ততক্ষণে জলহস্তি ঢুকে গেছে গ্রামে

ধরুন—সরকারের তরফ থেকে বলা হলো—দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। নদী ভরে জল উপচে পড়ার মতো অবস্থা বিরাজ করছে সবখানে। তখন আপনি অথবা আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কি করতে পারবো? কি করার ক্ষমতা আছে আমাদের। হাপিত্তেশ বাড়িয়ে মৃত্যুকে আরো কাছে ডেকে আনা ছাড়া আপাতত আর কোনো কাজ আছে বলে অন্তত আমার মনে হচ্ছে না। গোটা দুনিয়া যেখানে বড় রকমের এই মুসিবত নিয়ে অস্থির তখন আমি বা আমরা কম্বলের লোম বাচা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। উনি কী বললেন, ইনি কী বললেন। সরকার তথ্য গোপন করছে। আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা জানাচ্ছে না। মৃতের হিসেব দিচ্ছে না। সংবাদপত্রগুলো পোষ্য হয়ে গেছে। এরকম আজগুবি হাজারো কথা, হাজারো বাজে প্রলাপ মুখে মুখে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রচার করে বেড়াচ্ছি। প্রশ্ন—এসব করে লাভ কী হচ্ছে? দিন শেষে আমরা কী অর্জন করছি? এ প্রশ্ন কী আমরা একবারও নিজেকে করেছি? করিনি! একবার ভাবুন তো এসব দোষা-দোষীর ভেতর দিয়ে আমরা কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছি বা এর পরিণতি কী?—এসবের একটা ভয়াবহ খারাপ দিক রয়েছে। যা পুরো জাতিকে আরো কঠিন পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সে দিকে আমরা মোটেও ভ্রুক্ষেপ করছি না।

আমাদের বোঝা উচিৎ ছিলো—সমস্ত দুনিয়া এক ভয়াবহ মুসিবতের ভিতর দিয়ে সময় পার করছে। শুধু মুসিবত নয় মহামুসিবত। এই মুসিবত অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নয়। এই মুসিবত কোনো দেশ বা জাতিগোষ্ঠীর সীমারেখা, মতাদর্শ, প্রতিষ্ঠাকল্পে সৃষ্ট মুসিবত বা দুর্যোগ নয়। এ দুর্যোগ মানুষের বেঁচে থাকা না থাকার দুর্যোগ। মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর কঠোরমত লড়াই।

যেহেতু, এ মহামারি কোনো দল বা গোষ্ঠির সৃষ্ট নয়। অথবা ধর্ম—বর্ণের লোক দেখে দেখে আক্রান্ত হবেন এমনও নয় অতএব এ ধরনের দৈবদুর্বিপাকে, সর্বজনীন বিপদের মধ্যে, সব সংকীর্ণতার ঊর্ধে থেকে এমন বিপদকে বিবেচনায় নিতে হবে। বিপদের সময় বিমূঢ়তা নয়, দরকার দক্ষতা ও মনোবল শক্ত রাখা। বিপদ-আপদ অনন্তকাল থাকেনি, থাকবেও না। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি—এই ভয়াবহ সংক্রামক রোগের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার নানা উপায় গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সরকারি, বেসরকারি এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে—করোনা-আক্রান্ত দেশ থেকে যাঁরা দেশে এসেছেন, সরকার তাঁদের বলেছে ১৪ [চৌদ্দ] দিন ঘর থেকে বের না হতে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে—কোয়ারেন্টাইন। আমরা সামাজিকভাবে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করি এবং কোয়ারেন্টাইন যাপন করি।

—চীনের উহান থেকে উৎপত্তি হওয়া এই মুসিবতটি সমস্ত চীনকে ধুমড়ে-মুচড়ে দিতে দিতে হঠাৎ যখন তাদের উঁচু দেওয়ালটি টপকে ইউরোপ-আমেরিকার রঙিন আকাশের ঝলমলে রোদকে ধুসর করতে শুরু করলো; আমরা তখন ফিডার খাওয়া শিশুর মতো বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাত, পা ছুটোছুটি করছিলাম। আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে যেতে থাকে ক্রমান্বয়ে। তখন আমরা গভীর ঘুমে; ঘুম আরও গভীর হতে থাকে। আমরা যখন সজাগ হয়েছি, ততক্ষণে জলহস্তি ঢুকে গেছে গ্রামে।

আমরা বিশ্বাস করি—দেশপ্রেম ও মনুষ্যত্ববোধ মানুষ মাত্রই থাকে। বিশেষ সময়ে, বিশেষ কোনো কাজের মাধ্যমে তা প্রকাশ পায়। এর আগেও পৃথিবীতে আরো বড়বড় দুর্যোগ এসেছিলো। প্রচুর জান-মালের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু মানুষ সেসব দুর্যোগকে জয় করেছে। আর জয় করেছে বলেই—মানুষ পৃথিবী থেকে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় নি। মানুষ একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মতো প্রাণী নয় তা প্রমাণ করেছে মানুষই। আর এটা সম্ভব হয়েছে—মানুষের মধ্যে থাকা প্রেম, মনুষ্যত্ববোধ—যা যথা সময়ে জাগ্রত হয়েছিলো বলেই। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যপারটি পুরোই ভিন্ন।—আমরা আড়াই মাস সময় পেয়েছিলাম। আড়াই মাস সময় মানে অনেক সময়। আমরা সেই সময়ের সদ্ব্যবহার করিনি। আমরা দীর্ঘ আড়াই মাস ঘুমেই কাটিয়েছি। দেশ কর্তাদের উপলব্ধি দেরিতে কাজ করেছে। এই সুযোগে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করে ফেলেছে। যা কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ বা ভালো কিছুর পরিচয় বহন করেনি। যাই হোক।—দেরিতে হলেও ঘুম ভেঙেছে। প্রেম, মনুষ্যত্ববোধও জাগ্রত হয়েছে সময়ক্ষেপণ করে। এখন কাজ হলো—অবস্থান ভেদে এই জাগ্রত হওয়া প্রেম ও মানুষ্যত্ববোধটাকে সামাজিক একটি আন্দোলনে রূপ দিয়ে তা টিকিয়ে রাখা। তবেই আমাদের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারি মোকাবেলা করে জয়ী হওয়া সম্ভব। মোটা দাগে বলতে চাই—সরকার কী করলো, বিরোধী দল কী না করলো, অমুক-তমুক কে কী করলো না করলো সে দিকে না তাকিয়ে দল, মত, পথ নির্বিশেষে এই সংকটময় মুহূর্তে সামাজিকভাবে দুর্যোগ ঠেকানোর একটা বাঁধার প্রাচীর আমাদের তৈরি করতে হবে। যে যেখানে আছি, যে অবস্থায়ি আছি সেখান থেকে বাঁধার প্রাচীর তৈরিতে শামিল হতে হবে। তবেই করোনা নামের করুণ পরিনতি থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।

যেহেতু, এ মহামারি কোনো দল বা গোষ্ঠির সৃষ্ট নয়। অথবা ধর্ম—বর্ণের লোক দেখে দেখে আক্রান্ত হবেন এমনও নয় অতএব এ ধরনের দৈবদুর্বিপাকে, সর্বজনীন বিপদের মধ্যে, সব সংকীর্ণতার ঊর্ধে থেকে এমন বিপদকে বিবেচনায় নিতে হবে। বিপদের সময় বিমূঢ়তা নয়, দরকার দক্ষতা ও মনোবল শক্ত রাখা। বিপদ-আপদ অনন্তকাল থাকেনি, থাকবেও না। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি—এই ভয়াবহ সংক্রামক রোগের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার নানা উপায় গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সরকারি, বেসরকারি এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে—করোনা-আক্রান্ত দেশ থেকে যাঁরা দেশে এসেছেন, সরকার তাঁদের বলেছে ১৪ [চৌদ্দ] দিন ঘর থেকে বের না হতে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে—কোয়ারেন্টাইন। আমরা সামাজিকভাবে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করি এবং কোয়ারেন্টাইন যাপন করি। যেহেতু জীবাণুটি অতি দ্রুত একজন থেকে অন্যদের মধ্যে ছড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়, এখনই বলা সম্ভব হবে না। পৃথিবীর অন্যান্য আক্রান্ত দেশের দিকে দৃষ্টি দিলে যা দেখা যাচ্ছে তা হলো— প্রথম সপ্তাহ থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহে, দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় সপ্তাহে, তৃতীয় থেকে চতুর্থ সপ্তাহে—এইভাবে জ্যামিতিক হারে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। যদিও সরকারি দলের নেতারা এতোই ক্ষমতাশালী যে, ‘কোনো ভাইরাস-টাইরাসকে তাঁরা পরোয়া করেন না। বিরোধী দলের এক নেতা, যিনি নিজেই দুই বছর যাবৎ দলের কার্যালয়ে একরকম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন’—এসব কথাবার্তাকে আমলে না নিয়ে বিনোদন হিসেবে নেওয়াই এখন উত্তম।

করোনা শুধু বস্তিতে যাবে—কোনো প্রাসাদে ঢুকবে না, এমন নয়। বস্তির মানুষ আর অট্টালিকার মানুষ সমান সুবিধা ও চিকিৎসা পাবেন তাও আশা করছি না।—নদীপাড়ে বাসিন্দা ও ভাসমান মানুষের সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, কোভিড-১৯ সম্পর্কে তো থাকার প্রশ্নই ওঠে না। হোম কোয়ারেন্টাইনসহ যেসব বিধি-নিষেধ মেনে চলার জন্য বলা হচ্ছে, তা মেনে চলা তাদের পক্ষে কতটুকু সম্ভব সেটিও প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যপার। সুতরাং দেশের সকল শ্রেণি-পেশার বাসিন্দাদের স্বার্থে কম জ্ঞানী, বেশি জ্ঞানী, সরকারি লোক, বেসরকারি লোক, বস্তিবাসী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, খেটে-খাওয়া মানুষ, তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী, গৃহকর্মী, দিনমজুর, খবরের কাগজ বিক্রেতাসহ সব লোকের জন্য সামাজিকভাবেই আমাদের ভাবতে হবে। এবং তা এখনই।

মুজাহিদ আহমদ, কবি ও সাংবাদিক

কৃতজ্ঞতায়: আইনিউজ

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 

আরও সংবাদ