ইউরোপের অতিথি কানাইঘাটে

ইউরোপের সাহেবি অতিথি, বিচিত্র-বর্ণিল চিত্রা শালিকের ছবিটি সিলেটের কানাইঘাট থেকে তোলা। ছবি: নাকিব বাপ্পি

 

পৃথীবির কিছু সংখ্যক দেশে যখন তাপমাত্রা থাকে অধিকাংশ সময় শূন্যেরও বেশ নিচে। সেই সঙ্গে থাকে তুষারপাত। শীতের নানান প্রতিবন্ধকতায় যখন কোনো গাছপালাও জন্মাতে পারে না। সাধারণত শীত এলেই উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অঞ্চল, হিমালয়ের আশপাশের কিছু অঞ্চলের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে কম ঠাণ্ডা অঞ্চলের দিকে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাওর ও পাহাড়ী কিছু উষ্ণ স্থানকে পচন্দ করে। ঠিক তেমনি ইউরোপের এক অথিতির দেখা মিলেছে সিলেটের কানাইঘাটে। যার নাম চিত্রা শালিক বা পাতি কাঠশালিক (Common Starling) দেখতে চমৎকার এই পাখিটির প্রধান বিচরণক্ষেত্র সাধারণত ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে। তবে, শীতকালে এই বঙ্গীয় বদ্বীপেও বিচ্ছিন্নভাবে আগমন ঘটে অত্যন্ত সুন্দর ও বর্ণিল এই গায়ক পাখির। বাংলাদেশে এদের দেখা পাওয়ার ইতিহাস যে খুব সু-দীর্ঘ তেমনটা নয়। প্রতি বছর যেমন এদের আগমন ঘটে না কিংবা দেখা মেলে না, তেমনি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সন্দ্বীপ, সুন্দরবনের চর ও ঢাকা বিভাগের মুন্সীগঞ্জ সংলগ্ন চর বলাকি বাদে এদের দেখা পাওয়ার নজিরও খুব একটা নেই।

বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী নাকিবের থেকে জানতে পরলাম বর্ণিল এই পাখি দেখার গল্প এ বছর রাজশাহীর পদ্মার চরে পাখিটির দেখা পাওয়া গেছে। পরিচিত বেশ ক’জন আলোকচিত্রী ছবিও তুলেছেন। এবিষয়ে নাকিবের গল্প তোলে ধরা হলো। সে মনে-মনে প্রমোদ গুনলো। সপ্তাহখানেক আগেই রাজশাহী থেকে ঘুরে এসেছি বলে আক্ষেপটা একটু বেশিই হচ্ছিল। দিন দুয়েক বাদে সিলেট থেকে আলোকচিত্রী শামীম খান ভাই এই পাখির ছবি তুলে পাঠালেন। বললেন-চলে এসো।

সিলেটে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি, এর মধ্যেই বয়োজ্যেষ্ঠ এক আলোকচিত্রী মারফত খবর এলো- ‘চর বলাকি’তে এদের দেখা গেছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের সাম্প্রতিক দাবানলের চেয়েও এই খবর দ্রুত ছড়ালো! আমি সহ আরও বেশ ক’জন তড়িঘড়ি করে ছুটলাম চর বলাকির উদ্দেশ্যে। মোটামুটি চিরুনি অভিযান চালিয়েও যখন এর টিকির নাগালও পেলাম না, ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি-ফিরতি পথে বাড়তি যাত্রাসঙ্গী হিসেবে আমাদের সঙ্গে যাবে একরাশ হতাশা!

জেদ চেপে গেল। সেদিন রাতের বাসেই ঢাকা থেকে রওনা দিলাম সিলেটের উদ্দেশ্যে। আগেভাগেই শামীম ভাইকে জানিয়ে রাখলাম। লোকেশনে যাওয়ার যাতায়াত ব্যবস্থা সহ যাবতীয় বন্দোবস্ত তিনিই করে রাখলেন।

সকালে সিলেটে পৌঁছেই শামীম ভাইয়ের সঙ্গে রওনা দিলাম কানাইঘাটের উদ্দেশ্যে। সারারাতের ভ্রমণের ক্লান্তিতে আমি চোখ মেলে রাখতে পারছিলাম না। গাড়ি কতক্ষণ চলেছে, ঘঁড়ির হিসেবে বলতে পারাটা কঠিন। এদিকে ভাঙাচোরা রাস্তার ধারে, একদম জনমানবহীন পুকুরঘেঁষে গাড়ি থামল। শামীম ভাইয়ের ডাকে আমি গাড়ি থেকে নামলাম। তিনি পুকুরপাড়ের গাছের দিকে ইশারা করলেন।

একটা-দুটো নয়, অন্তত ডজন পাঁচেক পাখি এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাচ্ছে, ডাকছে, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে! আমি কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে শুধুমাত্র এদের পালকের রঙের ছটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে লাগলাম। এদের সাবলীল উড়াউড়ি এবং সংখ্যা দেখে এটা আন্দাজ করতে পারছিলাম, আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে এরা উড়ে যাবে না। তাই আর তারাহুরো করিনি। ধীরেসুস্থেই ক্যামেরায় হাত দিয়েছি।

রাজশাহীতে যেতে না পারার আফসোস, মুন্সীগঞ্জের চরে দেখা না পাওয়ার আক্ষেপ, সেখান থেকে ফিরতি পথের নৌঘাটসহ বহুঘাট পেরিয়ে-সাফল্যের সঙ্গে সবকিছুর ইতি ঘটল সিলেটের কানাইঘাটে।

আরও সংবাদ