ব্রিটেনে ফেরার আকুতি সেই শামীমার
লন্ডন অফিস:
আবারও বৃটেনে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন আইসিস বধু ও বহুল আলোচিত শামীমা বেগম। বাংলাদেশী পিতামাতার সন্তান শামীমা বলেছেন, আমি আমার সন্তানদের হারিয়েছি। বন্ধুদের হারিয়েছি। এখন আমি শুধু দেশে (বৃটেন) ফিরতে চাই। বর্তমানে সিরিয়ায় একটি নতুন বন্দিশিবিরে অবস্থান করছেন তিনি। সেখানে তাকে খুঁজে বের করেছেন বৃটেনের ডেইলি মেইল পত্রিকার সাংবাদিক রিচার্ড পেন্ডলবারি। তার কাছে শামীমা বলেছেন, তিনি এখন পাল্টে যাওয়া একজন নারী। গত ৬ মাসে বৃটেনের কারো সঙ্গে তার কথা হয় নি।
সাংবাদিক রিচার্ড পেন্ডলবারি ওই ক্যাম্পে শামীমার সঙ্গে তার সাক্ষাত নিয়ে লিখেছেন, সিরিয়ার এক পাহাড়ি এলাকা। তার পাশেই সূর্য্যরে আলোতে আলোকিত একটি কেবিন। তার এক কোণে একটি সোফার ওপর বসে বৃটেনের বেথনাল গ্রিনের একটি মেয়ে। আমাকে সম্ভাষণ করলো উদ্বেগের সঙ্গে। প্রথমবারেই আমি তার ভিতর লক্ষ্য করলাম একটি পরিবর্তন। তিনি বোরকা পরেননি। তার নাকে ডায়মন্ডের নাকফুল। ঠোঁট চিকচিক করছে। কালোর পরিবর্তে বরই রঙা একটি হিজাব আছে। পরেছেন নীল রঙের লম্বা একটি স্কার্ট। তার এমন উপস্থিতি নতুন ও অপ্রত্যাশিত। মুখ দেখে তাকে চিনে নেয়া যায়। তিনি বৃটিশ টিনেজার আইসিস বধু শামীমা বেগম। সেখানে পরিস্থিতির সঙ্গে তিনি মানিয়ে উঠতে পারছেন না। এক সময় যাদেরকে ঘনিষ্ঠ মনে করতেন তারাও কেউ নেই আশপাশে। শামীমা বললেন, আমার কোনো প্রকৃত বন্ধু নেই। আমার সঙ্গে যারা এসেছিল সেইসব বন্ধুর সবাইকে হারিয়েছি। এখন আমার আর কেউ নেই।
সাংবাদিক রিচার্ড পেন্ডলবারি আরো লিখেছেন, হাত কচলাচ্ছিলেন শামীমা। আমাদের কথোপকথনের সময় এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, তিনি চরম মাত্রায় মানসিক অস্থিরতার সঙ্গে লড়াই করছেন। শামীমা বললেন, আমার মানসিক অবস্থা মোটেও ভাল নেই। শারীরিক দিক দিয়ে ভাল আছি। এখনও আমি একজন যুবতী। রোগ হয় না। এটাও আমার কোনো সমস্যা নয়। তবে রোগ হলো মানসিক। কারণ আমি একটি বাজে অবস্থায় আছি। আমার ভুলের জন্য থেরাপি প্রয়োজন। সব সন্তানকে হারিয়েছি আমি। বিষয়টা খুবই কষ্টের। এখানে যেসব মানুষের সঙ্গে আমি অবস্থান করছি তারা কেউ জানে না আমি কি অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। তারা আমার স্কুলজীবনের বন্ধুদের মতো নয়, যারা সব সময় আমার সঙ্গে গল্প করতো। আমি কি করতে চাই, তারা তার কিছুই বুঝতে পারে না। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের কোনো বিধান নেই। শুনেছি, অন্য ক্যাম্পগুলোতে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়।
দীর্ঘদিন ধরে তাকে ঘৃণা করেন বহু মানুষ। তিনি একজন বিশ্বাসঘাতক, যা তাকে ইসলামপন্থি হত্যাযজ্ঞে তাড়িত করেছে। আর ওই আদর্শ সিরিয়া ও ইরাকজুড়ে হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও দাসত্ব চালিয়েছে। এ জন্য শামীমার প্রতি ঘৃণা থেকে অনেক ভাষ্যকার ও কলামনিস্ট মন্তব্য করেছেন ওই পাহাড়ি এলাকায় পচে মরা উচিত তার। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ১৫ বছর বয়সী শামীমা তার বান্ধবী আমিরা আব্বাস ও খাদিজা সুলতানাকে নিয়ে বৃটেন থেকে পালান। তারা বেথনাল গ্রিন একাডেমি স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। তারা বৃটেন থেকে পালিয়ে প্রথমে যান তুরস্কে। তারপর সীমান্ত অতিক্রম করে পৌঁছে যান সিরিয়ায় আইএসের ডেরায়। সেখানে পৌঁছার ১০ দিনের মধ্যে শামীমা বিয়ে করেন আইএস যোদ্ধা ইয়াগো রেডিজক’কে। এই আইএস যোদ্ধা বিয়ের আগে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হন।
সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল এলাকা দখলে নেয় আইসিস। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ও রাশিয়ার বিমান হামলায় তাদের সেই আধিপত্যের পতন হতে শুরু হয়। এ বছরের মার্চে তাদের সর্বশেষ খেলাফতের সমাপ্তি ঘটে সিরিয়ার বাগুজে। এর অল্প কিছুদিন আগে কয়েক হাজার আইএস যোদ্ধার স্ত্রী ও সন্তানদের মাঝে পাওয়া যায় শামীমাকে। বিশাল আল হাওল অন্তর্বর্তী ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল তাদেরকে। শামীমা তখন বৃটেনে ফেরার আবেদন জানান। কিন্তু তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বৃটেন। তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ওই সময় তিনি মিডিয়াকে সাক্ষাতকার দেয়ায় আইএসের অনেক সমর্থক তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। ফলে তার ছেলে জারা জন্ম নেয়ার ১০ দিনের মধ্যে তাকে অনেক ছোট রোজ ক্যাম্পে নিয়ে রাখা হয়। সেখানে তার সন্তান সংক্রমণে পড়ে এবং পাশেই একটি হাসপাতালে মারা যায়। শামীমার পিতামাতা বাংলাদেশী হওয়ায় তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় চাইতে পারেন বলে মিডিয়ায় বলা হয়। তখন বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়ায় বলে, বাংলাদেশে এলে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হবে।
এরপর থেকে দৃষ্টির আড়ালে ছিলেন শামীমা। সাংবাদিক রিচার্ড পেন্ডলবারি লিখেছেন, গত সপ্তাহে ইন্টারনেটে আবার জেগে ওঠেন শামীমা। এতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, শামীমা উড়ে গিয়েছেন বৃটেনে। সেখান তাকে নতুন পরিচিতি দেয়া হতে পারে। আরো বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী চেরি ব্লেয়ার তার পক্ষে আইনি প্রতিনিধিত্ব করছেন। এই গুজব ফেসবুক ও টুইটারে শেয়ার করা হয়েছে কমপক্ষে ৫০ হাজার বার। কিন্তু এটা গুজবই ছিল, প্রমাণ করেছে রোজ ক্যাম্প।
সাংবাদিক রিচার্ড পেন্ডলবারি লিখেছেন, শামীমার কণ্ঠ নাটকীয়ভাবে পরিবির্তন হয়েছে। আইএসের প্রতি তিনি ঘৃণা প্রকাশ করেন। এর অনুসারীদের বিষয়ে অব্যাহত আতঙ্ক প্রকাশ করেন। তার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শামীমা বলেছেন, এখন আর আল হাওল ক্যাম্পে থাকেন না। এ জন্য তিনি খুশি। ওই ক্যাম্পে আইএস পরিবারের ৭০ হাজারের বেশি সদস্য অবস্থান করছে। এখন রোজ ক্যাম্পে প্রায় ৭০০ পরিবার আছে। তার মধ্যে রয়েছে আইসিস সদস্য। তবে বেশির ভাগই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাস্তুচ্যুত বেসামরিক মানুষ। সেখানে আছে ১০টির মতো দোকান। তাতে আছে সব বাণিজ্যিক পণ্য। মেকআপ, স্বর্ণালংকার থেকে শুরু করে টিভি সেট পর্যন্ত বিক্রি হয় সেখানে। এসব দোকান পরিচালনা করেন সাধারণ শরণার্থীরা।
সেখানে নিজের থেকে ৩০ বছরের বড় একজন কানাডিয়ান নারীর সঙ্গে একটি তাঁবুতে অবস্থান করেন শামীমা। তার সম্পর্কে শামীমা বলেন, তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। আমার মায়ের মতো। অবশ্যই তিনি আমাকে তার সন্তানের মতো দেখেন। আমাদের এই তাঁবুকে আমিই পরিষ্কার রাখি। এখানে আছে একটি টিভি। তাতে আরবি ভাষার চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন ইভেন্টের খবর রাখেন শামীমা। তিনি ছবিও দেখেন। তার ভাষায় আমি দেখেছি ‘মেন ইন ব্লাক: ইন্টারন্যাশনাল’ এবং ‘স্পাইডারম্যান: ফার ফ্রম হোম’ ছবি। অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি ভাল জিনিস হলো টেলিভিশন। আমি সারাদিন এর দিকে তাকিয়ে থাকি। যখন আমার খারাপ লাগে, কথা বলার কেউ থাকে না তখনই এর সামনে বসে পড়ি।
শামীমা বেগম এখন পপ সঙ্গীত শোনেন। খেলাফতের সময়ে তিনি এটা শুনতেন না। তিনি বলেন, পশ্চিমা এই সঙ্গীত আমি খুব মিস করেছি প্রথম যখন সিরিয়ায় যাই। এই ক্যাম্পে একটি ফোন আছে। এটা আমরা ব্যবহার করতে পারি। প্রতিবার আপনি শুধু এক মিনিট কথা বলতে পারবেন। বেশির ভাগ মানুষ এই ফোন ব্যবহার করে টাকা চাওয়ার জন্য। কিন্তু আমার পরিবার আমার সঙ্গে কথাই বলে না। মোটেও না। সিরিয়া যাওয়ার পর তাদের সঙ্গে আমি কথা বলি নি। চেষ্টা করেছি। ক্যাম্পের ফোন দিয়ে চেষ্টা করেছি। তাদেরকে ম্যাসেজ দিয়েছি। তারা আমাকে ফোনে কথা বলার মাধ্যমে আমার পরিচয় নিশ্চিত করতে বলেন। পরে আমি আমার ভয়েসমেইল পাঠাই। তারপর আর কোনো উত্তর পাই নি। শামীমা বলেন, আমার পিতামাতা সব সময় আমার ওপর ক্ষুব্ধ থাকতেন। টিনেজার বয়সে আমার ওপর নিষ্পেষণ চালানো হয়েছে। এটা হয় এশিয়ান পরিবারগুলোতে। এসব পরিবার খুব রক্ষণশীল। এ জন্য আমি তাদের সঙ্গে কথা বলি নি। মিডিয়ায় কথা বলার পর তারা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু আমার কোনো বিকল্প ছিল না। এখন আমি যদি ফিরে যাই তাহলে কি ঘটবে জানি। প্রথমে তারা খুব খুশি হবে। আদর করবে। তারপরই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। যার জন্য আমি প্রস্তুত নই। তবে আমি দেশে (বৃটেন) ফিরতে চাই। সেখানে বিচারের মুখোমুখি হতে চাই। কারণ, এখানে এই ক্যাম্প তো একরকম শাস্তিই।