রহমতে আলম (সা.) : সুমহান চরিত্র (দ্বিতীয় পর্ব)

রহমতে আলম (সা.) সুমহান চরিত্র (দ্বিতীয় পর্ব)
রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুমহান চরিত্রের কথা পবিত্র কুরআন ও হাদীসে যেভাবে এসেছে তেমনি তাওরাতেও এসেছে। আদাবুল মুফরাদে একটি হাদীস নকল করা হয়েছে- “হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাত করে বললাম, তাওরাতে উক্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন। তিনি বলেন, অবশ্যই। আল্লাহর শপথ! তাওরাতেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর এমন কতক বৈশিষ্ট্য উক্ত আছে যা কুরআনেও উক্ত আছে- “হে নাবী! নিশ্চয় আমি আপনাকে সাক্ষ্যদানকারী, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীরূপে প্রেরণ করেছি” (সূরা আল-আহযাব ৪৫) এবং নিরক্ষরদের আশ্ৰয়স্থল, আপনি আমার বান্দা ও আমার রাসূল। আমি আপনার নাম রেখেছি মুতাওয়াক্কিল (আল্লাহর উপর নির্ভরশীল)। আপনি রুক্ষ মেজাজ, পাষাণহৃদয় ও হাট-বাজারে শোরগোলকারী নন। আপনি মন্দকে মন্দ দ্বারা প্রতিহত করেন না, বরং ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তাঁকে ততক্ষণ পর্যন্ত তুলে নিবেন না যতক্ষণ তাঁর দ্বারা বক্র জাতিকে সরল পথে প্রতিষ্ঠিত না করবেন এবং তারা বলবে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই। এর দ্বারা তিঁনি অন্ধ চক্ষু খুলে দিবেন, বধির কানকে শ্রবণশক্তি দান করবেন, আচ্ছাদিত অন্তরসমূহকে আচ্ছাদনমুক্ত করবেন”।

রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুমহান চরিত্রের বিশাল ভান্ডার থেকে কিঞ্চিত বিশেষ করে যেগুলো আমাদের ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে বা সামাজিক জীবনে অতিব জরুরী সেগুলোর আলোকপাত করার হবে ইনশাআল্লাহ।

সৃষ্টির সেবা করা:

ইতিপূর্বে আমরা পবিত্র কুরআনুল কারীমের দলিল পেয়েছি নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত। আর যিনি সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত তিনি তো অবশ্যই সৃষ্টির সেবা করবেন। তবে এই সেবা করাটা কখন থেকে বা কিভাবে তিঁনি শুরু করলেন ? সে বিষয়টি জানতে হলে কমরা ওয়াহী নাযিল হওয়ার প্রথম দিকের একটি ঘটনা সামনে নিয়ে আসব। যেটি সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিঁনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট সর্বপ্রথম যে ওয়াহী আসে, তা ছিল নিদ্রাবস্থায় বাস্তব স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিঁনি দেখতেন তা একেবারে প্রভাতের আলোর ন্যায় প্রকাশিত হতো। অতঃপর তাঁর নিকট নির্জনতা পছন্দনীয় হয়ে দাঁড়ায় এবং তিঁনি হেরার গুহায় নির্জনে অবস্থান করতেন। আপন পরিবারের নিকট ফিরে এসে কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে। এভাবে সেখানে তিঁনি এক নাগাড়ে বেশ কয়েক দিন ইবাদাতে মগ্ন থাকতেন। অতঃপর হযরত খাদীজা (রাঃ) এর নিকট ফিরে এসে আবার একই সময়ের জন্য কিছু খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেতেন। এভাবে হেরা গুহায় অবস্থানকালে তাঁর নিকট ওয়াহী আসলো। তাঁর নিকট ফেরেশতা এসে বললেন, পাঠ করুন! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমি বললাম, আমি পড়তে জানি না! তিঁনি বলেন, অতঃপর সে আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে চাপ দিলো যে, আমার খুব কষ্ট হলো। অতঃপর সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো, পাঠ করুন! আমি বললাম আমি তো পড়তে জানি না! সে দ্বিতীয় বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলো যে, আমার খুব কষ্ট হলো। অতঃপর সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো, পাঠ করুন! আমি উত্তর দিলাম, আমি তো পড়তে জানি না! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর তৃতীয়বারে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পাঠ করুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত পিন্ড থেকে, পাঠ করুন, আর আপনার রব অতিশয় দয়ালু”- (সূরা আল-আলাক্ব ১-৩)। অতঃপর এ আয়াত নিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাবর্তন করলেন। তাঁর হৃদয় তখন কাঁপছিল। তিঁনি খাদীজা বিন্‌তু খুওয়ায়লিদের নিকট এসে বললেন, ‘আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত কর, আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত কর। তাঁরা তাঁকে চাদর দ্বারা আবৃত করলেন। এমনকি তাঁর শংকা দূর হলো। তখন তিঁনি খাদীজা (রাঃ) এর নিকট ঘটনাবৃত্তান্ত জানিয়ে তাঁকে বললেন, আমি আমার নিজেকে নিয়ে শংকা বোধ করছি। খাদীজা (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম, কখনই নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়–স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্য করেন। অতঃপর তাঁকে নিয়ে খাদীজা (রাঃ) তাঁর চাচাত ভাই ওয়ারাকাহ ইবনে নাওফাল ইবনে আব্দুল আসাদ ইবনে আব্দুল উযযাহর নিকট গেলেন, যিনি অন্ধকার যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। যিনি ইবরানী ভাষায় লিখতে পারতেন এবং আল্লাহর তাওফীক অনুযায়ী ইবরানী ভাষায় ইনজীল হতে ভাষান্তর করতেন। তিনি ছিলেন অতি বৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে চাচাত ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। ওয়ারাকাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাতিজা! তুমি কী দেখ?’ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দেখেছিলেন, সবই বর্ণনা করলেন। তখন ওয়ারাকাহ তাঁকে বললেন, এটা সেই বার্তাবাহক যাকে আল্লাহ মূসা (আ.) এর নিকট পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বহিষ্কার করবে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা কি আমাকে বের করে দেবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছো অনুরূপ (ওয়াহী) কিছু যিনিই নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে জোরালোভাবে সাহায্য করব। এর কিছুদিন পর ওয়ারাকাহ ইন্তিকাল করেন। আর ওয়াহীর বিরতি ঘটে।

ক্ষমা ও উদারতা:

ক্ষমা ও উদারতা ছিল রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুমহান চরিত্রের অন্যতম একটি দিক। তার বাস্তব প্রমাণ আমরা তাঁর জীবনী পড়লেই পাই। বিশেষ করে মক্কা বিজয়ের সময় তিঁনি যে ক্ষমা ও উদারতার নজীর স্থাপন করেছেন তা কোন মানুষ করতে পারবে না। যে মক্কার লোকেরা তাঁকে এমন কোন নির্যাতন করে নাই যা তারা জানতনা। কিন্ত রহমতের নাবী যখন মক্কা বিজয় করলেন তখন মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-

“আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হবে না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিঁনি সকল দয়ালু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দয়ালু। (সূরা আল-ইউসুফ ৯২)। সুতরাং তোমরা যেতে পার। তোমরা আজ মুক্ত।”

দানশীলতা:

রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দানশীলতা কেমন ছিল তা সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কল্যাণের কাজে ছিলেন সর্বাধিক দানশীল, বিশেষভাবে রামাদ্বান মাসে। (তাঁর দানশীলতার কোন সীমা ছিল না) কেননা রামাদ্বান মাসের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাত্রে জীব্রাঈল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তিনি তাঁকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। যখন জীব্রাঈল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিঁনি কল্যাণের জন্য প্রবাহমান বায়ুর চেয়েও বেশি দানশীল হতেন”।

রহমতে আলম (সা.) : সুমহান চরিত্র (প্রথম পর্ব)

———– চলবে ইনশাআল্লাহ

আরও সংবাদ