করোনা’র তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও বৈশ্বিক পর্যালোচনা
গোটা পৃথিবীর চারদিক থেকে আজ কান্না আর আতংকের আওয়াজ ভেসে আসছে। লাশের দীর্ঘ লাইন কোন কিছুতেই যেনো থামছে না! বৈশ্বিক অর্থনীতি আজ মহা বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় থমকে গেছে প্রাণচাঞ্চল্য। “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা” ইতোমধ্যে উক্ত ভাইরাসটিকে মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত তিনশো বছরে প্রায় ৪টি মহামারি একের পর এক আক্রমণ করেছে আমাদের এই পৃথিবীতে।
১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু, আর ২০২০ সালে কোভিড-১৯।
শুধু ১৯২০ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যান প্রায় ১৭থেকে ৫০ মিলিয়ন মানুষ।
কোভিড-১৯ যা করোনা নামে পরিচিত। করোনা ভাইরাস হলো নিদু ভাইরাস শ্রেণির করোনা ভাইরদা পরিবার ভুক্ত করোনা ভাইরিনা উপগোত্রের একটি সংক্রমণ ভাইরাস প্রজাতি। এ ভাইরাসের জিনাম নিজস্ব আর এন এ দিয়ে গঠিত। করোনা ভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে। যার অর্থ মুকুট। কারণ ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে এ ভাইরাসটি দেখতে অনেকটা মুকুটের মতো। ধারণা করা হয় প্রাণীর দেহ এ ভাইরাস প্রথম মানবদেহে প্রবেশ করে। করোনা ভাইরাস ১৯৬০ এর দশকে প্রথম আবিস্কৃত হয়। প্রথম দিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি, কাশিতে আক্রান্ত রোগিদের মধ্যে এ রকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনা ভাইরাস-২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনা ভাইরাস ওসি-৪৩ নামে নামকরণ করা হয়।
এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে এ ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে এস এ আরএস- সি ও ভি, ২০০৪ সালে এইচ সি ও ভি এন এল-৬৩, ২০০৫ সালে এইচ কে ইউ-১, ২০১২ সালে এম ই আর এস- সি ও ভি এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে চীনে নভেল করোনা ভাইরাস।
২০১৯ সালের ৩১ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রমণ দেখা গেছে। “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা” উক্ত ভাইরাসটিকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে ২০১৯-এন সিওভি নামকরণ করে।
এ পর্যন্ত চীনের সাথে সাথে প্রায় ১৮৮ টির বেশি দেশ ও অঞ্চলে সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। যাতে প্রায় ১৪ হাজারের মতো মানুষ মৃত্যুবরন করেছে। নিশ্চিত ভাবে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে আরো তিন লাখের ও বেশি রোগী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। তাছাড়া প্রায় ৯৬ হাজার জনের বেশি লোক সুস্থ হয়ে উঠেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। বাংলাদেশে দুই জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এবং আরো ২৭ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা গেছে(২২মার্চ পর্যন্ত)।
গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ জানায়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রায় ৫০০ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
চীনের পর ইউরোপের তিনটি দেশ তথা ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড গড়েছে। তাছাড়া ব্রিটেন, আমেরিকা, ইরান ও মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলোতে প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। করোনার জন্মস্থান চীনকে ছাড়িয়ে মৃত্যুর সংখ্যায় শীর্ষে এখন ইতালি(প্রায় ৫০০০)।
তবে এ ভাইরাস প্রতিরোধে আতংকিত না হয়ে আত্ন-সচেতনতা ই নিজেকে রক্ষার অন্যতম মাধ্যম। বিশ্ববিখ্যাত কোন বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক এই ভাইরাস প্রতিরোধে শতভাগ সফল কোন ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার করতে এখনো সফল হন নি। তবে কোভিড-১৯ প্রতিহত করতে যে এখন আমাদের আরো জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে সেটি ও স্পষ্ট।
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে শনাক্তকরণ, পরীক্ষা, চিকিৎসা, আইসোলেশন ও রোগীর সাথে কারা মেলামেশা করেছিলেন তাদের শনাক্তের উপর। তবে এই ভাইরাসের লক্ষণ সমূহও এখন মোটামুটি স্পষ্ট। আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ফেরদৌস খন্দকার বলেছেন, “লক্ষণ ছাড়া ও লোকজনের করোনা ভাইরাস থাকতে পারে”।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক ড. ক্ষেত্রপাল সিং, হাত ধোয়া, হাঁচি ও কাশি নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিকভাবে মানুষকে দূরে থাকার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেন।
সম্প্রতি আইইডিসিআর করোনার লক্ষণ ও নির্দেশনা প্রদান করেছে। তবে এ ভাইরাসটির ফিউচার বিজ্ঞানীরা এখনো জানে না। বিশ্বের নামকরা চিকিৎসকরা ও এ ভাইরাসের চিকিৎসা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ ও হুমকির মুখে।
এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের দেওয়া নির্দেশনা ও পরামর্শ আমাদের জন্য পালনীয়। সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে চলার পাশাপাশি এ ভাইরাস প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি দরকার আত্ন-সচেতনতা।
এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন না মানলে ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনবে দেশ ও দশের জন্য। বয়সভেদে সাধারণ অবস্থায় বয়স্কদের জন্য এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি বেশি। বর্তমান সময়ে এ ভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত কিছু বিভ্রান্তকর ও মিথ্যা তথ্য থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। তবে মৃত্যুপুরী
এ ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর হার শতকরা ৫ জনের মতো। আক্রান্তদের অধিকাংশই এখন সুস্থ হয়ে উঠছে।
বিশেষ করে সমাজের তরুণ, যুবক-যুবতীদের সচেতনতা ও দৃঢ় মনোবল থাকলে এই ভাইরাস থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যাবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ অনেকে। তবে সর্বোপরি এ ভাইরাস প্রতিরোধে নিয়মকানুন, নির্দেশনা মেনে চলার পাশাপাশি সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষের মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে পার্থনা আবশ্যক।
[[তথ্যসূত্রঃ-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সংগৃহীত]]
লেখক:: হামিদুর রহমান।
সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান