খালেদা জিয়ার জীবনহানির আশঙ্কা নেই বলছেন চিকিৎসকরা

সোমবার দুপুর সোয়া ১টা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মিল্টন হলে বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার কর্মীরা অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যগত বিষয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করতে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের প্রেস ব্রিফিং দুপুর ১টায় শুরু হওয়ার কথা।

 

খালেদা জিয়ার প্রকৃত শারীরিক অবস্থা নিয়ে কয়েক দিন ধরে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছেন তিনি শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ। স্বজনরা দু’দিন আগে হাসপাতালে দেখা করে বলেছেন, তাকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। এ নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের মনেও নানা প্রশ্ন। এ কারণে দুপুর ১টার আগেই তারা উপস্থিত হন। হাসপাতাল পরিচালকসহ অন্যরা দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে উপস্থিত হন।

 

 

 

প্রেস ব্রিফিংয়ের শুরুতেই একটু বিলম্বের জন্য হাসপাতাল পরিচালকসহ অন্যরা উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বজন ও রাজনৈতিক নেতারা কিছু বক্তব্য দিয়েছেন, যার প্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের মাধ্যমে সবাইকে অবহিত করার জন্য প্রেস বিফ্রিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে।

 

প্রেস ব্রিফিংয়ের শুরুতে যা বললেন বিএসএমএমইউ পরিচালক

 

বিএসএমএমইউ পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুল হক বলেন, খালেদা জিয়া চলতি বছরের ১ এপ্রিল বিএসএমএমইউতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন। ভর্তিকালীন তিনি প্রধানত পাঁচ ধরনের রোগে (অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্রনিক রিউমেটিক আর্থাইটিস, দুর্বলতা ও দাঁতের সমস্যা) আক্রান্ত ছিলেন। ভর্তির সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ ও স্বনামধণ্য চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। এ মেডিকেল বোর্ডের প্রধান মেডিসিন অনুষদের ডিন ও ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ঝিলন মিয়া সরকার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রিওমেটোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হকসহ এ বোর্ডে আরও রয়েছেন কার্ডিওলজিস্ট, ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও অর্থপেডিক্স সার্জন।

 

তার শারীরিক অবস্থা প্রতিনিয়ত তদারকি করা হয়। প্রতিদিন ব্লাড প্রেসার, পালস ও টেম্পারেচার মাপা হয়। প্রতিদিন দুবার ব্লাড সুগার মাপা হয় এবং সে অনুযায়ী ইনসুলিন ইনজেকশন দেয়া হয়। একদিন পর পর ফিজিওথেরাপি দেয়া হয়। মেডিকেল বোর্ড নিয়মিতভাবে একযোগে অথবা প্রয়োজনে আলাদাভাবে তার চিকিৎসা তদারকি করেন।

 

 

 

হাসপাতাল পরিচালক বলেন, অফিস সময় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। অধ্যাপকরা সাধারণত এ সময়ের আগে কেবিন ও ওয়ার্ডে রাউন্ড শেষ করেন। যাতে রোগীদের ফলোআপ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করতে পারেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, যা আগে কখনও বলতে চাইনি। প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদের প্রেক্ষিতে বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য তা বলছি।

 

অধ্যাপকরা স্বাভাবিক ভাবে তাদের রাউন্ডে গিয়ে সবসময় বেগম খালেদা জিয়াকে দেখার সুযোগ পান না। তার কাছ থেকে আগে অনুমতি নিতে হয়। বেশিরভাগ সময় দুপুর দেড়টা বা তার পরে তিনি সময় দেন। কিন্তু বাস্তবে নির্ধারিত সময় তার দেখা পাওয়া যায় না এবং অনেকবার অনেক সময় বোর্ডের চিকিৎসকরা বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে বসে থেকেও তার সাথে দেখা করার সুযোগ পাননি। তার আর্থাইটিস (গাঁট রোগের চিকিৎসার জন্য বর্তমানে আধুনিক যে চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছুদিন যে পরামর্শ দিয়েছেন, কিছু বায়োলজিকস ও ইমিউনোসাপ্রেসিভ ড্রাগস ব্যবহার করার পূর্বে কিছু ভ্যাকসিন দিতে হয়) তাতে এখনও বেগম খালেদা জিয়ার সম্মতি পাওয়া যায়নি। ফলে গতানুগতিক পদ্ধতিতে তার গাঁট রোগের চিকিৎসা চলছে।

 

সার্বিকভাবে ভর্তি সময় থেকে শুরু করে গত সাত মাসে বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোন কোন ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি হয়েছে আবার কোনো ক্ষেত্রে স্থিতিশীল রয়েছে। উনার শারীরিক অবস্থার কোনোভাবেই অবনতি ঘটেনি। উনার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত চিকিৎসাব্যবস্থা ভালো হচ্ছে।

 

প্রশ্নোত্তর পর্বে জানা গেল অনেক অজানা তথ্য

 

স্বজনদের দাবি, গত দুই সপ্তাহ চিকিৎসকরা তার কাছে যাননি, আপনারা কি উনার চিকিৎসা নিয়ে সন্তুুষ্ট এমন প্রশ্নের জবাবে মেডিকেল বোর্ডপ্রধান মেডিসিন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ঝিলন মিয়া সরকার বলেন, মেডিকেল বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে দেখা হয়, প্রতিদিন হয়তো দেখা হয় না। কারণ চিকিৎসকরা চাইলেই তাকে দেখতে পারেন না, রোগীর সম্মতি ও প্রস্তুতির বিষয় থাকে। বেগম খালেদা জিয়া তো অসুস্থ, তিনি দুপুর ১২টার আগে প্রস্তুতি শুরু করেন না। প্রস্তুতি সম্পন্ন হতে একটা দেড়টা বাজে। একেকজনের লাইফস্টাইল একেক রকম, এটা মেনে নিয়ে তাকে সম্মান করে চিকিৎসা করতে হয়।

 

তিনি বলেন, চিকিৎসা প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্যই সন্তুষ্ট এবং ম্যাডাম (বেগম খালেদা জিয়া) নিজেও সন্তুষ্ট। উনার প্রিয়, উনি খুবই পছন্দ করেন (দলীয় বলতে চাই না) দু’জন ডাক্তার (ভাইরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও কার্ডিওলজির এমডি) সবসময় মেডিকেল বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে থাকেন। ওনারা থাকলে ম্যাডাম খুব খুশি ও ইম্প্রেসিভ হন।

 

 

 

অধ্যাপক ঝিলন মিয়া সরকার বলেন, গত ১৪ দিন তাকে দেখা হয়নি এ অভিযোগ এই প্রথম শুনলাম। গত বুধবারও তাকে দেখেছি। অভিযোগ যে কেউ করতেই পারে। তিনদিন ধরে টানা দেখা হচ্ছে। গত পরশু পৌনে এক ঘণ্টা দেখেছি। ম্যাডাম সব সময় হাসিখুশি কথা বলেন।

 

তিনি বলেন, তার জয়েন্টে সাফারিং রয়েছে। ২৮ বছর ধরে রিউমেটিক আর্থাটিস রোগে ভুগছেন। এ রোগ সম্পর্কে তার স্বজনরা ভালো বুঝবে না। এ রোগটি কোনো দিন ভালো হবে না, কিন্তু চিকিৎসা গ্রহণে নিয়ন্ত্রণে থাকবে, স্বাভাবিকভাবে চলতে পারবে। এ রোগ নিয়ে ২৮ বছর আগে যেমন ছিল তেমন থাকবেন তা কখনওই তিনি পারবেন না। এমনটা আশা করাও ঠিক হবে না। এখনকার চিকিৎসা নিয়ে চিকিৎসকরা ও তিনি উভয়েই সন্তুষ্ট। এখন কীভাবে স্বজনদের কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের তার চিকিৎসার ব্যাপারে আশ্বস্ত করবেন সেটা গণমাধ্যমই ভালো বুঝবে।

 

স্বজনরা কেন বিদেশে নিতে চাচ্ছেন, আপনারা কী মনে করেন তাকে বিদেশে নেয়া প্রয়োজন এমন প্রশ্নের জবাবে মেডিকেল বোর্ডপ্রধান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পরিচালকের অনুমতিতে রিওমেটলজিস্টদের নিয়ে পৃথক একটি মেডিকেল বোর্ড করা হয়েছে। কারণ উনার ভোগান্তিটা বাতেই বেশি। এছাড়া অন্য কোনো কমপ্লেইন নেই। দাঁতের সমস্যা সম্পূর্ণ ভালো। প্রেসার এত সুন্দর, সাত মাস ধরে মেপেও কোনো দিন বেশি পাওয়া যায়নি। ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উনাকে আর হাসপাতালে না রাখলেও চলে, এখন যে কোনো জায়গায় তাকে রেখে চিকিৎসা দেয়া যায়। বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না চিকিৎসকরা। বিদেশে যে কেউ চিকিৎসা করাতে যেতে চাইতে পারেন। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা ব্যর্থ বলে মনে করি না।

 

 

 

পরিচালক বলেন, ম্যাডামও দাবি করেছেন, কোনো দিনই তিনি চাননি যে তাকে বিদেশে পাঠানো হোক।

 

গত সাত মাস আগে তিনি যখন এসেছিলেন তখন তিনি হেঁটে এসেছিলেন কিন্তু এখন কেন হুইলচেয়ার ব্যবহার করছেন, দেশের মানুষ তা দেখছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতাল পরিচালক বলেন, যেদিন উনি এসেছিলেন সেদিন তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ ছিল, তাকে হুইলচেয়ারে করে চারজন ধরে নামানো হয়েছিল। এখন আগের চেয়ে অবস্থা ভালো, তিনি চাইলে কারও সাপোর্ট নিয়ে হাঁটতে পারবেন। এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে।

 

পরিচালক বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কথা বলেন, প্রতিবেদন লিখেন তারা পরিচালক বা মেডিকেল বোর্ডের সদস্যদেরর সঙ্গে যোগাযোগ না করেই প্রতিবেদন করেন, যা সঠিক নয়। রোগীর স্বজনরা রোগীর সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারবেন তারচেয়ে চিকিৎসকরা ভালো বুঝবেন। বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে চিকিৎসকদের মনোভাব সম্পূর্ণ আন্তরিক। মেডিকেল বোর্ড যথেষ্ট যত্ন ও সম্মান সহকারে নিয়মিত তার খোঁজখবর রাখেন, তার সময়ের সাথে সময় না মেলায় প্রতিদিন হয়তো যাওয়া হয় না বা প্রয়োজনও হয় না।

 

এ সময় প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত অধ্যাপক ডা. শাহানা রহমান (উপ-উপাচার্য শিক্ষা) পরিচালকের কথার সূত্র ধরে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমানে অন্যতম শারীরিক সমস্যা বাতের আধুনিক ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা প্রদান শুরু করার জন্য যে ভ্যাকসিন দিতে হবে তার জন্য তার অনুমতি প্রয়োজন। এ জন্য তাকে কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। হয়তো তিনি সম্মতিও দেবেন।

 

এ ব্যাপারে মেডিকেল বোর্ডপ্রধান অধ্যাপক ঝিলন মিয়া সরকার বলেন, বাতের আধুনিক চিকিৎসায় ভ্যাকসিনটি ১০ বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ভ্যাকসিনটি দেয়া হয় মূলত চিকিৎসা শুরুর পর যেন জ্বর, কাশি ও নিউমোনিয়া না হয়। খালেদা জিয়াকে অনেক বার আধুনিক চিকিৎসা শুরুর জন্য কাউন্সিলিং করা হয়েছে, হচ্ছে কিন্তু তিনি এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। হয়তো তিনি ভবিষ্যতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন।

 

তিনি আরও বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে ডায়াবেটিসের ওষুধ থেকে দু’বেলা ইনসুলিন নেয়াতে রাজি করাতে অনেকবার কাউন্সিলিং করতে হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার কোনো এক আত্মীয় এ ভ্যাকসিন নিতে গিয়ে রিঅ্যাকশনের শিকার হওয়ায় তিনি এটি নিতে ভয় পাচ্ছেন। তিনি সময় চেয়েছেন, তাকে সম্মান দেখিয়ে সময় দেয়া হয়েছে। তিনি অনুমতি দিলে আধুনিক চিকিৎসা শুরু করা হবে।

 

বর্তমানে যে শারীরিক সমস্যা তা নিয়ে হাসপাতালে আর থাকার প্রয়োজন আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মেডিকেল বোর্ডপ্রধান বলেন, বেগম খালেদা জিয়া যদি আধুনিক বাতের চিকিৎসা শুরু করার জন্য যে ভ্যাকসিন দেয়া প্রয়োজন তা দিতে রাজি হন তবে হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন আছে আর রাজি না হলে হাসপাতালে না থাকলেও চলে।

 

বিএনপিদলীয় নেতারা বেগম খালেদা জিয়ার বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যেতে পারে এমন আশঙ্কার কথা বলছেন, এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের কী মন্তব্য জানতে মেডিকেল বোর্ডপ্রধান বলেন, নেতারা জীবনহানির আশঙ্কা করলেও আমরা কিন্তু করছি না। তবে প্রাণহানির বিষয়টির ব্যাপকতা অনেক। এ সময় তিনি বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ইব্রাহিমের উদাহরণ টেনে বলেন, প্রফেসর ইব্রাহিম লন্ডনে চিকিৎসা করিয়ে দেশে ফিরেই মারা যান। জীবনহানি চিকিৎসকরা করেন না, জীবন আল্লাহর দান। আল্লাহই রক্ষা করবেন। আমরা চিকিৎসকরা মেডিকেল এথিকসের চরম মেইনটেইন করে চলি। সততার সাথে তাকে আমরা দেখি। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখি। তিনি একজন সিনিয়র সিটিজেন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। উনাকে দেখার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য করা হয় না। তারপরও জীবনহানির কথা বলা হতে পারে কিন্তু আমরা এ রকম আশঙ্কা করি না।

আরও সংবাদ