সুন্দরবন একা একা থাকে
আনোয়ারা আল্পনা:
বেশিদিন আগের নয়, মাত্র বছর সাতেক আগের কথা। সুন্দরবন এলাকায় তখন মোবাইল ফোনের টাওয়ার ছিল না। কয়লা বিদ্যুতের কথাও তেমন শোনা যায় নাই। দেশে তখন কী জানি একটা পলিটিক্যাল ম্যাসাকার চলছিল।
চার নম্বর চাকরিটা ছেড়েছি কয়েক দিন আগে, হালকা একটা ব্রেকআপও হয়ে গেছে। ভাবলাম কিছুদিন ঘুরিফিরি, তারপর আবার চাকরি খুঁজব। কিন্তু হৃদয় যতই ভেঙে যাক, একা একা ঘুরতে ভালো লাগে না। সে সময় বন্ধু-দম্পতি কণা-লেনিন ফোন করল, কোরবানির ঈদের তিন দিন আগে। লেনিন বলল, ‘দোস্ত, ল সুন্দরবন যাই!’ আমি গাইগুই করছি, তখন কণা ফোন নিয়ে বলল, ‘তুই তো জানিস গান হওয়ার পর থেকে কোথাও যাই নাই আমরা। তুই গেলে যাওয়া হবে, না করিস না দোস্ত!’
তাদের সাড়ে তিন বছরের কন্যা গান, অচেনা কাউকে দেখলেই চিল চিৎকার শুরু করে, কিন্তু আমাকে খুব পছন্দ করে। আহ্লাদ করে আন্টি না ডেকে আন্নি ডাকে। তাহলে গানের মুখের হাসির জন্যই রাজি হয়ে গেলাম। কণা বলল, ‘দোস্ত আরেকটা সমস্যা আছে, ঈদে যাব শ্বশুরবাড়ি, ঈদের পরদিন ভোরে সুলতানা কামাল ব্রিজের নিচ থেকে জাহাজ ছাড়বে!’ বোঝেন অবস্থা, আমার তাহলে এখন বলাই লাগে, ক্যামনে কী? কণার শ্বশুরবাড়ি ঢাকার কাছেই, ভৈরব। ওদের পলিটিকস বুঝতে আমার আরও সময় লাগল। মানে ঈদের দিন রাতে ঢাকা থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে আমাকে যেতে হবে ভৈরব, ওদের নিয়ে ঢাকায় ফিরে ভোরবেলা জাহাজ ধরতে হবে! ঈদের দিন রাতে কোন রেন্ট-এ-কারের ড্রাইভার ডিউটি করবে? তবুও পাঁচ দিন পানিতে ভেসে থাকা আর গানের সান্নিধ্য খুব টানল। না হলে বন-জঙ্গল আমাকে তেমন টানে না।
নানা জায়গায় ফোন করে-টরে একটা গাড়ি ম্যানেজ করলাম। ঈদের রাত ১২টায় ভৈরবের উদ্দেশে রওনা, ৩টা নাগাদ পৌঁছে আবার ঢাকার দিকে ফিরে ৭টায় জাহাজ ধরতে পারলাম!
সাদা রঙের জাহাজটা ব্রিজের তলা থেকে একটু সামনে দাঁড়ানো। ছোট একটা ডিঙি নৌকা দিয়ে জাহাজের সিঁড়িতে নামিয়ে দিল। উঠতে উঠতেই বাচ্চাকাচ্চার কিচিরমিচির শুনলাম। ষোলোটা ক্যাবিনের ছোট্ট একটা জাহাজ, প্রায় সবাই ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি দুটি কেবিন নিয়েছে লেনিন, একটায় ওরা অন্যটায় আমি। পরে অবশ্য বুঝেছি গানকে আমার কাছে দিয়ে শয়তান দুইটা রোমান্টিক মুডে চলে যাবে। সেটা একদিক দিয়ে ভালোই, গানের সঙ্গ পছন্দ করি আমি। জাহাজ ছেড়ে দিলে আমরা কেবিনে গিয়ে জামাকাপড় বদলে রিল্যাক্স হয়ে গেলাম। ডেকে বেরিয়ে দেখলাম কেউ কেউ লুঙ্গি পর্যন্ত পরে ফেলেছে। এক ছেলে পিচ্চি দৌড়ে এসে গানের হাত ধরে বলল, ‘হোয়াটস ইউর নেম?’ গান হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘গান!’ পোলা দুই পা পিছে হটে বলল, ‘ও মাই গড! আমি হ্যাভ নেভার সিন আ গান লাইক ইউ!’ তারপর নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে হলুদ রঙের খেলনা পিস্তল বের করে বলল, ‘নট লাইক ইউ!’ এবার আমাদের গম্ভীরা গান পর্যন্ত হেসে ফেলল, ‘হেই আমি অ্যাম সঙ, নট মেশিনগান!’ পোলাটাকে একই সঙ্গে আশ্বস্ত ও হতাশ দেখাইল। বলল, ‘আই অ্যাম নীল, হোয়াট ডুউ থিঙ্ক অ্যাবাউট টাইগার?’ এতক্ষণে তার হতাশ হওয়ার কারণ বোঝা গেল, সে আমাদের গানকে দিয়ে বাঘ মারতে চেয়েছিল! গান বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বাঘ মারা যাবে না, কমে গেছে!’ নীলের ব্লু আর শূন্য নিয়ে প্যাঁচ লাগাল না গান। নীল এসেছে মা আর মামার সঙ্গে।
দুপুরে খেয়েদেয়ে টিনদের গ্রুপটা গিটার নিয়ে ডেকে বসল। কণা আর লেনিন শর্টস আর লাল টি-শার্ট পরে ওদের সঙ্গে ভিড়ে গেল। এ দুইটা ইউনিভার্সিটিতে এইগুলা করে বেড়াত। মেয়ের বাপ-মা হয়ে সেসব ভুলতে বসেছিল। গান আমার হাত ধরে বলল, ‘আন্নি, চল আমরা উইদিকে যাই, ওরা ইত্তু মজা করুক।’ এমনিতে গানের কথা খুব পরিস্কার, কিন্তু আমার সঙ্গে আহ্লাদে একটু বেঁকে বেঁকে যায়। আমার আঙুল ধরে ডেকের অন্যদিকে যেতে যেতে বলল, আন্নি আমার খুব লক্কি বাচ্চা হতে ইচ্ছা করে!’ আমি হো হো করে হেসে বললাম, ‘থাক আর কাজ নাই!’ ডেকের অন্যদিকে ঘুরে দেখি এক কাপল হাপুস হুপুস চুমু খাচ্ছে! আমি চোখের কোনা দিয়ে গানের দিকে তাকালাম, গানও আমার দিকে। দু’জনই নীরবে প্রশ্ন করলাম, এখন? উত্তর গানই দিল, ‘ইগ্নোর দেম!’ আমরা ওদের চুমু খেতে দিয়ে ওদের দিকে পেছন ফিরে নদী দেখতে লাগলাম। বললাম, ‘জানিস, ঢাকা থেকে সুন্দরবন যেতে সতেরোটা নদী?’ গান বলল, ‘আমি গুনব!’ ‘কীভাবে গুনবি? ওরা কি ওদের নাম বলবে? তবে একটা নদীর নাম জানি আমি, আন্ধারমানিক। কী সুন্দর নাম না?’ গান উদাস হয়ে গেল! নদীর দু’পাশে এখনও ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে, আজানের সময় আজান শোনা যাচ্ছে।
রাতে এগারো দিনের চাঁদ উঠল। খেয়েদেয়ে সবাই ডেকে বসল, চুমু কাপলকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না, তারা কি এই চাঁদ ফেলে কেবিনে মেতেছে? আমি মনে মনে ওদের কথা ভাবছি জানলে গান আমাকে ধমক দিয়ে বলবে, ইগ্নোর দেম!
দ্বিতীয় দিন সকালে ঘুম ভাঙল গানের ধাক্কায়, ‘আন্নি ওঠো, আর কত ঘুমু করবা?’ রাতে সে আমার কাছেই শুয়েছিল, শেষরাতে উঠে বাবা-মায়ের কাছে গেছে। ও গেলে আমি আর দরজা লাগাই নাই, গরম লাগছিল বলে। কেবিনের বাইরে গেলেই সুন্দর বাতাস, কিন্তু কেবিনের ভেতরে গরম। লাইন ধরে ফ্রেশ হয়ে এসে, নাশতা খেতে গেলাম। একটু পরে দেখলাম চুমু কাপলও এলো। এবার গানও ফিচেল হাসল, আমি চোখ পাকালাম! কিন্তু এদের সঙ্গে তো পরিচিত হতে হবে, কতবার আর চুমু কাপল চুমু কাপল বলা যায়! ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, ওরা হেসে এগিয়ে এলো। আমাদের টেবিলেই বসল। গল্পে গল্পে জানা গেল, ছেলেটা বিদেশে থাকে, পনেরো দিন আগে দেশে এসেছে। ঈদের দু’দিন আগে ধুম করে বিয়ে হয়েছে তাদের, ছেলেটা সামনের সপ্তাহে চলে যাবে। মেয়েটার হাতে মেহেদির রঙ একেবারে নতুন। মানে এটা ওদের হানিমুন। আমি মনে মনে তাদের যেখানে সেখানে চুমু খাওয়া মাফ করে দিলাম। মনে হয় গানও দিল। ওদের নাম ঝুমুর আর অভি।
দুপুরের দিকে ফোনের নেটওয়ার্ক চলে গেল, নদীর দু’পাশে ঘরবাড়িও দেখা যায় না আর। বিকেলের দিকে সুন্দরবন দেখা গেল দূর থেকে! সবাই বলে উঠল, ওই দেখা যায় সুন্দরবন! গানকে বাবা-মায়ের কাছে দিয়ে আমার কবিটার খাতাটা নিয়ে চুপি চুপি ছাদে চলে এলাম! আমি খুব কবিতা লিখি এমন না, তবে একটা খাতা আছে, সেখানে আবোলতাবোল লিখে রাখি। সুন্দরবনের দেখা পেয়ে আমার খুব ভাব এসেছে, এমন নয়। কিন্তু কেমন একটা দমবন্ধ লাগছে! দালানকোঠা আর মানুষজন ছাড়া আর কিছু আমাকে কেমন জানি বোকা বানিয়ে দেয়। পাহাড়-সমুদ্রও। কেবল নদী আপন লাগে। এই যে এতদূরে সুন্দরবন একা একা থাকে, এটা ভেবেই কেমন অস্থির লাগে আমার। খাতায় লিখি- সুন্দরবন একা একা থাকে!
সন্ধ্যা হয়ে এলে নেমে এলাম, আজ বারো দিনের চাঁদ। ফটোগ্রাফারদের চারজনের একটা দল এসেছে। ক্যামেরার সঙ্গে আরও কী কী যন্ত্রপাতি লাগিয়ে ছবি তোলে, যেন যুদ্ধ করে। ওদের সঙ্গে আড্ডা দিলাম কিছুক্ষণ। একজন বলল, ‘দেখেন তো এমন বেড়ানো কখনও বেড়াইছেন, যেখানে শপিং নাই!’ আরেকজন বলল, ‘দেখেন তো সিগারেট শেষ হয়া গেছে, কোথায় পাই!’ আমি খুব দুঃখী মুখ করে বললাম, ‘আমার বন্ধু লেনিন এক কার্টন এনেছে, দেখেন গিয়া ব্র্যান্ড মেলে কি-না!’ ওরা হইহই করে বলল, ‘আর ব্র্যান্ড! এখন কাগজ গোল কইরা আগুন ধরানোর বাকি! ওনার কেবিন নম্বর কত? যাই হাতে-পায়ে ধইরা দুটা চাইয়া আনি!’ আমি এদের নিকোটিনপ্রীতি দেখে খুব হাসলাম।
রাতে গান আমার সঙ্গে ঘুমাতে এসে বলল, ‘আন্নি, কী কবিতা লিখলা?’ বললাম, ‘সুন্দরবন একা একা থাকে!’ গান বলল, ‘তোমার মতো!’ বললাম, ‘তুই বেশি জানিস, আমি মোটেই একা একা থাকি না, আমার কত বন্ধু-বান্ধব জানিস?’ সে বুড়িদের মতো বলল, ‘আমি সব জানি!’
সকালে ঘুম থেকে উঠে কেবিনের বাইরে এসে দেখি, দু’দিকে বিশাল বন, মাঝ নদীতে থেমে আছে জাহাজ। গান চোখ ডলে বলল, ‘আরিব্বাশ! সুন্দরবন তো বিরাট!’ শুনলাম, এ জায়গাটার নাম কটকা। ভালো করে তাকিয়ে দেখি নদীর তীরে অনেক হরিণ এসে অবাক হয়ে আমাদের দেখছে। ফটোগ্রাফারের দল বলল, এখানেই থাকবে জাহাজ, আমরা নৌকা করে সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকব। তাড়াতাড়ি নাশতা খেয়ে রেডি হয়ে গেলাম। ট্যুরওয়ালারা আগেই জানিয়েছিল, সবুজ ধরনের রঙের কাপড় পরে বনে ঢুুকতে হবে। আর পারফিউম মাখা যাবে না। তিনটা নৌকায় করে আমরা যাব বনে। বন কর্তৃপক্ষ আমাদের একজন গাইড কাম সিকিউরিটি গার্ড দিয়েছেন। খাকি ইউনিফর্মের সঙ্গে লুঙ্গি পরে হাতে একটা দশাসই রাইফেল নিয়ে এসেছেন তিনি! আমি তার সঙ্গে গল্প জুড়লাম। এই বিজন বনে থাকেন তিনি যুগ যুগ! কথা শুনলেই মনে হয়, যেন ভুলে যাওয়া কথা উদ্ধার করে করে বলছেন! মুখটা দেখে মনে হয়, সেটা বেঁচেই থাকে কেবল, আর কিছু করে না।
নৌকা নিয়ে বড় নদী থেকে খালে ঢুকে গেলাম। দু’পাশে বন প্রায় হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। অচেনা গাছের অচেনা পাতা, আর পাখি আর সাপ, আমরা একটুও শব্দ করে ওদের বিরক্ত করলাম না। লাইফ জ্যাকেট পরা গান একবার শুধু আমার কানে কানে বলল, ‘বনের গন্ধ কি সুন্দর!’
কত কত হরিণ যে দেখলাম! চিড়িয়াখানার হরিণের মতো হরিণ নয়, বড় বড় আর নিজের দেশে থাকার শান্তি ওদের চেহারায়। কিন্তু আমাদের মাথাজুড়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার! কিন্তু বাঘেরা কি অত বোকা? আমাদের উঠতে হলো ওয়াচ টাওয়ারে। আর তাদের গায়ের রঙের কেমফ্লেজের ঝোপ দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। অবশ্য ফেরার পথে তাদের পায়ের ছাপ দেখে বুঝে গেলাম, তিনি ছিলেন এদিকেই। একা নাকি দোকা কীভাবে বোঝা যাবে? গাইড আশানুল্লা গন্ধ শুঁকে শুধু বললেন, আদগোন্টা! ভাবলাম, আধাঘণ্টা আগে তিনি বা তারা যদি আমাদের সামনে পড়ে যেতেন তাহলে কী হতো! লেনিনের কাঁধে গান, বলল, ‘আন্নি, দূরবীন না আনছিলা?’ এতক্ষণে আমার মনে পড়ল, আরে তাই তো দূরবীনের কথা একেবারে মনে নাই! কিন্তু জাহাজে গিটার বাজিয়ে কী জানি একটা চাঁদমামার গান করছিল যে ছেলেটা, বিদ্যুৎ নাম ওর, ও বলল আমার দিকে তাকিয়ে, ‘তোমার বাসায় তুমি জামাকাপড় ছাড়া হাঁটতেছ মনে করো, হঠাৎ খেয়াল করলা তোমার বাসা বরাবর, পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে কেউ দূরবীনে চোখ লাগিয়ে তোমাকে দেখতেছে, কেমন লাগবে?!’ উফ আজকালকার পোলাপান নিয়ে আর পারা যায় না! আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, ‘তা তুমি কখন থেকে আমাকে জামা-কাপড় ছাড়া কল্পনা করতেছ?’ সে হো হো করে হেসে বলল, ‘যাহ্? আমার গার্লফ্রেন্ড আছে তো!’ আমি বললাম, ‘যাক বাবা, এ যাত্রা বেঁচে গেছি!’
কুমিররা যেদিকে থাকে, ওদিকে গিয়ে তাদের টিকিটিও না দেখে দুপুরে জাহাজে ফিরে এলাম আমরা। গান ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলে কবিতার খাতা হাতে ডেকে চলে গেলাম। একমনে আবোলতাবোল লিখছিলাম, বিদ্যুৎ এসে বলল, ‘বসব তোমার পাশে?’ আমি চমকে তাকিয়ে বললাম, ‘আরে শিওর!’ আমার পাশে বসে সে একটু লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, ‘তোমার বয়স জানতে চাইলে বেয়াদবি হবে?’ আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘তোমার মতলবটা কী?’ সে বলল, ‘তোমার বয়সী কেউ এতটা রসিক হতে পারে, ভাবিনি আমি!’ আমি বললাম, ‘আমার প্রেমে পড়েছ?’ সে বলল, ‘বুঝতেছি না, চুমু খেলে বুঝতে পারব!’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, রাতে এগারোটার পরে এখানে এসো, চুমু খেয়ে পরীক্ষা হয়ে যাবে!’
রাতে খাওয়ার সময় ট্যুরওয়ালারা বলল, ‘কাল আমরা ভোর ৫টায় বনে যাব।’ কণা আমাকে বলল, ‘অত ভোরে গান কীভাবে যাবে, তুই আর গান জাহাজেই থাক।’ বিদ্যুৎ আমাদের টেবিলেই খেতে বসেছিল, সে আমার দিকে তীব্রভাবে তাকিয়ে বলল, ‘একদম না, যাবে তুমি!’ কণা অবাক হয়ে আমাকে বলল, ‘এ ছেলেকে আগে থেকে চিনতি তুই?’ এ ক্লাইমেক্সের সমাধান করল স্বয়ং গান। সে বলল, ‘আমি সকালে উঠতে পারব, আন্নি! তুমি আমার পায়ের তলায় সুরসুরি দিও, উঠে যাব!’
পরের দিন ভোরে নৌকায় বনে নেমে অনেক দূরে হেঁটে হেঁটে গেলাম আমরা। প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটার পর- বিস্ময়! সমুদ্র! পুরা হতবাক হয়ে গেলাম আমি। অন্যদের মনে হয় ধারণা ছিল, এখানে একটা ছোট বিচ আছে। ফটোগ্রাফারদের দলের একজন বলল, ‘ব্রিটিশ আমলে এখানে গোপনে লবণের চাষ হতো! স্বদেশি বিপ্লবীদের হাইড আউট ছিল এখানে!’ বিদ্যুৎ প্রায় আমার কানে কানে বলল, ‘ভাবা যায়, এতটা দুর্গম এলাকা বেছেছিলেন তারা!’ আমি হালকা করে ওর হাত ধরতেই খুব চেপে আমার হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। দেখলাম কেউ একজন বিচে নামতে গিয়ে ধাম করে আছাড় খেয়ে পড়ল। বালুর বিচ নয় একটা, ভীষণ পিছলা। বিদ্যুৎ বলল, ‘নামবে?’ লেনিনের কাঁধ থেকে গান বলল, ‘আন্নি, যেও না, আছাড় পড়বে!’ দুপুরের পর ফিরে এলাম জাহাজে। বিকেলের দিকে জাহাজ ছেড়ে দিল খুলনার দিকে।
সকালে উঠে দেখলাম দূরে খুলনা দেখা যায়। মোবাইলের নেটওয়ার্ক ফিরে এলো। খুলনা থেকে বাসে নাইট জার্নি করে সকালে ঢাকা পৌঁছাব আমরা।
দুপুরে খবর এলো, খুলনায় ভয়াবহ কা ঘটে গেছে, ট্যুর কোম্পানির যে বাসে আমাদের ফেরার কথা, সেটা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে কারা। তার পরের খবর আরও ভয়াবহ, আমাদের জাহাজ কোম্পানির মালিকের সঙ্গে খুলনার পরিবহন সমিতির কী যেন গ গোল, তারা এই জাহাজ খুলনায় ভিড়তে দেবে না! জাহাজের জ্বালানি আর খাবারের মজুদ ফুরিয়ে গেছে, এটা ঘুরিয়ে আর ঢাকা ফেরার উপায় নাই! জাহাজ তীর থেকে দূরে নোঙর ফেলল।
বিদ্যুতের বাবার পরিচিত খুলনার এক ব্যবসায়ীকে ফোন করে তিনি একটা নৌকা ম্যানেজ করলেন। ঠিক হলো শুধু শিশুদের নিয়ে বিদ্যুতের পরিবার যাবে খুলনা, সেখান থেকে কোনো একটা গাড়ি ভাড়া করে ঢাকায়। কণা কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমি বিদ্যুৎকে বললাম, ‘গানকে তোমার দায়িত্বে নিয়ে যেতে হবে, ঢাকায় নেমে ওকে মামার বাসা আজিমপুরে দিয়ে আসতে হবে, পারবে?’ বিদ্যুৎ আমার হাত ধরে বলল, ‘পারব। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না!’ কণা গানের ব্যাগ গুছিয়ে দিল। আমি বললাম, ‘গান ব্যাটা তুই আমাদের সাহসী বাচ্চা না? একটুও ভয় পাবি না, ওকে?’ সে হেসে বলল, ‘তোমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে মামার বাসায় পৌঁছে দেবে!’ নৌকায় নামার আগে বিদ্যুৎ ওর বাবা-মায়ের সামনেই আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল, কানে কানে বলল, ‘তোমার কবিতার খাতাটা আমাকে দিয়ে দাও, যদি বেঁচে ফিরে আস, নিও!’
রাতে খবর পেলাম ওরা ঢাকা রওনা হয়ে গেছে। আমরা বাকিরা এখানে-ওখানে বসে আছি, হঠাৎ শুনলাম ইঞ্জিনের নৌকার আওয়াজ। টর্চের আলো ফেলে দেখলাম ওটা আমাদের জাহাজের কাছাকাছি, ভাবলাম কোনোভাবে আরেকটা নৌকা জোগাড় হয়েছে। কিন্তু একটু পরে দেখলাম ওটা ফিরে যাচ্ছে, আর যাওয়ার আগে আগুন লাগিয়ে গেছে জাহাজের পেছনের অংশে! পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা।
কতক্ষণ সাঁতার কেটেছি, মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম বরিশালের একটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি! পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর সাত দিন কেটে গেছে! পাশের বেডে মেহেদি রাঙা একটা হাত দেখে বুঝলাম, হানিমুন কাপলের ঝুমুর বেঁচে আছে। অন্যরা কোথায়, কণা-লেনিন? আবার ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে ভাবলাম, গান কেমন আছে? ঢাকায় ফিরলাম আরও সাত দিন পরে। কণা-লেনিন ফিরেছে আরও আগেই। গান বাবা-মায়ের সঙ্গেই আছে। বিদ্যুতের সঙ্গে দেখা করে কবিতার খাতাও নিয়ে নিয়েছি।
এই সাত বছর পরে, আপনারা বিদ্যুতের সঙ্গে আমার প্রেমের খবর জানতে চাইয়েন না কিন্তু!