“প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে দরজা জানালা দেয়া হয়নি”
ঘর যেকোন সময় ভেঙে যেতে পারে!
মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর প্রথম ধাপে ‘যার জমি আছে ঘর নেই, তার নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ’ কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ঘর নির্মাণ কাজে সরকারের দেওয়া নির্ধারিত পরিকল্পনার কিছুই মানা হয়নি। অথচ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজে তদারকি করে এই কাজ সম্পন্ন করবেন।
অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সময় “প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদেরকে” (পিআইসি) একাজে সম্পৃক্ত করা হয়নি।
গত ৩০ জুন ২০১৯ তারিখের মধ্যে কাজ সমাপ্ত দেখালেও এখন পর্যন্ত অনেক ঘরের কাজ অনেকাংশে বাকী রয়েছে। কিন্তু ইউএনও কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে ঠিকই টাকা উত্তোলন করেছেন।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পের প্রথম ধাপে ১৭-১৮অর্থ বছরে রাজনগর উপজেলায় ৮৯টি ঘর বরাদ্দ আসে। দরিদ্র পরিবারের ঘর নির্মাণ করে দেয়ার জন্য সরকার প্রতিটি ঘরের বিপরীতে ১ লাখ টাকা বরাদ্দ এবং নির্ধারিত একটি ডিজাইন দেয়। কিন্তু প্রকল্প থেকে লুটপাট করতে ঘর নির্মাণে ডিজাইন প্রাক্কলন মোতাবেক গুণগতমান বজায় রেখে কোনো কাজই করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত ডিজাইন পরিবর্তন করে নিজের মনগড়া ডিজাইনে কাজ করিয়েছেন ইউএনও ফেরদৌসী আক্তার। পিলার ও টিন দিয়ে ঘর নির্মাণের কথা থাকলে নির্মাণ করা হয়েছে নিম্নমানের ইটের ৩ ইঞ্চি গাতুনি দিয়ে এবং স্টিলের দরজা জানালা লাগানোর কথা থাকলেও লাগানো হয়েছে পুরাতন কার্ড ও টিন সেট দিয়ে।
টিনের খুঁটিতে কেমন করে ইটের দেয়াল ঠিকবে সেই চিন্তায় দিন কাটছে সুবিধা ভোগীদের। এ ঘর গুলো নিয়ে উপকার ভোগীরা অনেকটা বেকায়দায়।
সরেজমিন ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিনামূল্যে পাওয়া ঘরের মেঝেতে তাদের নিজ খরচে মাটি ভরাট করতে হয়েছে। এতে প্রতিটি ঘরে খরচ হয়েছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। একমাত্র গৃহটি যাতে সুন্দর হয় সে জন্য সংশ্লিষ্টদের কথামত ঘর নির্মাণকারী শ্রমিকদের ২ বেলা আবার কখনও ৩ বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন ভুক্তভোগীরা।
উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের লালাপুর গ্রামের জহুর মিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘর পেয়ে খুশি হতে পারিনি। সামান্য বাতাসেই ঘর উড়ে যাবে। বর্ষা মৌসুমে সন্তানদের নিয়ে কিভাবে করে বসবাস করব এ চিন্তায় এখন দিন কাটছে। ইতিমধ্যে দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দরজা-জানালা কাটের ফ্রেইমের মধ্যে টিনের সেট দিয়ে তৈরী। এখনও বাথরুম পাইনি।
একই ইউনিয়নের আসুক মিয়া, মালতি রাণী নাথ ও ফজির মিয়ার একই বক্তব্য।
ফজির মিয়া বলেন, “আমারে দিয়ে ৫-৬ দিন জুগালির (হেল্পারের) কাজ করাইয়াও কোনো মজুরি দেয়নি। ঘরটা বানাইতে (নির্মাণে) অত খারাপ কাম (কাজ) করছইন, একজরা (অল্প) বাতাস দিলেই লড়ে (নড়ে)”।
রাজনগর সদর ইউনিয়নের দত্তগ্রাম গ্রামের মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে নাজমা বেগম বলেন, “ইতিমধ্যে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ফাটল দেখা গিয়েছে। ঘরের মেঝেতে ফাটল দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে দরজা জানালা দেয়া হয়নি। এই ঘরে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়।
একই ইউনিয়নের নন্দীউড়া গ্রামের নৃপেন্দ্র মালাকার ও দীপেশ মল্লিক এর ঘরে গিয়ে দেখা যায় দরজা জানালাবিহীন টিনের বেটনের একটি দরজা পাতলা টিন সেটে লাগানো। বাথরুম নেই। ফ্লোর ফেঁটে গেছে।
উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের উত্তর মহলালের জুনেদ মিয়া, আশ্রাকাপনের দেবেন্দ্র রাম মালাকার, আনছার মিয়া, খয়ের উদ্দিন, শাহজান মিয়া ও খেলা বেগমের বাড়ি সরজমিনে গেলে একই অবস্থা দেখা যায়।
কামারচাক ইউনিয়নের মিটিপুর গ্রামের ছায়াদ মিয়া, প্রদীপ দে বলেন, দুর্বল পিলার দিয়ে ঘর বানানো হয়েছে। সিমেন্টের খুঁটিগুলো ফেটে যাচ্ছে। কাজ এক্কেবারে নিম্নমানের। কাজে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি দরজা দেয়া হয়েছে কাঠের ও পাতলা টিন সেট দিয়ে।
সরজমিনে মুন্সীবাজার ইউয়িনের খলাগাঁও গ্রামের দয়াময় দাস ও শীতেষ চন্দ্র দাসের বাড়িতে দেখা যায় একই অনিয়মের চিত্র।
কামারচাক ইউপি চেয়ারম্যান নজমুল হক সেলিম বলেন, “এ কাজ নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট নয়। ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য হলেও কাজের বিষয়ে আমাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। শুধু তালিকাটা দিয়েছি এর বাহিরে কিছু বলতে পারছিনা।
পাঁচগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান শামসূন নূর আহমেদ বলেন, “ কিভাবে ডিজাইন ছিল আর কিভাবে কাজ হচ্ছে কিছুই বলতে পারছি না। আপনি তো প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য (পিআইসি) তাহলে জানবেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ আমাদেরকে এ কাজে এক্টিভ করেনি।
মনসুরনগর ইউপি চেয়ারম্যান মিলন বখত বলেন, “আমরা শুধু তালিকা দিয়েছি। কাজে কিভাবে হওয়ার কথা, আর কিভাবে হয়েছে সে বিষয়ে আমি অবগত নয়। তবে কোনো অনিয়ম হলে এনিয়ে আলোচনা করব।
এ বিষয়ে রাজনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফেরদৌসী আক্তারের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার হাতে এখন এতো সময় নেই। আপনি একবার অফিসে আসেন বিস্তারিত কথা বলব”।।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/সাইফ