প্রবাসিদের কোন দেশ নেই

প্রবাসীরা যখন দেশে ফেরেন তখন একই সুতোয় বাঁধা কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হন সবখানে- কোন দিন এলেন, কদিন আছেন, ফিরছেন কবে?  আমাদের অনেক প্রবাসী দুরপ্রাচ্যে বা ক্ষেত্রবিশেষে মধ্যপ্রাচ্যে থিতু হয়ে গেছেন, পেয়েছেন সোনার হরিণসম ফরেণ পাসর্পোট। ব্রিটেন, আমেরিকার পাসর্পোটের জন্মস্থান বা প্লেইস অব বার্থের কলামে তাঁরা আজীবন-আমৃত্যু বয়ে বেড়ান বাংলাদেশের নাম। এসব প্রবাসী পরবাসীদের পরের প্রজন্ম, যাদের জন্ম ব্রিটেনে তাদের দেশ কিন্তু ব্রিটেন। এদেশে তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, স্কুল, শৈশব-কৈশোর বন্ধুতা মুগ্ধতা সব। বাংলাদেশ তাদের কাছে বাবার দেশ-মায়ের দেশ,হলিডে কাটানোর ক্ষেত্রে তালিকার নিচের সারিতে পড়ে থাকা গন্তব্যের নাম।

যাঁরা প্রবাসে প্রথম প্রজন্ম,আমার বা আমাদের মতো, এখন বড়ো সবিস্ময়ে আর হৃৎহারী অপার বেদনায় দেখি আমার মতো আমার পুর্বসুরী অনেকের এখন কোন দেশ নেই। যারা আমাদের মতোন জন্ম থেকে ছোটবেলা আর বড়বেলার অনেকখানি পার করে এসেছেন বাংলাদেশে, তারা জানেন দেশ ছেড়ে এই পরবাসে পড়ে থাকবার যাতনা আর বেদনা কতখানি।

এইসব নিঘুর্ম সপ্নের দেশে জীবন আর জীবিকার তাগিদে আমরা থাকি বটে,কিন্তু হৃদয় জুড়ে থাকে…প্রিয় দেশমাতৃকা,প্রিয়তমা বাংলাদেশ। এই পরবাস এই দুরপ্রাচ্য কিংবা মধ্যপ্রাচ্য আমাদের অর্থ,সচ্ছলতা কিংবা বেচেঁ থাকবার নির্ভরতা দেয় নি:সন্দেহে…কিন্তু যাপিত দীর্ঘ থেকে দৈর্ঘ্যতর পরবাস কখনোই আমাদের অনেকের নিজের ‘দেশ‘ হয়ে উঠতে পারেনি,পারেনা। ভালো আর মন্দের আপেক্ষিকতার চীরকালীন দ্বন্দসমাসের মতো আবেগের অন্ত:বাসে তাঁেদর হৃদয় জুড়ে রয় বাংলাদেশ।
পরবাসের শুরুতে প্রবাসীরা দেশে সম্পদ আর জমি কেনায় মনোযোগী হন। একসময় দেখা যায় এই সম্পদ হয়ে দাড়ায় স্বজন-প্রিয়জনেরই লোলুপ চোখের লক্ষবস্তু।

এভাবে সম্পদ রুপ নেয় সমস্যায়। পরবাসে নির্ঘুম রাত্রি আর ঘুমময় দিনের পাজরভেজা পরিশ্রমও যখন প্রিয়জনদের চাহিদা মেটাতে অপারগ হয়ে পড়ে তখন বোধকরি বাকী থাকবার মতোন থাকে না আর কিছুই। আর প্রবাসীদের এখনকার পরবর্তী প্রজন্মের বেশিরভাগই চান,বাবার সব দেশে পড়ে থাকা সম্পদ বিক্রি করে টাকাটা এখানে পরবাসেই নিয়ে আসতে। কী লাভ,পড়ে আছে,মানুষ খাচ্ছে…ভাবি হ্যা অবশ্যই এ চিন্তা তো যুক্তির বিচারে সংগতই।
এই পরবাস শেষে শেষ ইচ্ছায় অনেক প্রবাসীর লাশ যায় দেশে,শেষ ঘুমের মতোন না ফেরার দেশে এবং প্রিয় বাংলাদেশে। অনেকের লাশ দেশে নিয়ে যাবার জটিলতা,লাশের সাথে দেশে যাবার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা আর আর্থিক বিবেচনায় তাও যায় না। তাদের অনিচ্ছার শেষ ঘুমের দেশ হয় পরবাসই।
আর একসময় শেকড়ের সন্ধানে পরবাসের মোহমায়া ছেড়ে প্রবাসীরা স্বদেশে একেবারে ফিরতে চাইলেও সদ্য গুম হওয়া ব্রিটিশ বাংলাদেশী মুজিবুর রহমানের মতো গুম হওয়া দু:সপ্নের মিছিল,সম্পদের সংকট,চিকিৎসা বা নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার মতো সংকটের ডানা কেবল উড্ডীনই হয়,আর সে ডানায় হারায় দেশ…না মেলা সমীকরন রয় সেই-প্রবাসীদের কোন দেশ নেই।
মুনজের আহমদ চৌধুরী: নিউজ এডিটর,সাপ্তাহিক বাংলা টাইমস,ইউকে।

আরও সংবাদ