ঐতিহ্য হারাচ্ছে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ

১৯৫৬ সালের ১ জুলাই ২০/২৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজ প্রতিষ্টার ৬৩ বছরে কলেজের অনেক শিক্ষার্থী আজ দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে কলেজের পাঠদানের মান ও ফলাফল নিয়ে নানা প্রশ্ন বিরাজ করছে জেলাবাসীর মধ্যে। দিন দিন ঐতিহ্য হারানোর পথে জেলার প্রাচীন বিদ্যাপীঠ।
বর্তমানে এইচএসসি, অনার্স, মাষ্টার্স ও ডিগ্রি পর্যায়ে কলেজে প্রায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে। কিন্তু শিক্ষক সংকট, শ্রেণীকক্ষের সল্পতা, পরিবহন সংকট, শিক্ষকদের অনুপস্থিত, কর্মস্থলে না থাকা ও আন্তরিকতার অভাব সহ নানামুখি সমস্যায় কলেজটি আজ ইতিহাস-ঐতিহ্য হারানোর পথে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঐতিহ্যবাহী ওই কলেজটি বর্তমানে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একক আস্তানায় পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালের পর থেকে কলেজে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের অবস্থান নেই বললেই চলে। যার কারণে ছাত্রলীগ গ্রুপ উপ-গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। কোনো শিক্ষার্থীই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন না। সম্প্রতি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আমিরুল হোসেন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম এর নেতৃত্বে কলেজ প্রশাসনের কোনো প্রকার অনুমতি ছাড়াই কলেজ অডিটোরিয়াম থেকে শহীদ জিয়ার নাম ফলক ভেঁঙ্গে ফেলা হয়। কিন্তু কলেজ প্রশাসন ছাত্রলীগের এই কাজের বিরুদ্ধে এপর্যন্ত আইনী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ওই ঘটনায় জেলার সচেতন মহলে অনেকটা সমালোচিত হয়েছেন অধ্যক্ষ। এই কলেজে একাধিক বার ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষকরাও লাঞ্চিত হওয়ার নজির রয়েছে। কিন্তু কেউই প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী ছাত্রলীগের নেতারা তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ বদরুজ্জামান চৌধুরী’র কক্ষে তালা ঝুলায়। ওই দিন ছাত্রলীগ নেতারা অধ্যক্ষ্যের নেইম প্লেইট খোলে ফেলে ও অনার বোর্ড থেকে নাম মুছে দেয়। কিন্তু এ পর্যন্ত একটিরও বিচার হয়নি। রেগ ডে তেও বড় ভাইদের দাওয়াত দিতে হয়। দাওয়াত না দিলে অনুষ্টান করা যায়না। ২০১৬ সালের ২ মার্চ কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: আবু হানিফকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ রয়েছে নামধারী ছাত্রলীগ কর্মীদের উপর।
জানা গেছে, ক্ষমতায় থাকাকালিন সময়ে ছাদত্রল-ছাত্রশিবির কলেজ ক্যাম্পাসকে তাদের একক আস্তানায় পরিণত করেছিল। আধিপত্য বিস্তারে তারাও কোনো অংশে কম ছিলনা। ২০০৩ সালের ৯ ডিসেম্বর কলেজ মসজিদে ছাত্রদল নেতাদের গুলিতে কলেজ শাখা শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক আলমাছ মিয়া নিহত হয়। এঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে শিবির। ফের ২০১২ সালে ছাত্রলীগের গ্রুপিংয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী কামরুল ইসলাম নিহত হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কলেজের অধিকাংশ শিক্ষকরা কর্মস্থলে থাকেন না। যার কারণে নিয়মীত ও সময় মতো ক্লাস করানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এদিকে একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জেলার বাহিরের কয়েকজন শিক্ষক মিলে একটি রুম রাখেন। সপ্তাহের প্রথম ৩ দিন কয়েকজন থেকে বাড়িতে চলে যান। শেষের ৩ দিন বাকী কয়েকজন থাকেন। চলতি বছরের ২৫ জুলাই অনুসন্ধানে দেখা গেছে একদিনই ওই কলেজের ১০ জন শিক্ষক অনুপস্থিত। আবার অনেক শিক্ষকরা ক্লাসের সময় বাসায় কোচিং করান।
কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদককে জানায়, এনাম কমিশনের নির্দেশনার আলোকে কলেজে ১৫৮ জন শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু কলেজে পদ সৃষ্টি করা হয়েছে ৮৪ টি। এ পর্যন্ত ১৩টি পদই শূন্য। এদিকে ১৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ১টি বাস রয়েছে।
ভিপি আব্দুল মালিক তরফদার সুয়েব বলেন, “আমাদের সময় ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে আন্দোলন করেছি। কিন্তু এখন এটা দেখা যায়নি। তবে ছাত্রলীগ মাঝে মধ্যে গঠনমূলক কিছু কর্মসূচি পালন করে, এটা দেখে ভালো লাগে”।
মৌলভীবাজার সচেতন নাগরিক সমাজের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন মাতুক বলেন, পেশি শক্তি, অছাত্র ও মেধাহীনদের হাতে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের ছাত্ররানীতি চলে গেছে।
এবিষয়ে জানতে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আমিরুল হোসেন চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে জেলা সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম এর সাথে যোগাযোগ হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে সংযোগ কেটেদেন।
কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ লেঃ কর্ণেল প্রফেসর ছয়ফুল কবীর চৌধুরী বলেন, কলেজ এখন সার্টিফিকেট দেয়ার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার স্বার্থেই রাজনীতিবীদরা ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ নষ্ট করেছেন। এখন আর নিঃস্বার্থ রাজনীতি করা হয়না। প্রত্যেক ছাত্রই তাদের স্বার্থে রাজনীতির সাথে জড়িত হয়। এইচএসসি’র ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য তিনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই দায়ি করেন।
অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ফজলুল আলী বলেন, শিক্ষক, ভবন ও পরিবহন সংকটের কারনে কলেজকে নিয়ে সামনে আগানো সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষক কর্মস্থলে না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষ কর্মস্থলে থাকেন না। তবে তারা নিয়মীত ক্লাস করাচ্ছেন

আরও সংবাদ