এক নজরে পাপিয়া কাণ্ড!

যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়া এখন সবার আলোচনা সমালোচনায়। দেশের পাড়া-মহল্লাসহ সর্বত্রই চলছে তার কথা। বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে নারীদের অসামাজিক কাজে ব্যবহার করে ও বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধানে।

দেশত্যাগের সময় বিমানবন্দর থেকে ৩ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার

তড়িঘড়ি করে শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকালে দেশত্যাগের চেষ্টা চালান পাপিয়া। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অর্থপাচার, জাল টাকা সরবরাহ, মাদক ব্যবসা, প্রতারণা ও অসামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পাপিয়াসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এ সময় তাদের কাছ থেকে জাল টাকা ও ডলারসহ প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।

তার সঙ্গে গ্রেপ্তার অন্য তিনজন হলেন- তার স্বামী মফিজুর রহমান (৩৮), পাপিয়ার পিএস শেখ তায়্যিবা (২২) ও মফিজুরের পিএস সাব্বির খন্দকার (২৯)।

পরে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একটি পাঁচ তারকা হোটেল থেকে চার নারীকে আটক করা হয়। মোটা অঙ্কের টাকায় তাদের দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসামাজিক কাজ করিয়ে আসছিলেন পাপিয়া ও তার স্বামী।

পাপিয়ার এক দিনের বার বিল আড়াই লাখ টাকা

দেশত্যাগের সময় বিমানবন্দর থেকে তিন সহযোগীসহ পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের পর তার থেকে নানা তথ্য বের করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের তথ্যমতে, গত বছরের নভেম্বর মাসে হোটেল ওয়েস্টিনের ২১ তলার প্রেসিডেন্ট রুমটি ভাড়া নেন পাপিয়া। বিগত ৩ মাসে ওই কক্ষের ভাড়া বাবদ প্রায় ৮৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। হোটেল ওয়েস্টিনের ১৯ তলায় একটি বার আছে, সেটি তিনি পুরোটাই বুক করে নিতেন। সেখানে প্রত্যেক দিন তিনি মদের বিল বাবদ আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করতেন। সব মিলিয়ে গত ৩ মাসে হোটেল কর্তৃপক্ষকে প্রায় তিন কোটি টাকার বিল পরিশোধ করেছেন তিনি।

পাপিয়ার বাসায় অভিযান, অস্ত্র-মদসহ বিপুল টাকা উদ্ধার

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় তার বাসায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, মদসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকা উদ্ধার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-১)। এছাড়াও বিদেশি অস্ত্র, ম্যাগজিন, গুলি উদ্ধার করা হয়।

পাপিয়ার পাপের সাম্রাজ্য যত বড়

পাপিয়া তার সম্রাজ্যে পিউ নামেই বেশি পরিচিত। তার প্রকাশ্য আয়ের উৎস গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। তবে আড়ালে জাল টাকা সরবরাহ, অর্থ পাচার এবং অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

র‌্যাবের প্রাথমিক তদন্তে ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে পাপিয়ার ২টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদীতে ২টি ফ্ল্যাট, দুই কোটি টাকা মূল্যের ২টি প্লট, ৪টি বিলাসবহুল গাড়ি। গাড়ির ব্যবসায় তার প্রায় দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে একাধিক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা আছে।

পাপিয়া ও তার স্বামী মিলে রেলওয়ে ও পুলিশের উপপরিদর্শক পদে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ১১ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স করে দেওয়ার কথা বলে ২৯ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া নরসিংদীতে মাদক, অস্ত্র ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন।

তবে, পাপিয়ার উপার্জনের অন্যতম উৎস সুন্দরী নারীদের দিয়ে জোর করে অসামাজিক কাজ করানো। ঢাকার বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটেলে তরুণী মেয়েদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করতেন তিনি। তাদের বেশিরভাগই নরসিংদী থেকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে ঢাকায় এনেছিলেন। অনৈতিক কাজে রাজি না হলে ওইসব মেয়েদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন তিনি।

ঝড় বইছে পাপিয়া-মফিজের গ্রামে

বহিষ্কৃত এই যুবলীগ নেত্রী ও তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ওরফে মতি সুমনকে নিয়ে নরসিংদীতে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। জেলার সাধারণ মানুষ তাদের নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছে।

স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও এলাকাবাসীরা জানান, ২০০০ সালের দিকে মফিজুর রহমানের উত্থান শুরু হয়। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও ব্ল্যাকমেইল ছিল সুমনের প্রধান পেশা। একটা সময় গিয়ে মফিজুর রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পর আলোচনায় আসেন তিনি। এর মধ্যে পাপিয়াকে বিয়ে করেন মফিজুর। এরপর তিনি স্ত্রী পাপিয়াকে রাজনৈতিক কাজে লাগান। এরপর ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে পাপিয়া সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পাপিয়ার ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ

গ্রেপ্তারের পর শামিমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামীসহ চারজনের বিরুদ্ধে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ।

সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে জাল টাকা উদ্ধারের মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী কায়কোবাদ।

১৫ দিনের রিমান্ডে পাপিয়া

রিমান্ড আবেদনের পর অস্ত্র, মাদক ও জাল টাকার পৃথক তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়ার ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছন আদালত। তার স্বামী মফিজুর রহমানেরও ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।

পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এই আদেশ দেন।

এছাড়া জাল টাকার মামলায় পাপিয়া ও তার স্বামীর দুই সহযোগীর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। দুই আসামি হলেন- সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবা।

এর আগে পাপিয়াসহ চারজনকে ঢাকার আদালতে হাজির করে পুলিশ। বিমানবন্দর থানায় করা জাল টাকার মামলায় পাপিয়া, তার স্বামীসহ চারজনকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন আদালত। এছাড়া শেরেবাংলা নগর থানায় করা অস্ত্র ও মাদক মামলায় পাপিয়া ও তার স্বামীকে ৫ দিন করে ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন আদালত। আদালতে পাপিয়াসহ চারজনকে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে এজলাসকক্ষে তোলা হয়। এরপর তাদের আসামির কাঠগড়ায় রাখা হয়।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/সাইফ

আরও সংবাদ