ডাকসু: বছর পার হলেও বন্ধ হয়নি গণরুম-গেস্টরুম

দীর্ঘ আড়াই যুগ পর ২০১৯ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ- ডাকসু নির্বাচন। কিন্তু এ নির্বাচনকে ঘিরে যত প্রত্যাশা ছিল, নির্বাচনের পর তার অধিকাংশই মিছে প্রমাণিত হয়েছে। ইস‌্যুগুলোর মধ‌্যে গণরুম বা গেস্টরুমের মতো বহুল আলোচিত বিষয়গুলোরও সুরাহা হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য ইস্যু ছিল আবাসন সংকট দূর করা। যার সমাধান বিন্দুমাত্রও ডাকসু করতে পারেনি। ক্যান্টিনের খাবারের মান নিয়েও ছিল না দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ে সংকট দূর করা ছিল শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি। দাবি ছিল সাত কলেজের অধিভুক্তির বাতিলে ডাকসুর সমন্বিত উদ্যোগ। পূর্ণ হয়নি সেটিও।

বরং বছরজুড়েই লেগেছিল ছাত্রলীগ মনোনীতদের সঙ্গে ভিপি নুরের বিবাদ। কয়েকদফা মারধরের মুখেও পড়তে হয়েছে ভিপিকে। ডাকসুতে হামলা হয়েছে। গত একবছরে ডাকসুর কোটি টাকা ব্যয়ের খাত নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে শিক্ষার্থীদের।

আগামী ২২শে মার্চ তাদের কার্যকাল শেষ হতে যাচ্ছে। তবে এখনো পরবর্তী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না আসায় নিয়মানুযায়ী পরবর্তী তিন মাস এ কমিটিই দায়িত্ব পালন করতে পারবে।

বিরোধে বিপর্যস্ত বেশিরভাগ প্রস্তাব :

ডাকসুর ২৫ জন প্রতিনিধির মধ্যে ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদকের পদ ছাড়া বাকি সবগুলো ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত। এ কারণে সব সময় তারা ডাকসুতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। সব কাজে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর ও সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। ফলে ছাত্রলীগের বাইরে থেকে ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক প্রস্তাব করলে ছাত্রলীগ প্যানেলের বেশি ভোট হওয়ার কারণে তাদের প্রস্তাব বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়।

জানা যায়, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) পক্ষ থেকে ‘অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন অন সাইবার সেইফটি অ্যান্ড ৯৯৯’ শীর্ষক সপ্তাহব্যাপী একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। উদ্যোগটি নিয়েছিলেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি তিনি। এর জন্য তিনি ছাত্রলীগের দুই নেতা ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহসাধারণ সম্পাদকের (এজিএস) অসহযোগিতাকে দায়ী করেন। এমন অনেক উদ্যোগই তারা পরস্পর বিরোধের কারণে বাস্তবায়ন করতে পারেননি বলে অভিযোগ তার।

ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কাজ :

ডাকসুর বিভিন্ন নেতা তাদের ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কাজ করেছেন। এজিএস সাদ্দাম হোসেন, ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের সাদী, পরিবহন বিষয়ক সম্পাদক শামস ঈ নোমান, সাহিত্য সম্পাদক মাজহারুল কবির, সদস্য রকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য, তানভীন হাসান সৈকত, সংস্কতি সম্পাদক আসিফ তালুকদারকে ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন কাজে সরব দেখা গেছে। তবে একই প্লাটফর্ম থেকে কেউ তেমন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

প্রশ্নবিদ্ধ ব্যয় :

ডাকসু থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যমতে, গত এক বছরে ডাকসু বিভিন্ন খাতে ব্যয় করেছে এক কোটি ১১ লাখ টাকা। কিন্তু এ অর্থ কোন খাতে ব্যয় হয়েছে সেটির দৃশ্যমান দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষার্থীরা। তবে ডাকসু ভিপি নুর তার নিজের বরাদ্দকৃত অর্থ তুলতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন।

নুর বলেন, ‘আমার খরচের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ চেয়েও থাকলেও সেটি নানা জটিলতায় তুলতে পারিনি। প্রশাসনের অসহযোগিতা এ জটিলতার কারণ।’

খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যারা খরচ করেছেন, তারা ব্যক্তি উদ্যোগে করেছেন। এক্ষেত্রে ডাকসুর অফিসিয়াল কোনো অনুমোদন ছিল না। ছাত্রদের জন্য ব্যয় হতে পারে। তবে তার একটা পলিসি আছে। সেটি মানা হয়নি।’

এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘তার জন্য যা বরাদ্দ, তা তিনি তুলে ছাত্রবান্ধব কাজ করতে পারেন। কিন্তু তিনি সেটি না করে জাতীয় রাজনীতি করতে গেছেন, সেটিত আমাদের কারো দোষ না।’

বন্ধ হয়নি ‘গেস্টরুম’ :

ডাকসু নির্বাচনের পূর্বে অধিকাংশ প্রার্থীর অন্যতম ইশতেহার ছিল গেস্টরুম বন্ধ করা। কিন্তু কমিটি তাদের পূর্ণ মেয়াদ পার করলেও এর সঠিক বাস্তবায়নের রূপ দেখেননি। বরং ডাকসু ভিপি ও অন্যান্যদের মধ্যে এটি নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলেছে। ভিপি বলছেন, গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদৈর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করা হয়। দলীয় প্রোগ্রামে না গেলে টর্চার করা হয়। অন্যদিকে ছাত্রলীগ প্যানেল থেকে নির্বাচিতরা এটাকে মিথ্যাচার বলে দাবি করছেন।

এ বিষয়ে ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘গেস্টরুমে আগেও ছিল। এখনো আছে। এটি হচ্ছে সিনিয়র জুনিয়রের মিলনমেলা। তবে কেউ যদি এটির নেতিবাচক ব্যবহার করেন তাহলে সেটিকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’

রয়ে গেছে গণরুম :

ডাকসু প্রার্থীদের আরেকটি বড় ইশতেহার ছিল গণরুম থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি। আবাসন সংকট দূর করা। কিন্তু এর কানাকড়িও বাস্তবায়িত হয়নি। এ নিয়ে ডাকসুর ভিপি, সমাজসেবা সম্পাদক আন্দোলন করলে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

তবে ছাত্রলীগ প্যানেল থেকে নির্বাচিত তানভীর হাসান সৈকত এটি নিয়ে ভিসির বাসার সামনে অনশনে বসলে ভিসি এ সংকট দূরীকরণের আশ্বাস দেন। তবে বাস্তবে এটি আশার মুখ দেখেনি।

বাজেট না থাকলেও ছিল হল সংসদের কাজ :

হল সংসদের জন্য এক বছরেও সুনির্দিষ্ট কোনো বাজেট না থাকলেও শিক্ষার্থী বান্ধব কিছু কাজ চোখে পড়েছে। ক্রিকেট, ফুটবল, সাহিত্য সাময়িকী, রিডিংরুম সংস্কারসহ বেশকিছু উদ্যোগ হল সংসদের পক্ষ থেকে দেখা গেছে। বিভিন্ন দিবসেও দেখা গেছে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

ডাকসুর প্রশংসিত কিছু কাজ :

এতকিছুর মাঝেও ডাকসুর বিভিন্ন নেতার ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কাজ হয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে তারা প্রশংসিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সংস্কৃতি সম্পাদক আসিফ তালুকদারের উদ্যোগে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ভেতরের অংশ ধুমপানমুক্ত করা, গণরুম বন্ধের দাবিতে সদস্য তানভির হাসান সৈকতের একক অনশন, সান্ধ্য কোর্স বন্ধে প্রশাসনকে চাপ দেওয়া, স্মার্টফোনভিত্তিক বাইসাইকেলসেবা জো-বাইক সেবা, সদস্য তিলোত্তমা শিকদারের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে ও হলে স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিনের ব্যবস্থা ছিল কিছু ভালো কাজ।

ডাকসুর সভাপতি কী ভাবছেন :

পদাধিকার বলে ডাকসু সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন এবং উদ্যোগের বাস্তবায়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারা সেটির মূল্যায়ন করবেন।’

পরবর্তী নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটি বড় একটি কার্যক্রম। সে বিষয়ে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।’
সূত্র: রাইজিংবিডি ডট কম

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/সাইফ

আরও সংবাদ