সন্তানের প্রতি মা-বাবার দায়িত্ব কি?

আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নিয়ামতের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হচ্ছে সন্তান। পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা শুরা এর ৪৯ ও ৫০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন, অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান”। পারিবারিক জীবনে সন্তান কতবড় নিয়ামত তিনিই বেশি উপলব্ধি করেন যার সন্তান নেই। সন্তান মা-বাবার যৌথ ফসল। মহান আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব সন্তান মা-বাবার নিকট পবিত্র আমানত। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যাদের ধন সম্পদের অভাব নেই কিন্তু তাদের কোন সন্তান নেই। আবার অনেক আছেন ধন সম্পদ তেমন নেই কিন্তু সন্তান আছে কয়েকজন।

সুতরাং আল্লাহ তায়ালা যাদের সন্তান দিয়েছেন যদি তাদের এমন নেক সন্তান হিসেবে রেখে যেতে পারেন, যে আপনার জন্য দোয়া করবে, তাহলে কবর থেকে নিয়ে হাশর পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা আপনাকে নেকি দান করবেন। আর এই সম্পর্কে সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায় তিন প্রকার আমল ছাড়া। ১. সদাকাহে জারিয়াহ। ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকার হয় অথবা ৩. পুণ্যবান সন্তান যে তার জন্যে দোয়া করতে থাকে”। পক্ষান্তরে মা-বাবার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হবে যদি সন্তানকে নেক সন্তান হিসেবে গড়ে না তুলতে পারেন। কারণ প্রতিটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে ইসলামের উপর। কিন্তু মা-বাবার কারণে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়। এই বিষয়ে কুরআন শরীফের সুরা রুমের ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আল্লাহ তায়ালার দেয়া ফিতরাতের অনুসরন কর, যে ফিতরাতের উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন”। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- প্রতিটি নবজাতকই জন্মলাভ করে ফিতরাতের (তাওহীদের) উপর। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান বা অগ্নিপূজারী রূপে গড়ে তোলে”।

অতএব এই সন্তান আমাদের জন্য যেমনিভাবে এক বড় নিয়ামত ঠিক তেমনিভাবে এক বড় ফিতনা তথা পরীক্ষা। যা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা তাগাবুনের ১৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন- “বস্তুত তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানগন একটি পরীক্ষা। আর আল্লাহর কাছেই আছে এক মহা পুরস্কার” তাই আল্লাহ তায়ালা যাদের সন্তান দান করেছেন তাদের উপর এক মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। মা-বাবার নিকট থেকে স্নেহ-মমতাসহ সন্তানের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবার অধিকার আছে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে-একবার হযরত আবু দারদা (রাঃ) কে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) বলেন- “তোমার উপর তোমার রবের হক রয়েছে, তোমার শরীরের হক রয়েছে এবং তোমার পরিবারের হক রয়েছে। অতএব প্রত্যেককে তার অধিকার দাও। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) এর এ বক্তব্য পেশ করা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হযরত সালমান ফরসী (রাঃ) সত্য বলেছেন”। একজন সন্তানের প্রতি মা-বাবার দায়িত্ব কি থাকতে পারে সেগুলো পবিত্র কুরআনুল কারীম ও হাদীসের আলোকে আমরা সংক্ষিপত পরিসরে জানব ইনশা আল্লাহ।

 সন্তানের জন্য দোয়া করা।

সর্বপ্রথম একজন মুসলিম হিসেবে যে কাজটি করতে হবে সেটা হচ্ছে নেক স্ত্রী ও নেক সন্তানের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা। আর এই দোয়া আল্লাহ তায়ালা নিজেই আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন কুরআন শরীফের সুরা ফুরকানের ৭৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে আমাদের রব, আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন”। সূরা আল-ইমরানের ৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে আমার রব, আমাকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী”।

 তাদের কানে আযান দেয়া।

সন্তান দুনিয়াতে আসার পর গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান দেয়া, তা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। এটি মা-বাবার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত উবাইদুল্লাহ ইবনে আবূ রাফি (রাঃ) উনার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (আবূ রাফি) বলেন, হযরত ফাতিমা (রাঃ) হযরত হাসান ইবনে আলী (রাঃ) কে প্রসব করলেন, তখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হযরত হাসান (রাঃ) এর কানে নামাজের মতই আযান দিতে দেখেছি”।

সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করানো।

কুরআন শরীফের সুরা বাকারার ২৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পুরো দুবছর বুকের দুধ পান করাবে। এটা তাদের জন্য, যারা দুধ পান করানোর মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়। এক্ষেত্রে সন্তানের পিতাকে যথোচিতভাবে মায়েদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে হবে। কারো ওপর সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কোন মা কিংবা বাবাকে তার সন্তানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। (বাবার অবর্তমানে কিংবা অপারগতায় তার) উত্তরাধিকারীকে একইরকম দায়িত্ব পালন করতে হবে। যদি পিতামাতা পারস্পরিক সম্মতি ও পরামর্শক্রমে (সন্তানকে) দুধ ছাড়াতে চায়, তাহলে তাদের কোন পাপ হবে না। আর তোমরা যদি তোমাদের সন্তানদেরকে (অন্য মেয়েলোকের) দুধ পান করাতে চাও, তাহলে তোমাদের কোন পাপ হবে না, যদি (এর মূল্য হিসেবে) তোমাদের যা দেওয়ার তা ঠিকমত দিয়ে দাও। আর আল্লাহকে ভয় কর। জেনে রাখবে, তোমরা যা করো আল্লাহ তা সবই দেখতে পান”।



 সন্তানের সুন্দর নাম রাখা।

সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে আত্বা (রহঃ) থেকে বর্ণিত, যাইনাব বিনতু আবূ সালামাহ (রাঃ) তাকে প্রশ্ন করেন, তোমার মেয়ের কি নাম রেখেছো? তিনি বললেন, আমি, তার নাম রেখেছি বাররা (পুণ্যবতী)। অত:পর তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের নাম রাখতে বারণ করেছেন। আমার নামও বাররা রাখা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা নিজেদের পরিশুদ্ধ দাবি করো না। কেননা আল্লাহই ভাল জানেন, তোমাদের মধ্যে কে পুণ্যবান। অত:পর তিনি বললেন, আমি এর কি নাম রাখবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর নাম রাখো যাইনাব”।

সন্তানের আক্বিকা করা ও চুল কামানো।

সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সকল নবজাতক তার আক্বিকার সাথে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করা হবে। ঐ দিন তার নাম রাখা হবে। আর তার মাথার চুল কামানো হবে”। ছেলের পক্ষ থেকে ২টি ছাগল এবং মেয়ের পক্ষ থেকে ১টি ছাগল আল্লাহর নামে যবেহ করা সুন্নাত। যা তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) জানিয়েছেন, ছেলে সন্তানের পক্ষে একই বয়সের দুটি বকরী এবং মেয়ে সন্তানের পক্ষে একটি বকরী আকীকা দেওয়ার জন্যে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন।

 সন্তানের পক্ষ থেকে সদাকাহ করা।

সন্তান ছেলে হউক অথবা মেয়ে হউক তার চুল কেটে সেই চুলের ওজন অনুযায়ী রূপা সদাকাহ করা। সুনানে তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি বকরী দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হাসান (রাঃ) এর আকীকা করেন এবং বলেন, হে ফাতিমা! তার মাথা নেড়া করে দাও এবং তার চুলের ওজনের অনুরূপ রূপা দান কর। তদানুযায়ী আমি তার চুল ওজন করলাম এবং তার ওজন এক দিরহাম বা তার কাছাকাছি হয়”।

তাদের তাহনিক করা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে শিশুদের খেজুর দিয়ে তাহনীক এবং বরকতের জন্য দোয়া করতেন। যা সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আসমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তখন তাঁর পেটে ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ), আমি এমন সময় হিজরত করি যখন আমি আসন্ন প্রসবা। আমি মাদিনায় এসে কুবাতে অবতরণ করি। এ কুবাতেই আমি পুত্র সন্তানটি প্রসব করি। এরপর আমি তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে তাঁর কোলে দিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি খেজুর আনলেন এবং তা চিবিয়ে তার মুখে থুথু দিলেন। কাজেই সর্বপ্রথম যে বস্তুটি আব্দুলাহর পেটে গেল তা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর থুথু। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামান্য চিবানু খেজুর নবজাতকের মুখের ভিতরের তালুর অংশে লাগিয়ে দিলেন। এরপর তার জন্য দোয়া করলেন এবং বরকত চাইলেন। তিনি হলেন প্রথম নবজাতক সন্তান যিনি হিজরতের পর মুসলিম পরিবারে জন্মলাভ করেন”।

খাতনা করানো।

ছেলে সন্তানের খাতনা করানো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম একটা সুন্নাত কাজ। আল-মু‘জামুল আওসাতের মধ্যে এসেছে- “হযরত জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হাসান এবং হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সপ্তম দিবসে আকীকা এবং খাতনা করিয়েছেন”।

তাদের তাওহীদ শিক্ষা দেয়া।

সন্তান যখন কথা বলা শিখবে তখন থেকেই তাকে তাওহিদ ও রিসালতের শিক্ষা দেওয়া শুরু করতে হবে। তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাকে বললেন, হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিখাতে চাই। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, আল্লাহও তোমার হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, তুমি তাঁকে সর্বদা সামনে পাবে। যখন কোন কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সহযোগিতা চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর জেনে রাখ! যদি পুরো জাতি তোমার কোন উপকার করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন উপকার করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি পুরো জাতি তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন ক্ষতি করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলমের লিখা শেষ হয়েছে এবং কাগজসমূহ শুকিয়ে গেছে”।

 তাদের কুরআন শিক্ষা দেওয়া।

সন্তানকে যখন পড়া শেখানো শুরু করবেন তখন প্রথম থেকেই সহী শুধুভাবে পবিত্র কুরআন শরীফের শিক্ষা দিতে হবে। কেননা ফরজ নামাজ আদায় করার জন্য কুরআন শরীফের সঠিক তেলাওয়াত আবশ্যক। জামিউল কাবীরে এসেছে- “রাসূলুল্লাহ বলেছেন- তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কুরআনের জ্ঞান দাও”। কুরআন শরীফ শিক্ষা করার ফজিলত সম্পর্কে সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সে লোকই তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যে কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে তা শিক্ষা দেয়”।

দ্বীনি জ্ঞান শিক্ষা দেয়া।

সন্তানকে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া প্রত্যেক মা-বাবার উপরে একান্ত কর্তব্য। কেননা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্য ফরজ। আর সন্তানের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব আনজাম দিতে হবে মা-বাবাকে। সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয”।

তাদের নামাজ শিক্ষা দেয়া।

একজন বান্দা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের সর্বোচ্চ পথ হচ্ছে ফরজ নামাজ আদায় করা। তাই সন্তানকে নামাজ শিক্ষা দেওয়া মা-বাবার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আমর ইবনে শুয়াইব (রহঃ) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হলে তাদেরকে নামাজের জন্য নির্দেশ দাও। যখন তাদের বয়স দশ বছর হয়ে যাবে তখন নামাজ আদায় না করলে এজন্য তাদেরকে মারবে এবং তাদের ঘুমের বিছানা আলাদা করে দিবে”।

 তাদের উত্তম ব্যবহারের শিক্ষা দেয়া।

সন্তানকে উত্তম ব্যবহার শিক্ষা দেওয়া মা-বাবার দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভূক্ত। পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা লোকমানের ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতে এসেছে যা হযরত লোকমান (আঃ) উনার ছেলেকে শিক্ষা দিয়েছিলেন- “হযরত লোকমান (আঃ) তার সন্তানকে বললেন, আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা কোন দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর, নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ”।

 তাদের আদর-স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে খুশি রাখা।

মানুষের ভালবাসা অনেক সময় খারাপ মানুষটাকেও ভালো মানুষে পরিণত করে দেয়। আর একজন সন্তান হিসেবে সে তার মা-বাবার কাছ থেকে আদর ও ভালোবাসা পাওয়ার হকদার। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা হাসান ইবনে আলী (রাঃ) কে চুম্বন করলেন। সে সময় তাঁর নিকট আকরা ইবনে হাবিস তামীমী (রাঃ) উপবিষ্ট ছিলেন। আকরা ইবনে হাবিস (রাঃ) বললেন, আমার দশটি পুত্র আছে, আমি তাদের কাউকেই কোন দিন চুম্বন দেইনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পানে তাকালেন, অতঃপর বললেন, যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না”।

 প্রাপ্ত বয়স হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করা।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমি জিজ্ঞাসা করলাম আবূ সালামার সন্তানদের জন্য আমি যদি খরচ করি এতে কি আমার জন্য প্রতিদান রয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ যতদিন তুমি খরচ করবে ততদিন তোমার জন্য প্রতিদান থাকবে”।

তাদের সক্ষম ও সাবলম্বি করে তোলা।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু সাঈদ ইবনে ওয়াককাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমাদের সন্তান সন্ততিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বি রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম”।

দ্বীন ইসলামের পথে পরিচালিত করা।

কুরআন শরীফের সুরা ইউসুফের ১০৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “বলুন, এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই”। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “তোমার মাধ্যমে একজনও যদি হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়, তবে তা হবে তোমার জন্য লালবর্ণের অতি মূল্যবান উট থেকেও উত্তম”।

 তাদের মাঝে ইনসাফ কায়েম করা।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে আমার পিতা তার সম্পদ থেকে কিছু প্রদান করেন। আমার মা আমরাহ বিনতু রাওয়াহা বললেন, আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না, যতক্ষণ না আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সাক্ষী রাখেন। এরপর আমার পিতা আমাকে নিয়ে নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসেন, আমার দানের উপর তাঁকে সাক্ষী রাখার জন্যে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, এরূপ কাজ কি তুমি তোমার আরো সব পুত্রদের সঙ্গে করেছ? তিনি বললেন, না। নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমার সন্তানদের মধ্যে ন্যায় বিচার করো। তখন আমার পিতা চলে আসেন এবং সে দান ফিরিয়ে নেন”।

 তাদের খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা।

কুরআন শরীফের সূরা আত-তাহরীমের ৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে ইমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও”। সূরা ফুসসিলাতের ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন- “আর কাফিররা বলবে, হে আমাদের রব, জ্বিন ও মানুষের মধ্যে যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে তাদেরকে আমাদের দেখিয়ে দিন। আমরা তাদের উভয়কে আমাদের পায়ের নীচে রাখব, যাতে তারা নিকৃষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়”।

অশ্লিলতা, বেহায়াপনা ও অপসংস্কৃতি থেকে বিরত রাখা।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সব পুরুষকে লানত করেছেন যারা নারীর বেশ ধরে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধরে”। সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে”।

 তাদের বিবাহ দেওয়া বা করানো।

বিবাহ মানুষকে যিনার কাজসহ বহু খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এবং বিবাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম একটা সুন্নাত কাজ। সুতরাং সন্তান যখন বিবাহের উপযুক্ত হবে তখন সুন্নাত পদ্ধতিতে বিবাহ দেওয়া বা করানো এবং বিবাহর যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা মা-বাবার উপরে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জামিউল কাবীরের মধ্যে “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই বাবার উপর সন্তানের হকের মধ্যে রয়েছে, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দিবে”।

বর্তমান ফিতনার যুগে সমস্ত অপসংস্কৃতি, অনৈতিকতা এবং চরিত্র বিধ্বংসী কাজ থেকে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সন্তানদের হেফাজতে রাখুন। আর তাদের সঠিক পথে রাখার মহান দায়িত্ব যেন আমরা মা-বাবা হিসেবে পালন করতে পারি এবং তাদের হকসমূহ যথাযথভাবে আদায় করার তৌফিক দান করেন। (আমীন)

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে-মসজিদ, যুক্তরাজ্য

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান  

আরও সংবাদ