কানাইঘাটে জায়গা নিয়ে বিরোধে প্রবাসীর পরিবারকে হয়রানীর অভিযোগ
কানাইঘাটের দিঘীরপার পূর্ব ইউপির পূর্ব ঠাকুরের মাটি গ্রামে বসবাসরত এক যুক্তরাজ্য প্রবাসী পরিবারকে স্থানীয় কতিপয় লোকজন কর্তৃক মিথ্যা অভিযোগ তুলে নানা ভাবে হয়রানির চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রবাসী পরিবারের লোকজন। প্রবাসী এ পরিবারকে নানা ভাবে হয়রানির ঘটনায় সচেতন মহলে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। নিরীহ ও অসহায় এ প্রবাসী পরিবারের লোকজনের উপর মিথ্যা গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সরেজমিনে তদন্ত সাপেক্ষ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানিয়েছেন এলাকার সচেতন মহল।
এলাকাবাসী জানান, কানাইঘাটের পূর্ব ঠাকুরের মাটি গ্রামে এক খন্ড জায়গা ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করে বসতি স্থাপন করেন পার্শ্ববর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার কাজল শাহ ইউপির ডেমার গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী নিজাম উদ্দিন (বশির)। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তার পরিবারের অন্য সদস্য বলতে স্ত্রী শামসুন নাহার শিরীন দীর্ঘদিন থেকে সিলেট শহরস্থ কায়স্থরাইলের বাসায় থেকে তার একমাত্র ছেলে জুনায়েদ আহমদ জাহাঙ্গিরকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তারা পারিবারিক কাজে বাড়িতে আসেন ঈদুল ফিতরে ও ঈদুল আযহায় কিংবা জরুরী কাজে অন্য কোন সময়ে। এতে পরিবারের কর্তা নিজাম উদ্দিন বশির প্রবাসে থাকায় তার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে জুনায়েদ আহমদ জাহাঙ্গীর দু’একদিন তাদের গ্রামের বাড়িতে থেকে আবার তারা তাদের সিলেট শহরস্থ বাসায় চলে যান। এতে তাদের পূর্ব ঠাকুরের মাটি গ্রামের বাড়িটি প্রায় সারা বছরই তাকে তালাবদ্ধ।
সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতি ও ঈদুল ফিতর পরবর্তীতে বাড়িতে আসেন প্রবাসী নিজাম উদ্দিন বশিরের স্ত্রী শামসুন নাহার শিরীন ও তার ছেলে জুনায়েদ আহমদ জাহাঙ্গীর। গত ২রা জুন মঙ্গলবার সকালে তাদের ক্রয়কৃত সাড়ে ৬ শতক জায়গায় কলা গাছ রোপন করেন জাহাঙ্গীর। উক্ত জায়গাটি প্রবাসী নিজাম উদ্দিন বশিরের কাছে বিক্রয় করেছিলেন তাদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা মুক্তা লাল রায়। কিন্তু মুক্তা লালের ভাই প্রজলাল রায় জায়গার সীমানা জটিলতা দেখিয়ে ঐদিন জুনায়েদ হাসান জাহাঙ্গীরের লাগানো কলা গাছ গুলো উপড়ে ফেলেন। এনিয়ে বিকালে প্রজলাল রায়ের সাথে জাহাঙ্গীরের কথাকাটি ও ঝগড়া বিবাদ হলে উপস্থিত গ্রামের মুরব্বীয়ানরা বিষয়টি মিমাংশা করে দেবেন বলে বিচারামলে উভয় পক্ষকে আবদ্ধ করেন। পরে সন্দ্যায় প্রজলাল রায় গ্রাম্য সালিশে বিচার না মেনে পরিকল্পিত ভাবে সংখ্যালগু পরিবারের উপর হামলা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে কানাইঘাট থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। অভিযোগটি থানা পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।
গতকাল বিকালে এ প্রতিবেদক সরেজমিনে উপস্থিত হলে প্রবাসী নিজাম উদ্দিন বশিরের স্ত্রী শামসুন নাহার শিরীন বলেন, পূর্ব ঠাকুরের মাটি গ্রামটিতে ৯০ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। আর এখানে মাত্র দু’তিনটি মুসলিম পরিবারের বসবাস। এদের মধ্যে আমরা একটি পরিবার পার্শ্ববর্তী জকিগঞ্জ উপজেলা থেকে এসেছি। আমার স্বামী যুক্তরাজ্যে থাকেন। আমি আমার একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে এ বাড়িতে বছরে দু’চার দিন থাকি। এই গ্রামে আমাদের আর কোন আত্বীয় স্বজন নেই। আমরা জকিগঞ্জ থেকে আসায় আমাদেরকে তারা (হিন্দু লোকজন) সব সময় হিংসা করে। তিনি বলেন আমার ১৮ বছরের ছেলে জাহাঙ্গীর কোন রাজনীতি করেনা। তাকে তারা কখনো সন্ত্রাসী আবার কখনো শিবির নেতা বানিয়ে লোক সমাজে প্রচার করে। এই গ্রামে আমরা একমাত্র নিরীহ ও অসহায় পরিবার হওয়ার কারণে আমাদের জায়গা-জমি দখল ও ফসলাদি তারা জোর করে নিয়ে যায়। এখন আমার ছেলেকে তারা শিবির নেতা বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমার ছেলে জাহাঙ্গীর কোন রাজনীতি করে বলে কেউ বলতে পারবেনা। আমি এসব মিথ্যা অপবাদের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
এবিষয়ে আলাপকালে দিঘীরপার পূর্ব ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি আওয়ামীলীগের সভাপতি আলী হোসেন কাজল বলেন, পূর্ব ঠাকুরের মাটিতে একটি মাত্র পরিবার পার্শ্ববর্তী জকিগঞ্জের কাজল শাহ ইউনিয়ন থেকে এসে জায়গা কিনে বাড়ি করেছে। ঐদিনের বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আমাদের কাছে উভয় পক্ষ কথা দিয়েছেন। আমরা এবিষয়টি নিষ্পত্তি করে দেবো। আর যে গ্রামে হিন্দু লোকজনের বসবাস বেশি সেখানে প্রজলাল রায়ের পরিবার সংখ্যালগু হবে কিভাবে। আর প্রবাসী বশিরের ছেলে জাহাঙ্গীর শিবির ক্যাডার কিংবা সন্ত্রাসী বা ভূমিখেকো বলে এসব কিছুই আমার জানা নেই।
এবিষয়ে ইউপি আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাসিত বলেন, প্রজলাল রায় পাগল প্রকৃতির লোক। তবে তাদের পরিবার কোন ধাঙ্গা-হাঙ্গামার পরিবার নয়। তার ভাই মুক্তা লাল গ্রামের নিরীহ লোক। অপর দিকে প্রবাসী বশিরের বাড়ী জকিগঞ্জে এখানে তারাও একেবারেই নিরীহ। উভয়ের মধ্যে জায়গা-জমি নিয়ে সামান্য বিরোধ সৃষ্টিতে জাহাঙ্গীরকে সন্ত্রাসী বা শিবির ক্যাডার বলাটা ঠিক হবেনা। জাহাঙ্গীর শিবির ক্যাডার হলে আমরা আগে থেকেই জানার কথা। তিনি বলেন, এসব একে অপরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে প্রজলাল রায় জাহাঙ্গীরে জায়গায় রোপনকৃত কলা গাছ তার জায়গা দাবী করে কেটে ফেলেছে। এনিয়ে জাহাঙ্গীর রাগের বশিভূত হয়ে প্রজলাল রায়কে বাঁশের লাটি দিয়ে কিছু মারপিট করেছে। এঘটনাটি একেবারেই তুচ্ছ এবং স্থানীয় শালিশে নিষ্পত্তি যোগ্য।
এবিষয়ে আলাপকালে পূর্ব ঠাকুরের মাটি গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য ডাঃ কিরেন্দ্র রায় বলেন, প্রজলাল রায় পাগল প্রকৃতির লোক। সে কোন সময় কি করে কেউ বলতে পারেনা। তিনি বলেন, প্রবাসী বশিরের ছেলে জাহাঙ্গীরের সাথে প্রজলাল ও মুক্তা লালের জায়গার বিরোধ নিয়ে আমি একদিন গ্রাম্য শালিশ বিচারে উভয় পক্ষকে আমানতে আবদ্ধ করেছিলাম। যাতে এ বিরোধ নিষ্পতি করে দেওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তীতে তারা কোন পক্ষই আর বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমাকে শালিশ বিচারে ডাকেনি। তিনি বলেন, প্রজলাল রায় ও জাহাঙ্গীর তারা একে অপরের প্রতিবেশী। তাদের জায়গা নিয়ে বিরোধ ছাড়া জাহাঙ্গীর সন্ত্রাসী কিংবা শিবির নেতা এসব কিছুই আমার জানা নেই তবে শুনেছি ঐদিন সন্দ্যায় জাহাঙ্গীর প্রজলালের উপর হামলা করেছে। পরে কিভাবে কি হলো তা আমি আর জানিনা।
দিঘীরপার পূর্ব ইউপির হিসাব সহকারী পূর্ব ঠাকুরের মাটি গ্রামের বাসিন্দা সুরেষ রায় বলেন, প্রজলাল রায় একটু মানসিক ভারসাম্যহীন প্রকৃতির লোক। প্রবাসী বশির ও প্রজলাল রায় তারা একে অপরের প্রতিবেশী প্রজলাল তার জমি দাবী করে জাহাঙ্গীরের লাগানো কলা গাছ উপড়ে ফেলার ঘটনাটি আমার চোখে যে ভাবে খারাপ লেগেছে, ঠিক একই ভাবে ঐদিন বিকালে জাহাঙ্গীর প্রজলাল রায়কে মারপিট করাটাও আমার কাছে খারাপ লেগেছে। তবে প্রজলাল রায় এবং জাহাঙ্গীর একই পাড়া প্রতিবেশী হওয়ায় আমরা তাদের বিরোধটি নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, তাদের জায়গা-জমি নিয়ে একে অপরের কিছু বিরোধকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীরকে সন্ত্রাসী কিংবা শিবির নেতা আখ্যা দেওয়া ও আমাদেরকে ঠাকুরের মাটি গ্রামে সংখ্যালগু বলা তা আমরা পছন্দ করিনা। তিনি বলেন, আমরা এই ঠাকুরের মাটি গ্রামে সংখ্যাগরিষ্ট হিসাবে আছি এবং তাদের উভয়ের বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
দিঘীরপার পূর্ব ইউপির সদস্য মুন্সী আবুল হোসেন মেম্বার বলেন, পূর্ব ঠাকুরের মটি গ্রামটিতে হিন্দু লোকজনের বসবাস বেশি। এখানে পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকে আগত প্রবাসী মুসলিম পরিবারটিতে তারা মাত্র মা ছেলে দু’জন। তাও তারা সিলেট শহরে থাকেন। ঈদের সময় বাড়িতে আসেন। এসময় তাদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন হিংসা করে নানা অপবাদ দিয়ে তাদেরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর শিবির নেতা কিংবা সন্ত্রাসী নয়। তারা নিরীহ হওয়ায় তাদেরকে এই গ্রাম থেকে তাড়ানোর জন্য সন্ত্রাসী, শিবির নেতা সহ নানা ভাবে অপবাদ দেয়া হচ্ছে।
এলাকার বিশিষ্ট মুরব্বী দিঘীরপার পূর্ব ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিন মেম্বার বলেন, প্রবাসী বশির ও প্রজলাল রায় উভয়ই পাশাপাশি বাড়ির বাসিন্দা। তারা একে অপরের প্রতিবেশী তাই আমরা তাদের এই ক্ষুদ্র বিরোধটি মিমাংসা করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু প্রজলাল রায় ও তার পরিবারের লোকজন তারা নিজেদেরকে সংখ্যালগু দাবী করে প্রকৃত প্রবাসী বশিরের সংখ্যালগু পরিবারকে নির্যাতন করছে। তারা তাদের কাছে জায়গা বিক্রি করে দখল দেয়না বলে জানান তিনি।
এদিকে প্রবাসী বশিরের পরিবার ঠাকুরের মাটিতে একমাত্র বহিরাগত মুসলমান পরিবার হওয়ায় এবং ঠাকুরের মটি গ্রামটিতে হিন্দু লোকজনের বসবাস বেশি হওয়ায় প্রবাসী বশিরের পরিবারের লোকজন এখানে চরম ভাবে অসহায় ও নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে। প্রবাসীর ছেলে জাহাঙ্গীর কোন রাজনীতি করেনা ও সন্ত্রাসী কিংবা ভূমিখেকো নয় বলে জোর দাবী করছেন পূর্ব ঠাকুরের মাটি গ্রামের বাসিন্দা বিশিষ্ট মুরব্বী আবুল হোসেন, খসরুজ্জামান, আব্দুশ শুক্কুর, মঈন উদ্দিন (ঠাকুর মঈন) সহ এলাকার শতাধিক লোকজন। তারা স্থানীয় ক্ষুদ্র বিরোধকে সাম্প্রদায়িক পর্যায়ে নিয়ে সংখ্যালগু ও শিবির ক্যাডার বলে একে অপরকে ঘায়েল করার ষড়যন্ত্র বন্ধ করে স্থানীয় পর্যায়ে এই তুচ্ছ বিরোধটি নিষ্পত্তির দাবী জানান।
এশিয়াবিডি/কামরান/আলিম