ব্রিটেনে ‘গ্রেট ব্রিটিশ বেক অফ’ খেতাব জেতা সিলেটের নাদিয়ার কষ্ট
হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব দিয়ে হাজারো ভক্তের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন নাদিয়া হোসেইন। বিলেতি রীতির কেক বানিয়ে ‘গ্রেট ব্রিটিশ বেক অফ’ খেতাব জিতে ব্রিটেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় শেফ হিসেবে পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ এই নারী।
কিন্তু চার বছর পর নিজের জীবনের একটি কালো অধ্যায়কে সামনে নিয়ে এসে জানালেন, তার এই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে শৈশবের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি, যা তার মনোজগতে রেখে গেছে স্থায়ী দাগ।
ব্রিটেনের দ্য মেইলের রবিবাসরীয় ‘ইউ ম্যাগাজিন’ এ এক আবেগপূর্ণ সাক্ষাৎকারে নাদিয়া জানিয়েছেন, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাংলাদেশে এক নিকটাত্মীয়র দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
প্রথমে বুঝতে না পারলেও স্কুলে যখন জীববিজ্ঞানে ক্লাসে যৌনতা সম্পর্কে জানার সুযোগ পেলেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলেন কি ঘটে গেছে তার সঙ্গে। আর বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ল্যাবরেটরির বেঞ্চে লুটিয়ে পড়েছিলেন নাদিয়া।
বর্তমানে ৩৪ বছর বয়সী নাদিয়া জানান, বিষয়টি তাকে মানসিকভাবে এতটাই আঘাত দিয়েছিল যে, দশ বছর বয়সে একবার আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলেন। কয়েক দশক ধরে সেই আতঙ্ক এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের (পিটিএসডি) মধ্যে কাটাচ্ছেন তিনি।
তিন সন্তানের জননী নাদিয়া নিজের অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “কোনো সন্দেহ নেই, এটা (যৌন নিপীড়ণ) আমার প্যানিক ডিজঅর্ডারের একটি কারণ। সেটাই (আত্মহত্যা) করা উচিত ছিল, কারণ সেই স্মৃতি আমি সারাজীবন বয়ে বেড়াচ্ছি।
“কিছুদিন আগে আমি ঘটনাটি আমার বোনদেরকে জানিয়েছি। আমার স্কুলের এক ঘনিষ্ট বন্ধু আছে, তাকেও বলেছি, যার সঙ্গেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। এ ধরনের ঘটনা নিয়ে কথা বলাটা খুবই জরুরি, কারণ আমরা যতটুকু বলি, সম্ভবত তারচেয়েও বেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটে।”
শুধু শৈশবের সেই যৌন নিপীড়ণের ঘটনাই নয়, নাদিয়া জানিয়েছেন, শুধু গায়ের রং কালো বলে তাকে স্কুলে ছেলেদের তির্যক মন্তব্য শোনার আতঙ্কেও থাকতে হত। স্কুলের ছেলেরা একবার টয়লেটে তার মাথায় পানিও ঢেলে দিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এখনও সবসময় টয়লেটে যাওয়ার সময় তার সেই স্মৃতি মনে পড়ে।
“বিভৎস সেই ঘটনা। আপনার মনে হবে আপনি ডুবে যাচ্ছেন।”
নাদিয়া বলেন, দশ বছর বয়সে তিনি প্রথম আত্মহত্যা শব্দটি প্রথম শোনেন আর তখন তার মনে হয়েছিল, এটিই বুঝি তার মুক্তির একমাত্র পথ হতে পারে। এরপর কোনো এক রাতে একগাদা ঘুমের ওষুধ খাওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু যখন জানতে পারেন তার একটি ভাই (শাক) আসছে পৃথিবীতে তখনই আর কাজটি করতে পারেননি। অনাগত সেই ছোট ভাইয়ের খবরই তাকে বাঁচিয়ে দেয়।
২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যে রান্না বিষয়ক টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘গ্রেট ব্রিটিশ বেক অফ’ এ বিলেতি রীতির কেক বানিয়ে বিজয়ীর মুকুট ছিনিয়ে নেন নাদিয়া।
পরের বছর প্রভাবশঅলী ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের তালিকার শীষে চলে আসেন তিনি। একই বছর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৯০তম জন্মদিনের কেক তৈরির ভার পড়ে নাদিয়ার হাতে।
নাদিয়া সব সময় মাথায় স্কার্ফ পরেন। মজার বিষয় হল, নাদিয়া কখন কোন রঙের স্কার্ফ পরেন, তা দেখেই তার মনের অবস্থা বলে দিতে পারেন স্বামী আবদাল।
সাক্ষাৎকারে স্কার্ফ নিয়ে হাসিমুখে নাদিয়া বলেন, “আবদাল এগুলোকে বলে মনের স্কার্ফ। মানে, আমি যদি কালো স্কার্ফ পরি, তাহলে সে ধরে নেবে আমার দিনটি খারাপ যাচ্ছে, কিন্তু একটু রঙচঙে স্কার্ফ পরলে সে পছন্দ করে, তখন সে বলবে, ‘ও তুমি তাহলে আজকে ঠিক আছো’। তার জন্য আমার খুব খারাপ লাগে, কারণ আমার সব অনুভূতির দ্বিতীয় পর্যায়টা তাকে বুঝতে হয়…কিন্তু সে পছন্দ করে। এটাই আমাদের জীবন।”
এই স্কার্ফের জন্যও কম আক্রমণ সইতে হয়নি নাদিয়াকে। চার বছর আগে তিনি যখন ‘গ্রেট ব্রিটিশ বেক অফ’ প্রতিযোগিতার ষষ্ঠ আসরে অংশ নেন, তখনও মাথায় কালো স্কার্ফ পরেছিলেন। সে সময় ক্যামেরার সামনে কেক তৈরিতে নিজের দক্ষতা দেখাতে পারলেও শুটিংয়ের পর হোটেল কক্ষে যাওয়ার পর তাকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছে।
তৃতীয় সন্তানের (মরিয়ম) জন্মের পর নাদিয়ার মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। সে সময় নানা ধরনের চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। অবসাদের চিকিৎসায় এক চিকিৎসক তাকে এমন ওষুধ দিয়েছি যে, তাতে তিনি একেবারেই অনুভূতিহীন হয়ে পড়েন।
স্বামীর পরামর্শে ৩০ বছর বয়সে যখন তিনি বেক অফ প্রতিযোগিতায় নাম লেখান, তখন হতাশাগুলো বাহ্যিক ব্যক্তিত্বের মুখোশে ঢেকে রাখায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
প্রতিযোগিতার শুরুর দিকে টেলিভিশনের পর্দায়ও নাদিয়াকে দেখে মনে হয়েছে, তার আত্মবিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিযোগিতার ষষ্ঠ সপ্তাহে পাল্টে যায় চিত্র।
“সেদিন আমি সবুজ স্কার্ফ পরেছিলাম,” বলেন নাদিয়া।
এরপরই আসে সেই সন্ধিক্ষণ, নাদিয়া জিতে নেন প্রতিযোগিতার সেরার পুরস্কার। সেদিন নাদিয়ার অর্জন দেখেছিল সারাবিশ্বের প্রায় ১৫ কোটি দর্শক।
বিজয়ী নাদিয়া সেদিন তার অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তৃতায় বলেন, “আমি কখনই আর নিজেকে গুটিয়ে রাখব না, কখনই বলব না যে আমি পারি না। আমি পারি এবং পারব।”
নাদিয়া তার জীবনের চিত্র তুলে এনেছেন তার আত্মজীবনীতে। ‘ফাইন্ডিং মাই ভয়েস’ নামের আত্মজীবনীতে কন্যা, স্ত্রী, মা, উপার্জনকারী এবং নারীসহ দশটি ভূমিকায় আলাদা আলাদাভাবে নিজের জীবনের গল্প লিখেছেন।
তবে নাদিয়ার দৃষ্টিতে এটি কোনো আত্মজীবনী নয়, তার জীবনের খণ্ডচিত্র।