উপার্জন বন্ধ; কিন্তু থমকে যায়নি মনা মিয়ার মানবসেবা
একজন দিনমজুর হিসেবেও মানব সেবা করে যাচ্ছেন মনা মিয়া জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে । মহামারী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবে তার আয় রোজগার সব এখন বন্ধ। না খেয়ে কোনমতে দিন পার করছেন মনা মিয়া, কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়া এই সংকট মূহুর্তে মানবসেবা করেই যাচ্ছেন। সকাল ৮ টা থেকে রাত ১ টা। একটানা ১৭ ঘন্টা তিনি রাস্তায় থাকেন। চলাচলকারী প্রতিটি গাড়িতে জীবাণুণাশক স্প্রে ছিটিয়ে দেন।
মনা মিয়ার বাড়ি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন ফুলতলায়।পুরো উপজেলা জুড়ে সে একজন মানব সেবক হিসেবে পরিচিত। সে মৃত সুফি সাহেবের ছেলে। বর্তমানে পরিস্থিতিতে ভাইরাস প্রতিরোধ করতে বিশ্বের অনেক দেশেই লকডাউন করা হয়েছে। বাংলাদেশও চলছে সাধারণ ছুটি। এখন অনেকটা লকডাউনের মতো পরিস্থিতি। তবে বিভিন্ন জেলাও বিভাগ একের পর এক লকডাউন করা হচ্ছে। গত ১৩ এপ্রিল সিলেটর অন্যান্য জেলার মতো মৌলভীবাজারও লকডাউন ঘোষনা কর হয়। ঠিক এই সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছেন দিনমজুর এই মনা মিয়া।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, ফুলতলা ইউনিয়নের প্রবেশমুখে অর্থাৎ প্রধান সড়কে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধের জন্য স্থানীয়দের উদ্যোগে গেইট দেওয়া হয়েছে। সেই গেইটে মনা মিয়া দিন-রাত কষ্ট করে এখানে পাহারা দিচ্ছেন। এসময় যানবাহন প্রবেশের সময় প্রতিটি গাড়ীতে জীবাণুণাশক স্প্রে ছিটিয়ে দিচ্ছেন।
তার এই মানবসেবা দেখে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। পাশাপাশি সরকার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে অনুরোধ করছেন তাকে যেনো সহযোগিতা করা হয়।
মনা মিয়ার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম। রেস্টুরেন্টে বন্ধ হওয়ায় এখনতো আর কোনো কাম কাজ নাই। পুরোদিনই বাড়িতে বেকার বসে থাকতে হয়। তাই এই কাজটি মানবসেবা হিসেবে বেছে নিলাম। আমি প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে রাত বারোটা, একটা পর্যন্ত এখানে থাকি।
তিনি জানান, ইউনিয়নের পাশেই তার বাড়ি। অনেকদিন হচ্ছে তার বাবা সুফি সাহেব না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার এক সন্তান, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে কোনোমতে দিন পার করছেন। তিনি রেস্টুরেন্টে থেকে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে কোনোমতে চলা যেতো। কিন্তু করোনার কারনে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা এখন গৃহবন্দী। মনা মিয়া অন্য কোনো কাজও করতে পারছেন না। তাই কিছু না করতে পেরে নেমেছেন মানবসেবায়। এই মূহুর্তে তার কাছে কোনো টাকাও নেই। ঘরের সঞ্চিত খাবারও শেষ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ফুলতলা ইউনিয়ন থেকে আমাকে এই জীবাণুনাশক স্প্রে গুলা দেওয়া হয়েছে। রাস্তাদিয়ে যেসকল গাড়ী যায় সকল গাড়ীর পুরো বডিতে বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই জীবাণুনাশক স্প্রে করি। তরপর পাহারা দেই বহিরাগত কেউ যাতে না ডুকে। আমি অনেক বহিরাগতকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত কয়েকদিন আগে ইউনিয়ন থেকে ৩ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ডাল ২ কেজি ও ১ টি সাবান। তা দিয়েতো দুই একদিন চলা যাবে। কিন্তু পরে কি করবো? এরপর কেউ আর খোঁজ নেয়নি তার এবং তার পরিবারের। এ কারণে বাড়ির সবাই ঘরে বসেই থাকেন খাবারের অপেক্ষায়।
ফুলতলা ইউনিয়নের বাসিন্দা রহমান বলেন, মনারাই এই দেশের সুনাগরিক। দেশের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য, অাইনের প্রতি শ্রদ্ধা, দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। কিন্তু দেশের সুসময়ে অধিকার পেতে ব্যর্থ তবুও দেশের দু:সময়ে তারাই অগ্রসারিতে।
পার্শ্ববর্তী এলাকার আহসান তামিম বলেন, পেশায় তিনি একজন দিনমজুর মানুষ। এই মানুষটি নিঃস্বার্থভাবে এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে সত্যিই অতুলনীয়। সকলের কাছে শুধু একটিই চাওয়া বিপদের সময় মনাদের মত যে সমস্ত মানুষেরা আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে পরবর্তী সময়ে আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই।
ফুলতলা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোঃ মাসুক আহমদ বলেন, ইউনিয়নে জন্য সে ভালো একটি কাজ করে যাচ্ছে। সত্যিই প্রশংসনীয়। আবারও দ্রুত আমি ত্রাণের ব্যবস্থা করছি তার জন্য।
ফুলতলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইমতিয়াজ গফুর মারুফ বলেন, মনা মিয়ার বিষয়ে আমি অবগত আছি। কারন সে ইউনিয়নের জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটাইতেছে, এলাকার লকডাউন গেইট পাহারা দিচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিষদের ত্রাণ তো সীমিত। সে কারনে সেভাবে সহযোগিতা করা যাচ্ছে না। তারপরও যে সময়ই ত্রাণ আসে তাকে আমরা ত্রাণ দিচ্ছি।
এশিয়াবিডি/মারুফ/কামরান

