মানুষই আসে মানুষের তরে

 

বেলজিয়ান সিনিয়র সিটিজেন সুজান হয়লার্টস। বয়স নব্বই বছর। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষের মতো তিনিও করোনা ভাইরাসে [কোভিড ১৯] আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু শর্টেজ ভেন্টিলেটরের কারণে তিনি ডাক্তারকে বললেন—‘এই যন্ত্রটি তাকে দাও যার জীবনপথ অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে। যাকে পৃথিবীর প্রয়োজন। পৃথিবীকে দেবার তার অনেক কিছু আছে। স্রষ্টা আমাদের উপর কিছু দায়িত্ব অর্পণ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কম বয়সীরা এখন সেই দায়িত্ব পালনের সময় এসেছে। এই যন্ত্রটি আমার জন্য নয়।’ তবুও চিকিৎসকরা তাকে ভেন্টিলেটেড করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সুজান তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, —’Save it (Ventilator) for youngest who need it most. I have already had a beautiful life!’ অবিশ্বাস্য রকমে এই বড় মনের মানুষটি সুন্দর পৃথিবীটা ছেড়ে চলে গেছেন গত ২২ মার্চ । তাঁর এই চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে কী ম্যাসেজ দিয়ে গেলেন পৃথিবীবাসীকে?—ভাবুন তো! এ নিয়ে ভাববার কী সময় আছে আমাদের হাতে?

এই লেখাটি যখন তৈরি হচ্ছে—[৪ এপ্রিল ২০২০] তখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসটি [কোভিড-১৯] বিশ্বের ২০৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং দশ লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে গেছেন। এদের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ঊনষাট হাজারেরও বেশি মানুষ। একটু ভাবুন তো এই ভয়বহতা নিয়ে। এই ভয়াবহতা কত দ্রুত আরো করুণ পরিনতির দিকে যাচ্ছে, পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে।—ক্ষণে ক্ষনেই বাড়ছে আক্রান্তের সংক্ষ্যা, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। কিন্তু বিপর্যস্ত; অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর অন্ধকার আকাশের মাঝে এক চিলতে হলেও আশার আলো হলো—মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ঠিকই, পাশাপাশি সুস্থ হয়ে হাসি মুখে ঘরেও ফিরছেন। ব্যপক পরিমাণের আক্রান্তের মাঝে দুই লাখ ঊনত্রিশ হাজারের চেয়ে বেশি মানুষ ভাইরাসটির সাথে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন। ঘরে ফিরে স্বাভাবিক জীবন শুরু করেছে। আমাদের দেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়েছে ৮ মার্চ ২০২০। এরপর থেকে দিনে দিনে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী—এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা সত্তর জন। মারা গেছেন আট জন। সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন ত্রিশ জন।—ঢাকায় শনাক্ত হয়েছেন ছত্রিশ জন।মিরপুরের নয় জন, মিরপুরের মনিপুরে পাঁচ জন, সেনপাড়ায় দুজন, মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বর এলাকায় একজন করে রোগী আছেন। বাসাবোয় চার জন, বাংলাবাজারে তিন জন, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, হাজারীবাগ, মগবাজার, উত্তরা ও উত্তরখানে দুজন করে রোগী আছেন। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী, আজিমপুর, কলাবাগান, রামপুরা, মহাখালী, বনানী-গুলশান, বারিধারা ও খিলক্ষেত এলাকায় একজন করে রোগী আছেন।—আক্রান্তদের মধ্যে নারীর তুলানায় পুরুষের সংখ্যাই বেশি। ঢাকার বাইরে দেশের ১০টি জেলায় এখন পর্যন্ত করোনা [কোভিড-১৯] ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। ঢাকায় আক্রান্ত হয়েছেন ছত্রিশ জন। মাদারীপুর জেলায় দশ জন, নারায়ণগঞ্জ জেলায় চার জন, গাইবান্ধা জেলায় চার জন। এ ছাড়া গাজীপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা ও রংপুর জেলায় একজন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন।—দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ ২০২০। তিনি মাদারীপুরের বাসিন্দা। এরপর রোগী শনাক্ত হয় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে।—প্রাথমিক অবস্থায় এটি বিদেশ ফেরত ও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমেই তা স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি ব্রিফিংয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন—করোনা ভাইরাসে [কোভিড-১৯] আক্রান্ত কয়েক জনের সংক্রমণের উৎস পাওয়া যায়নি। ভাইরাসটি স্থানীয় পর্যায়ে ছড়ালেও তা খুবই কম মাত্রার বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সাধারণত সংক্রমণের উৎস পাওয়া না গেলে এটিকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলা হয়। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ষোল জন বিদেশ ফেরত। মূলত তাদের মাধ্যমে দেশে করোনার সংক্রমণ ঘটেছে। বিদেশ ফেরতদের মধ্যে ইতালির ছয় জন, যুক্তরাষ্ট্রের তিন জন, সৌদি আরবের দুজন এবং ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি, কুয়েত ও বাহরাইনের একজন। করোনাভাইরাসের [কোভিড-১৯] বিস্তার ঠেকাতে সরকার প্রথমে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে পরে এই ছুটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।ছুটির সময়ে অফিস-আদালত থেকে গণপরিবহন, সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।—যদিও কাঁচাবাজার, খাবার, ওষুধের দোকান, হাসপাতাল, জরুরি সেবা এই বন্ধের বাইরে থাকছে। কৌতুহলী জনগণকে ঘরে রাখতে মোতায়েন করা হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। যদিও সশস্ত্র বাহিনী আসলেই রাস্তায় আছে কি না দেখার জন্য আমরা রাস্তায় বের হচ্ছি।

‘এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!’ —১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৬ই জ্যৈষ্ঠ কৃষ্ণনগরে বসে কবি যখন এই চরণটি বাঁধছিলেন তখন কী তিনি গুণাক্ষরেও অনুধাবন করেছিলেন—করোনাভাইরাসের [কোভিড-১৯] প্রকোপে কাঁপা বিপর্যস্ত মানুষগুলো ১৪২৬ বঙ্গাব্দে এসে এই চরণ থেকে উজ্জীবিত হয়ে করোনার [কোভিড-১৯] বিরুদ্ধে লড়বে! আমার তো মনে হয় না। বাংলাদেশের মানুষ আজ করোনার ভারী তুফান মোকাবেলা করছে। বিশ্বাস রইল, বাংলাদেশের মানুষ সাহসের সাথে, সম্মিলিতভাবে পার করবে—‘করোনাকাল’। বাংলাদেশের জনগন মনোবল হারাবেন না। মানসিকভাবে একে অন্যের পাশে থেকে করোনা জয় করবে। এবং তা সম্ভব।

করোনা ভাইরাস [কোভিড-১৯] ছড়ানো প্রতিরোধে সরকার ছুটি ঘোষণা করার পর—লোকজন যেভাবে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলো, যেনো ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরছেন। লঞ্চ-স্টিমার, রেলগাড়ি, বাস-মিনিবাস বোঝাইয়ের যে দৃশ্য চোখে ভাসে—এখনো গা কাঁটা দিয়ে উঠে। আবার উল্টোদিকের কথা— এর বাইরে তো আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। কী করবে মানুষজন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের লকডাউনের প্রথম দিনের দৃশ্য তো ছিলো ভয়াবহ। ছুটি ঘোষণার পর বাংলাদেশের জনসংখ্যার বেশ বড় একটা অংশের মধ্যে ব্যপক নাড়াছাড়া হয়েছে। এদিকের মানুষ ঐদিকে, ঐদিকের মানুষ এইদিকে। গ্রামের মানুষ শহরে, শহরের মানুষ গ্রামে। সর্বোপরি রাজধানীর মানুষ সারা দেশে।—এই হুড়মোড়ি খাওয়া লোকগুলোর কিংবা তাদের স্পর্শে এসে দেশের মানুষের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি না হোক, আপাতত এটাই কামনা করা ছাড়া আর কোনো উত্তম দিক নেই।

‘মানুষ মানুষের জন্যে’—এই লাইনটিও এর আগে সংখ্যাতীতবার ব্যবহৃত হয়েছে। এই করোনাকালেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বাঙালি এই চরণটিরও আবেদন অনুধাবন করেছে অন্তর থেকে। তারই ফলদৃষ্ঠে আমরা দেখি—লকডাউনের মতো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সময়ে মানুষই আরেকটি রুজি-রোজগারহীন মানুষের দরজার সামনে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় কড়া নাড়ছেন—‘খাবার নিয়ে এসেছি, দরজা খুলুন’। ‘পড়িমরি’ অবস্থায় দরজা খুলে—চাল, ডাল, আলু, তেল, সাবানের পুটলি গ্রহণ করছেন। বিত্তবান এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন। অনেকজন এক সাথে মিলে তহবিল করছেন—খাদ্যসামগ্রী কিনে পুটলি বেঁধে ঘরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন—এই ছবিগুলো আশার ফুল ফুটাচ্ছে। এ ফুল ফুটবে যুগে যুগে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া এমন অনেকের নাম বলা যাবে যারা—নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলছেন এবং একটু অবস্থা সম্পন্ন আত্মীয়-স্বজনের কাছে থেকে সহায়তা নিয়ে খাদ্য কিনছেন এবং তারা শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন। উপার্জনহীন অবস্থায় যারা রয়েছেন, তাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন। ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা নিজ হাতে সেনিটাইজার তৈরি বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন—এটা কী কম কথা? মোটেই না। রাষ্ট্র তার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। আরো ভালো খবর হচ্ছে—বাংলাদেশ পুলিশ তাঁদের একদিনের বেতন [২ লাখ ১০ হাজার] এবং সহকারী পুলিশ সুপার থেকে আইজিপি পর্যন্ত সকলের বৈশাখী ভাতার বিশ কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে জমা দিয়েছেন। যা ব্যয় হবে করোনায় আক্রান্ত এবং এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যে। স্থানীয়ভাবেও পুলিশ সদস্যরা তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে মানুষের কাছে থাকতে চাচ্ছেন—এই দুর্দিনে। একই সাথে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রকৌশলী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক সাংস্কৃতিক কর্মী, প্রবাসী, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, গৃহিনী, ছাত্র সংগঠকসহ—সকলেই হাত বাড়িয়েছেন—অসহায়, কর্মহীন মানুষের দিকে। খেটেখাওয়া মানুষ যে যেখানে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাঁদের কাছে যেতে চেষ্টা করছেন সহায়তা নিয়ে, তাঁদের কথা তারা ভুলে যান নি। সাধ্যমত খাদ্যসামগ্রী নিয়ে সচেষ্ট রয়েছে যার যার জায়গা থেকে। এ তো হলো স্থানীয় চিত্র। জাতীয়ভাবেও সরকারি প্রচেষ্টার বাইরে অনেকেই অনেকভাবে এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন। এই মানবিকতা অব্যহত রাখতে হবে দুর্যোগ ও দুর্যোগপরবর্তী পুনর্বাসন পর্যন্ত। তবেই বেলজিয়ান সিনিয়র সিটিজেন সুজান হয়লার্টস-এর রেখে যাওয়া বার্তাটি আমরা যথাযথ অনুধাবন করতে পেরেছি এ দাবি করতে পারবো।

মোটকথা—মানুষই আসে মানুষের তরে, যুগে যুগে। সুতরাং আমরা আশায় বুক বাঁধতেই পারি করোনা আমাদের খুব বড় ধরণের ধাক্কা দিতে পারবে না। আমরাই করোনাকে ধাক্কা দেবো জোরেসোরে। সকলের প্রচেষ্টায়। মানুষের জয় হোক।

মুজাহিদ আহমদ,
কবি ও সাংবাদিক

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 

আরও সংবাদ