রাজনগর হানাদার মুক্তদিবস আজ

আজ ৬ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের রাজনগর হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী রাজনগর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্ত হয় মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা। তবে মুক্তিযোদ্ধের ৯ মাসে সারাদেশের মতো রাজনগর ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল শত্রুসেনাদের বর্বরতায়। তবুও দমে যাননি দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াতে জীবনের মায়া বিসর্জন দিয়েছিলেন সেই সময়ে।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ৪ঠা ডিসেম্বর রাজনগরের উদনা চা-বাগানে মুক্তিযোদ্ধা আহাদ চৌধুরীর নের্তৃত্বে সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন ৩০ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধা। ৫ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের আগে সম্মুখ সমর শুরু হয়। অসীম সাহসিকতার সাথে আক্রমণ চালালে পরাস্ত হয় হানাদার বাহীনি। কয়েকজন পাক সেনা নিহত হয়। বাকীরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। পরে মুন্সিবাজার ও উদনা চা-বাগানে পাক বাহিনীর ফেলে যাওয়া ৫ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। পরদিন ৬ই ডিসেম্বর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের তারাপাশায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বর্তমান মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান। ৭ই ডিসেম্বর যৌথ বাহীনির কমান্ডার এমএ হামিদ ও আজিজুর রহমান রাজনগর ক্লাবের সামনে জামতলায় আবারো পতাকা উত্তোলন করেন। এখন সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে শহীদ মিনার।

 

এর আগে যুদ্ধের বিভীষিকাময় চিহ্ন রেখে যায় বর্বর পাক বাহিনী। যুদ্ধ শুরুর প্রথম সপ্তাহে শুক্রবার উপজেলার মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের চাটুরা এলাকায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যাক্তিসহ আরো ৪ জনকে বেঁধে গুলিকরে হত্যা করে চাটুরা ব্রীজের নিচে ফেলে যায়। আজও তাদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ১লা মে দুপুরে স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর রাজাকারদের সহযোগিতায় মনসুরনগর ইউনিয়নের পঞ্চেশ্বর গ্রামের নগেন্দ্র বিশ্বাস ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র মনি বিশ্বাসকে ধরে নিয়ে যায় হানাদাররা। পার্শ্ববর্তী মহলাল বাজারের কাছে তাদের হত্যা করা হয়। ৬ মে পাক বাহীনি সদর ইউনিয়নের ঘড়গাঁও গ্রামে অভিযান চালায়। ওই গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল বারীর ১৫ মাস বয়সী সন্তানসহ তার স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যায়। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় তার বাড়িটি। ২৮ দিন পরে ছেড়ে দেয় তার স্ত্রী-সন্তানকে। একই দিনে মনসুরনগর ও গোবিন্দবার্টি এলাকায় অভিযান চালিয়ে শুকুর উল্লহ ও ছয়ফুল নামে দুইজনকে। তাদেরকে কুলাউড়ায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করে তারা। পরের দিন (৭মে) পূর্বদিগন্তে সূর্যোদয়ের আগে পাঁচগাঁও গ্রামে ইতিহাসের নির্মম এক তা-বলীলা চালায় পাকিস্থানি বাহীনি ও তাদের দোসর স্থানীয় রাজাকাররা। রাজাকররা গরু-ছাগল, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকাসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়। ৬২ জনকে ধরে এনে সমাজসেবী হরকিংকর দাস উকিলের পুকুর পাড়ে হাত-পা বেঁধে ব্রাশফায়ার করা হয়। পকুুরের কচুরিপানার ভিতর নাক ভাসিয়ে প্রাণে রক্ষা পান ৩ জন। পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন পুকুরে জাল ফেলে ৫৯টি লাশ উদ্ধার করে পুকুর পাড়েই গণকবর দেন। ওই দিনই সেখান থেকে ৪ জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে মনু নদীতে ফেলে দেয়া হয়। ১৪ মে মুন্সিবাজার এলাকায় ২ জনকে হত্যা করে পাকসেনারা। পরে সেখান থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। ২৯ নভেম্বর মুন্সিবাজারে আবারো আসে শত্রুসেনারা। স্থানীয় সুনীত ধরের বাড়িতে ধরে আনা হয় নিশি রঞ্জন ঘোষ, যতীন্দ্র মোহন ঘোষ, অরবিন্দ, অখিল, সুকেশ, শতদল ধর, সুশীতল ধর, সজল ধর ও শ্যামল ধরকে। পরে সেখানে একত্রে জড়ো করে তাদের গুলি করে বর্বর পাক হায়েনারা। সেই দিন ভাগ্যগুণে বেঁচে যান নিশি রঞ্জন ধর।

মুক্তিযোদ্ধা সজল চক্রবর্তী বলেন, নিজের জন্মস্থানে এই দিনে স্বাধীন পতাকা উড়ানো হয়েছিল। তাই ৬ই ডিসেম্বর এলেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা শুনে দেশপ্রেমিক হবে এটাই এখন প্রত্যাশা। তাই প্রতি বছর দিনটিকে উদযাপন করা হয়। তবে এবছর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচিত কোনো কমিটি না থাকায় হানাদার মুক্ত দিবস পালনের ক্ষেত্রে আগে থেকে আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিলনা। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়ের সার্বিক সহযোগিতায় দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌসী আক্তার বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হানাদার মুক্ত দিবস পালন করা হবে। আমরা চাই সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা জানুক।

আরও সংবাদ