মৃত মা-বাবার হক


এই দুনিয়ার জমিন ছেড়ে সবাইকে একদিন যেতে হবে, আর এটাই চিরন্তন সত্য, যা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমের সুরা আল-ইমরানে ১৮৫ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন- “প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে”।

সুতরাং আমাদের মা-বাবাসহ সবাই একদিন না একদিন মরতেই হবে। আর এই মরনের পর মানুষ অন্ধকার কবরে গিয়ে কোন নেক কাজ করতে পারে না। তবে যারা জীবিত থাকেন তারা যদি কোন ভাল কাজ করেন মৃত ব্যক্তিদের জন্য তখন তাদেরকে এর সাওয়াব দেওয়া হয়, যাহা কুরআন শরীফ ও হাদিস শরীফের বহু দলিল দ্বারা প্রমাণিত। বিশেষ করে আমাদের যাদের মা-বাবা এই দুনিয়ার জমিন ছেড়ে চলে গেছেন তাদের অনেক হক আমাদের উপরে থেকে যায়, যেমনি ভাবে তারা জীবিত থাকা অবস্থায় ছিল।

ইনশা আল্লাহ, আজকে আমরা সংক্ষিপত আকারে জানব “মৃত মা-বাবার হক সম্পর্কে”।

গোসল ও কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা।
ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে এসেছে মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কাফন দেওয়া ফরজে কেফায়া। এবং যাতুল আখিরাত কিতাবের মধ্যে এসেছে মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কাফন দেওয়া যেভাবে ফরজে কেফায়া তেমনি ভাবে দাফন করার জন্য কবরস্থানে নিয়ে যাওয়াও তদ্রূপ ফরজে কেফায়া। সুতরাং এর থেকে আমরা অবশ্যই বুঝতে পারছি, মৃত ব্যক্তি যদি নিজের মা-বাবা হন তাহলেত এই দায়িত্ব পালন করা কত গুরুত্বপূর্ণ সন্তান হিসেবে। আর মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কাফন-দাফন করার কাজে যারা থাকবেন, তাদের ফযীলত সম্পর্কে হাদিস শরীফে এসেছে- “হযরত আবু রাফে (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কোন মুসলিম মাইয়েতকে গোসল করাবে, অতঃপর তার গোপনীয়তা সমূহ গোপন রাখবে, আল্লাহ তাকে চল্লিশ বার ক্ষমা করবেন। যে ব্যক্তি মাইয়েতকে কাফন পরাবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের মিহি ও মোটা রেশমের পোষাক পরিধান করাবেন। যে ব্যক্তি মাইয়েতের জন্য কবর খনন করবে, অতঃপর দাফন শেষে তা ঢেকে দিবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত পুরস্কার দিবেন জান্নাতের একটি বাড়ীর সমপরিমাণ, যেখানে আল্লাহ তাকে রাখবেন। (হাকেম, ছহীহ তারগীব ও আহকামুল জানায়েয)

সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফের হাদিসে এসেছে- “হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যাক্তি মৃতকে গোসল দিল, কাফন পরালো, সুগন্ধি মাখালো, বহন করে নিয়ে গেল, তার জানাজার নামাজ পড়লো এবং তার গোচরীভূত হওয়া তার গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করল না, তার থেকে গুনাহসমূহ তার জন্মদিনের মত বের হয়ে যায়”।

 তাদের ওসিয়ত পূরন করা।

সহীহ ইবনে হিব্বানে এসেছে- “হযরত রাশিদ ইবনে সুয়াইদ আশ-শাকাফী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললাম হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমার মা একজন দাস মুক্ত করার ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার কাছে কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তাকে নিয়ে এসো। সে আসলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে? সে উত্তর দিল আল্লাহ তায়ালা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন, আমি কে? সে উত্তর দিল আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও। কেননা সে মুমিনা”।

 তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা।

আদাবুল মুফরাদে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মানুষের মৃত্যুর পর তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে বলে, হে প্ৰভু! এটা কি জিনিস? তাকে বলা হয়, তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে”।

মুসনাদুল বাজ্জারে এসেছে- “হযরত উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার কবরের পাশে দাড়ালেন। আতপর বললেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। এবং তার ঈমানের উপর অবিচল ও দৃঢ়তা কামনা কর। কেননা এখন তাকে প্রশ্ন করা হবে”।

 তাদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা।

মা-বাবাসহ সমস্ত মুমিন মুসলমানদের জন্য কিভাবে দোয়া করতে হবে, সেই সমস্ত দোয়া আল্লাহ তায়ালা নিজেই কুরআনু কারীমে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যেমন-

সূরা বনী ইসরাঈলের ২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন- “হে আমার প্রভু! আমার মা-বাবার প্রতি দয়া করো, যেমন তারা আমাকে ছোট থাকতে দয়া দিয়ে লালন পালন করেছেন”।

সূরা ইব্রাহীমের ৪১ নম্বর আয়াতে আবার বলে দিয়েছেন- “হে আমাদের প্রভু! যেদিন হিসাব হবে সেদিন আমাকে, আমার মা-বাবাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করো”।

সূরা নুহ এর ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ আবার শিখিয়ে দিলেন- “হে আমার প্রভু! আমাকে, আমার মা-বাবাকে, আমার ঘরে ঈমানের সাথে যে প্রবেশ করে তাকে এবং সব ঈমানদার পুরুষ ও নারীকে ক্ষমা করো, আর জালেমদের শুধু ধ্বংসই বাড়িয়ে দাও”।

সুতারাং প্রত্যেক মা-বাবার উচিত এমন সন্তান রেখে যাওয়া যারা দোয়া করবে। কেননা সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমাল বন্ধ হয়ে যায় তিন প্রকার আমাল ছাড়া। ১. সদাকাহ্‌ জারিয়াহ। ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকার হয় অথবা ৩. পুণ্যবান সন্তান যে তার জন্যে দোয়া করতে থাকে”।

তাদের পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করা।

সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মুমিন ব্যক্তির রূহ তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা হয়”।

ইবনে মাজাহ শরীফে আরো এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কোন ব্যক্তি তার যিম্মায় এক দীনার বা এক দিরহাম পরিমাণ ঋণ রেখে মারা গেলে কিয়ামতের দিন তার নেক আমলের দ্বারা তা পরিশোধ করা হবে। আর সেখানে কোন দীনারও থাকবে না দিরহামও থাকবে না”।

সুনানে আন-নাসায়ীতে এসেছে- “হযরত মুহাম্মাদ ইবনে জাহাশ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় তিনি আকাশের দিকে তাঁর মাথা উঠান, তারপর তাঁর হাত ললাটের উপর স্থাপন করে বলেন, সুব্‌হানাল্লাহ্‌! কী কঠোরতা অবতীর্ণ হলো! আমরা ভয়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। পরদিন আমি জিজ্ঞাস করলাম ইয়া রাসুলুল্লাহ! ঐ কঠোরতা কী ছিল, যা অবতীর্ণ হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যাঁর নিয়ন্ত্রণে আমার প্রাণ তাঁর কসম। যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, আবার জীবন লাভ করে, আবার শহীদ হয় এবং আবার জীবিত হয়, পরে আবার শহীদ হয়, আর তার উপর কর্জ থাকে, তবে তার পক্ষ হতে সে কর্জ আদায় না হওয়া পর্যন্ত সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না”।

তাদের পক্ষ থেকে কাফফারা আদায় করা।

সূরা নিসার ৯২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “একজন ঈমানদার আরেকজন ঈমানদারকে হত্যা করতে পারে না (কোন ঈমানদারকে হত্যা করলে হত্যাকারী আর ঈমানদার থাকে না), তবে ভুলক্রমে হত্যা করলে ভিন্ন কথা। কেউ যদি কোন ঈমানদার লোককে ভুলক্রমে হত্যা করে তাহলে তাকে একজন ঈমানদার দাস মুক্ত করতে হবে এবং নিহতের পরিবারকে রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হবে, তবে তারা মাফ করে দিলে ভিন্ন কথা। যদি নিহত ব্যক্তি তোমাদের কোন শত্রুপক্ষের লোক হয় এবং ঈমানদার হয় তাহলে একজন ঈমানদার দাস মুক্ত করতে হবে। আর যদি এমন কোন গোষ্ঠীর লোক হয় যাদের সাথে তোমাদের শান্তিচুক্তি আছে তাহলে তার পরিবারকে রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হবে এবং একজন ঈমানদার দাস মুক্ত করতে হবে। যে তা পারবে না তাকে আল্লাহর কাছ থেকে পাপমুক্তি কামনায় অবিরাম দুই মাস রোযা রাখতে হবে। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়”।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে গভীর রাত পর্যন্ত বিলম্ব করে। এরপর তার গৃহে গিয়ে দেখে যে, বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার স্ত্রী তার খাবার নিয়ে এলে সে সন্তানদের কারণে কসম করলো যে, সে খাবে না। পরে খাবার গ্রহণকে উচিত মনে করলে সে খেয়ে নিল। এরপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে তাঁকে উক্ত ঘটনা বলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খায়, পরে অন্যটিকে তা থেকে উত্তম মনে করে, যে যেন তা করে ফেলে এবং নিজের কসমের কাফফারাহ দেয়”।

তাদের পক্ষ থেকে মান্নত পূরন করা।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ আনসারী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে জানতে চেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কোন এক মানতের ব্যাপারে, যা আদায় করার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার মায়ের পক্ষ থেকে মানত পূর্ণ করার আদেশ দিলেন। পরবর্তীতে এটাই সুন্নাত হয়ে গেল”।

বুখারী শরীফে একই বর্ণনাকারী থেকে আরো এসেছে- “তিনি আরো বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এক লোক এসে বলল যে, আমার বোন হজ্জের মানত করেছিল। কিন্তু সে মারা গেছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাঁর উপর কোন ঋণ থাকলে তবে কি তুমি তা আদায় করতে না? লোকটি বলল, হাঁ। তিনি বললেন, কাজেই আল্লাহর হককে আদায় করে দাও। কেননা, আল্লাহর হক আদায় করা আরো বড় কর্তব্য”।

 তাদের পক্ষ থেকে দান-সদাকাহ করা।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলো, আমার বাবা মারা গেছেন এবং তিনি কিছু সম্পদ রেখে গেছেন, কিন্তু ওয়াসিয়্যাত করেননি। তার পক্ষ থেকে সদাকাহ করা হলে কি তার গুনাহ ক্ষমা হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হ্যাঁ”।

মুসলিম শরীফে আরো এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললো, আমার মা হঠাৎ মারা গেছেন। তাঁর ব্যাপারে আমি ধারণা করি, তিনি যদি কথা বলতে পারতেন তবে সদাকাহ করতেন। আমি যদি তাঁর পক্ষে সদাকাহ করি, তবে কি আমার এ কাজের কোন সাওয়াব হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ”।

 তাদের আত্মীয় স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করা।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত বারাআ ইবনে আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- খালা হলো মাতৃস্থানীয়”।

সহীহ তালীকুর-রাগীবে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এক লোক এসে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি একটি কবিরাহ গুনাহ করে ফেলেছি। আমার তওবা করার সুযোগ আছে কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মা কি জীবিত আছেন? সে বলল না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমার খালা কি জীবিত আছেন? সে বলল আছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার সাথে ভালো ব্যবহার কর।

সহীহ ইবনে হিব্বানে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কবরে তার বাবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়, সে যেন তার বাবার ভাইদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখে”।

 তাদের বন্ধুদের সাথে ভালো ব্যবহার করা।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার (রাঃ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, মাক্কায় এক রাস্তায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) এর সাথে এক বেদুঈনের সাক্ষাৎ হলো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) তাঁকে সালাম দিলেন এবং তিনি যে গাধার পিঠে আরোহণ করতেন, সে গাধাটি তাকে আরোহনের জন্য দিয়ে দিলেন। তিনি তাঁর মাথার পাগড়ীটিও তাকে দান করলেন। তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার (রাঃ) বলেন যে, আমরা তাকে বললাম, আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন। বেদুঈনরা তো অল্পতেই তুষ্ট হয়ে যায়। (এত দেওয়ার প্রয়োজন কি ছিল?) তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বললেন, এ ব্যক্তির বাবা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর বন্ধু ছিলেন। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, কোন ব্যক্তির সর্বোত্তম নেকীর কাজ হচ্ছে তার বাবার বন্ধুর সাথে ভালো ব্যবহার বজায় রাখা”।

মুসলিম শরীফে আরো এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত খাদীজাহ (রাঃ) ব্যতীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মিণীদের আর কারো প্রতি ঈর্ষান্বিত হইনি, অথচ আমার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেনি। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বকরী যাবাহ করতেন তখন বলতেন, এর গোশ্ত হযরত খাদীজাহ (রাঃ) এর বান্ধবীদের পাঠিয়ে দাও। একদা আমি তাঁকে রাগিয়ে দিলাম এবং বললাম, হযরত খাদীজাহ (রাঃ) কে এতই ভালোবাসেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, তাঁর ভালোবাসা আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে”।

 তাদের পক্ষ থেকে রোজা পালন করা।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- রোজা কাযা যিম্মায় রেখে যদি কোন ব্যক্তি মারা যায় তাহলে তার অভিভাবক তার পক্ষ হতে রোজা আদায় করবে”।

সহীহ বুখারী শরীফে আরো এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা এক মাসের রোজা যিম্মায় রেখে মারা গেছেন, আমি কি তাঁর পক্ষ হতে রোজা কাযা করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হাঁ, আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করাই হল অধিক যোগ্য”।

তাদের পক্ষ থেকে উমরাহ বা হজ্জ করা।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেন, আমার মা হজ্জের মানৎ করেছিলেন তবে তিনি হজ্জ আদায় না করেই ইন্তেকাল করেছেন। আমি কি তাঁর পক্ষ হতে হজ্জ আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তার পক্ষ হতে তুমি হজ্জ আদায় কর। তুমি এই ব্যাপারে কি মনে কর যদি তোমার মায়ের উপর ঋণ থাকত তা হলে কি তুমি তা আদায় করতে না? সুতরাং আল্লাহর হক আদায় করে দাও। কেননা আল্লাহর হকই বেশী আদায়যোগ্য”।

 তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করা।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য শিংওয়ালা দুম্বাটি আনতে নির্দেশ দিলেন, যেটি কালোর মধ্যে চলাফেরা করতো (অর্থাৎ- পায়ের গোড়া কালো ছিল), কালোর মধ্যে শুইতো (অর্থাৎ- পেটের নিচের অংশ কালো ছিল) এবং কালো মধ্য দিয়ে দেখতে (অর্থাৎ- চোখের চারদিকে কালো ছিল)। সেটি আনা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ছুরিটা নিয়ে এসো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওটা পাথরে ধার দাও। তিনি তা ধার দিলেন। আতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি নিলেন এবং দুম্বাটি ধরে শোয়ালেন। তারপর সেটা যাবাহ করলেন এবং বললেন- আল্লাহর নামে। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার ও তাঁর উম্মাতের পক্ষ হতে এটা ক্ববূল করে নাও। তারপর এটা কুরবানী করেন”।

 তাদের ভালো কাজ গুলো জারি রাখা।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ মাসঊদ আল-বাদ্রী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একজন লোক একটি বাহন (জন্তুযান) চাইতে এসে বলে, আমার জন্তুযানটি চলার অযোগ্য হয়ে পড়েছে (বা মরে গেছে)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি অমুক ব্যক্তির নিকট যাও। সে তার নিকট গেলে সে তাকে একটি জন্তুযান দান করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে লোক কোন সৎ কাজের পথ দেখায়, তার জন্য উক্ত কাজ সম্পাদনকারীর সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে”।

মুসলিম শরীফে আরো এসেছে- “হযরত মুনজির ইবনে জারির (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন উত্তম প্রথা বা কাজের প্রচলন করে সে তার এ কাজের সাওয়াব পাবে এবং তার পরে যারা তার এ কাজ দেখে তা করবে সে এর বিনিময়েও সাওয়াব পাবে। তবে এতে তাদের সাওয়াব কোন অংশে কমানো হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন খারাপ প্রথা বা কাজের প্রচলন করবে, তাকে তার এ কাজের গুনাহ এবং শাস্তি বহন করতে হবে। তারপর যারা তাকে অনুসরণ করে এ কাজ করবে তাদের সমপরিমাণ বোঝাও তাকে বইতে হবে। তবে এতে তাদের অপরাধ ও শাস্তি কোন অংশেই কমবে না”।

 তাদের কৃত গুনাহের কাজ বন্ধ করা।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে লোক সঠিক পথের দিকে ডাকে তার জন্য সে পথের অনুসারীদের প্রতিদানের সমান প্রতিদান রয়েছে। এতে তাদের প্রতিদান হতে সামান্য ঘাটতি হবে না। আর যে লোক বিভ্রান্তির দিকে ডাকে তার উপর সে রাস্তার অনুসারীদের পাপের অনুরূপ পাপ বর্তাবে। এতে তাদের পাপরাশি সামান্য হালকা হবে না”।

 তাদের ওয়াদা পূরন করা।

সূরা বনী ইসরাঈলের ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর ওয়াদা পূরণ করবে। ওয়াদা সম্পর্কে নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করা হবে”।

 তাদের কবর জিয়ারত করা।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত ইবনে বুরায়দাহ (রহঃ) তার পিতা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমি তোমাদেরকে ক্ববর যিয়ারাত করতে নিষেধ করতাম। এখন অনুমুতি দিচ্ছি তোমরা ক্ববর যিয়ারাত করতে পারো। আমি ইতোপূর্বে তিন দিনের বেশি কুরবানীর গোশ্ত রাখার ব্যাপারে তোমাদেরকে নিষেধ করতাম। এখন তোমাদের যতদিন ইচ্ছা রাখতে পারো। এছাড়া আমি তোমাদেরকে পানির পাত্রে নাবীয তৈরি করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমরা যে কোন পানির পাত্রে তা তৈরি করতে পারো। তবে মাদকদ্রব্য পান করো না”।

সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফে তিনি থেকে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, যে তারা যখন কবরস্থানে যেতেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের শিক্ষা দিতেন, হে কবরবাসী, মুমিন ও মুসলিমগণ! তোমাদেরকে সালাম। আমরাও ইনশা আল্লাহ তোমাদের সাথে মিলিত হবো। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের ও তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি”।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবিত মা-বাবার নেক হায়াত দান করুন। তাদের খেদমত করার তৌফিক আমাদের দান করুন। যারা কবরে চলে গেছেন আল্লাহ তায়ালা তাদের কবর গুলোকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন। (আমিন)

লেখক: ইমাম ও খতিব
ওল্ডহাম জামে মসজিদ যুক্তরাজ্য।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

আরও সংবাদ