আলো। ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, “আমার মধ্যে যদি উত্তম বলে কিছু থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছে ঋণী।” এই উত্তম মানুষ গড়ার একজন কারিগর ছিলেন পলান সরকার। সাদা মনের এই মানুষটি নিজের টাকায় বই কিনে পড়তে দিতেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। শিক্ষার এক অভিনব আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন পলান সরকার নামের এই আলোর দিশারি। তাঁকে নিয়েই জানবো আমরা।
আলোর দিশারি:
সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁধে ঝোলা নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া৷ উদ্দেশ্য? আলো ফেরি করা। আলো আবার ফেরি করা যায় নাকি? যায়, জ্ঞানের আলো। প্রায় শতবর্ষী এক মানুষ। তাঁর ঝোলাভর্তি বই৷ সকালে ঘুম ভেঙেই গ্রামের মানুষ তাদের আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতো এই সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটাকে৷ সবাই আপন করে নিয়েছিল এই মানুষটাকে। ঝোলাভর্তি আর দুই হাত ভর্তি বই। এ বই নিয়ে পলান সরকার যেতেন গ্রামের ঘরে ঘরে। কারও পছন্দ রবীন্দ্রনাথ, আবার কারো নজরুল কিংবা শরৎচন্দ্র। সব বয়সের সব পাঠকের হাতেই তিনি তুলে দিতেন প্রিয় বইটি। নিজের গ্রাম থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে আশেপাশের ১০-১২ টি গ্রামে শুরু করেছিলেন তাঁর জ্ঞানের আলো ফেরির কাজ। পাঠক ছিলেন গ্রামের যুবক-যুবতী, কিশোর, বৃদ্ধ এমনকি গৃহবধূরা। “বইওয়ালা দুলাভাই” নামে যাকে গ্রামের মানুষরা চিনতেন। যেখানে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে আগে ঠিকমতো শিক্ষার আলোই পৌঁছাতো না৷ পলান সরকার রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় ২০টি গ্রামজুড়ে গড়ে তুলেছিলেন বই পড়ার এক অভিনব আন্দোলন। রাজশাহীর বাউসা ইউনিয়নের বেণুপুর, হরিপুর, দীঘা, হাটপাড়া, পূর্বপাড়া, সরকারপাড়া, মাঠপাড়া, ঠাকুরপাড়াসহ ১২টি গ্রামে তিনি পরিচিত এবং সবার প্রিয় মানুষ ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন:
পলান সরকার ১৯২১ সালে নাটোরের বাগাতিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম হারেজউদ্দিন সরকার । মা ডাকতেন পলান। সেই থেকে পরিচিত হন পলান সরকার নামে। জন্মের মাত্র ৫ মাস পর পিতা মারা যান। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর অর্থনৈতিক সংকটে লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। এরপর নানা পলান সরকারকে রাজশাহীর বাঘার থানার বাউসা গ্রামে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হন। যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণীর পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই যাকে লেখাপড়ার ইতি টানতে হয় তিনিই সারাজীবন ছড়িয়েছেন জ্ঞানের আলো। ওইটুকু বয়সেই তার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। সেই অভ্যাসের বশেই তিনি যেখানে যে বই পেতেন, সংগ্রহ করতেন, নিজে পড়তেন এবং অন্যকেও বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। নিজে পড়ালেখা না চালাতে পারলেও নিজের ছেলেমেয়ে এবং গ্রামের অন্য মানুষদের মাঝে ছড়িয়েছেন শিক্ষার আলো। পরিবারের সবাইকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন, কারণ জ্ঞানকে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন।
নানা ময়েন উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় ছোট জমিদার। যৌবনে পলান সরকার নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন এবং দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে কর আদায়কারীর চাকরি পান। বেতনের টাকা দিয়ে নিজে বই কিনতেন এবং মানুষকেও ধার দিতেন। নানার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন। সে সম্পত্তিও তিনি মানবকল্যাণে উৎসর্গ করেন। ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন। তিনিই আবার যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। সে সময় গ্রামাঞ্চলে যাঁরা যাত্রা-নাটকে অভিনয় করতেন তাঁদের অনেকেই পড়ালেখা জানতেন না। পলান সরকার লেখাপড়া জানতেন। তখন না ছিল ফটোকপিয়ার, না সাইক্লোস্টাইল মেশিন। তাই যাত্রার পাণ্ডুলিপি কপি করতে হতো হাতে লিখে। যাত্রার পাণ্ডুলিপি লেখার কাজটা অনেক সময় করতে হতো তাঁকেই। অন্যদিকে মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা- অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশাটা আরো জাগ্রত হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।