রামাদ্বান : আমাদের করণীয়
রাহমাত, বারাকাত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাহিনা পবিত্র মাহে রামাদ্বানের ফরয রোজা রাখার পাশাপাশি আমাদের আরো কিছু করণীয় রয়েছে যেগুলো কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ।
রামাদ্বান মাসকে সম্মান করাঃ
আল্লাহ তায়ালার গননায় বারটি মাসের মধ্যে অন্যতম সম্মানীত মাস হচ্ছে পবিত্র রামাদ্বান। আর সম্মানী কোন কিছুকে সম্মান করতেই হয়। এটা ইসলামী শরীয়তের অন্যতম নীতি। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা হজ্জের ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
ذٰلِکَ – وَمَنۡ یُّعَظِّمۡ شَعَآئِرَ اللّٰہِ فَاِنَّہَا مِنۡ تَقۡوَی الۡقُلُوۡبِ.
“এটাই হল আল্লাহর বিধান, যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই”।
সুতরাং এই মাসে যদি কেউ কোন কারণে রোজা নাও রাখতে পারেন তাহলে সম্মান প্রদর্শন করার জন্য রোজাদারের সামনে না খাওয়া উত্তম। আর বিশেষ করে এই মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাই হবে তাকওয়ার পরিচয়।
রোজা রাখাঃ
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে রামাদ্বান মাসের রোজা রাখা। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয করে দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে এসেছে-
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ.
“হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর”।
রোজার অনেক ফজিলত রয়েছে। হাদিস শরীফের মধ্যে এসেছে রোজার বদলা আল্লাহ নিজ হাতে দিবেন। এমনকি রোজাদারের জন্য জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে যেটা দিয়ে সে জানাতে প্রবেশ করবে।
বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে-
عَنْ سَهْلٍ رضى الله عنه قال – قال رسول الله (ﷺ) إِنَّ فِي الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَقُومُونَ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ.
“হযরত সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোজা পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে, রোজা পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে”।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত রোজা থাকাঃ
আমরা অনেকেই মনে করি যে, দিনের বেলায় উপোস করার নাম রোজা। আসলে প্রকৃত পক্ষে শুধু উপোস থাকার নাম রোজা নয়। বরং উপোস থাকার পাশাপাশি আপনার সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গের রোজা আছে। যেমন, হাত, চোখ, কান, জবান ও পায়ের রোজা ইত্যাদি। এই সবকিছুকে আপনি খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। যেহেতু রোজার অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। এমনকি রামাদ্বান মাসে দিনের বেলায় অনেক হালাল কাজও হারাম হয়ে যায়। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে-
عن ابى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قال – قال رسول الله (ﷺ) – قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ فَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ يَوْمَئِذٍ وَلاَ يَسْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ.
“আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- মানব সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের সওয়াব দশ গুন থেকে সাতশ গুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, আদম সন্তানের যাবতীয় আমাল তার নিজের জন্য কিন্ত রোজা বিশেষ করে আমার জন্যই রাখা হয়। আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। রোজা পালনকারীর জন্য তা ঢাল স্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারো রোজার দিন আসে সে যেন ঐ দিন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে বিবাদ করতে চায়, সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার”।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে আরো এসেছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ.
“হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই”।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করাঃ
একজন মানুষ ঈমান আনার পর ইসলামী শরীয়তে যে কাজটি তাকে প্রথম করার নির্দেশ দেয়, সেটা হচ্ছে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। এই বিষয়ে কুরআন শরীফে সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে। এবং হাদিসের কিতাবে অসংখ্য হাদিস রয়েছে।
সুতরাং রামাদ্বান মাস যেহেতু একটা সম্মানিত মাস এবং এ মাসে একটা সাওয়াবের বদলা অন্য মাসের চাইতে সত্তর গুন বেশি তাই আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার চেষ্টা করব।
তাকওয়া অর্জন করাঃ
সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত ধারা রোজা ফরয করে আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন কেন এটা ফরয করেছেন? যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- (لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ) যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। সুতরাং এই মাস হচ্ছে মুমিন মাসলমানের তাকওয়া অর্জন করার অন্যতম একটি সুযোগ।
অপচয় না করাঃ
অপচয় ও অপব্যয় একটি খারাপ অভ্যাস ও নিন্দনীয় কাজ। অপচয়ের সঙ্গে রয়েছে অহংকারের সম্পর্ক। নিজের বাহাদুরি প্রকাশের মনোভাব। অন্যদিকে অপব্যয়ের সঙ্গে রয়েছে শরিয়তের বিধান লঙ্ঘনের সম্পর্ক। অপচয় ও অপব্যয় মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অবক্ষয় ডেকে আনে। যে কারণে ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় দুটিই নিষিদ্ধ। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী কোনো কাজ বৈধ হলেও সে ক্ষেত্রেও যদি প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় করা হয় তবে তাকে ইসরাফ বা অপচয় হিসেবে দেখা হয়। ইসলাম বৈধ কাজেও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় সমর্থন করে না। অবৈধ কাজে ব্যয় করাকে অপব্যয় বলা হয়। অপচয় করা শয়তানের কাজে। যেমন মহান আল্লাহ পবিত্র কালামের সূরা বনী ইসরাঈলের ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন-
وَءَاتِ ذَا الْقُرْبٰى حَقَّهُۥ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا – إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوٓا إِخْوٰنَ الشَّيٰطِينِ ۖ وَكَانَ الشَّيْطٰنُ لِرَبِّهِۦ كَفُورًا.
“নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ।আর আত্মীয়কে তার হক দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। আর কোনভাবেই অপব্যয় করো না”।
মহান আল্লাহ বলেন হে আমার বান্দারা তোমরা
খাও, পান কর ও অপচয় করো না। যেমন এ সম্পর্কে সূরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
يٰبَنِىٓ ءَادَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوٓا ۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ.
“হে বনী আদম, তোমরা প্রতি সালাতে তোমাদের বেশ-ভূষা গ্রহণ কর এবং খাও, পান কর ও অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না”।
ইসলামে অপচয়-অপব্যয়ের পাশাপাশি কৃপণতারও বিরোধিতা করা হয়েছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা অনুসরণকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
মধ্যবর্তী অবস্থানে থেকে সবগুলো কাজ করা মুমিনের অন্যতম একটি গুণ। যেমন পবিত্র কালামে সূরা ফুরকানের ৬৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَالَّذِينَ إِذَآ أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا.
“আর তারা যখন ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না। বরং মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে”।
সাহরী ও ইফতারঃ
রামাদ্বান মাসের রোজা রাখার নিয়তে সাহরী খাওয়া ও সময়মতো ইফতার করা অন্যতম একটি সুন্নাত।
মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে-
عَنْ أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ – قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السُّحُورِ بَرَكَةً.
“হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- তোমরা সাহরী খাও, সাহরীতে বারাকাত রয়েছে”।
মুসলিম শরীফের আরেক হাদিসে এসেছে-
عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ رضى الله عنهما قال – قال رسول الله (ﷺ) فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَرِ.
“হযরত আমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- আমাদের ও কিতাবীদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া”।
মুসলিম শরীফের অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে-
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ رضى الله عنهما قال – قال رسول الله (ﷺ) لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ.
“হযরত সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- যতদিন মানুষ বিলম্ব না করে ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে”।
তারাবীর নামাজ আদায় করাঃ
রামাদ্বান মাসে তারাবীর নামাজ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে অনেক হাদিস পাওয়া যায়। তাই যারা সুস্থ আছেন তারা সবাই প্রতিদিন বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করা উত্তম হবে। এর ফজিলত সম্পর্কে বুখারী শরীফে এসেছে-
عن هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لِرَمَضَانَ “ مَنْ قَامَهُ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
“আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলুল্লাহু (ﷺ) কে রামাদ্বান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রামাদ্বানে ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রামাদ্বান অর্থাৎ তারাবীর নামাজ আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে”।
কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করাঃ
রামাদ্বান মাস হচ্ছে কুরআনুল কারীম অবতীর্ণের মাস। আর এই মাসে রাসূল (ﷺ) বেশি বেশি তা তেলাওয়াত করতেন। সুতরাং আমরাও যেন সেটাই করি। সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ.
“রামাদ্বান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে”।
কুরআনুল কারীম তেলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে-
عَنْ أَبي أُمَامَةَ رضي الله عنه قال – قال رسول الله اقْرَؤُوا القُرْآنَ – فَإِنَّهُ يَأتِي يَوْمَ القِيَامَةِ شَفِيعاً لأَصْحَابِهِ.
“হযরত আবূ উমামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু (ﷺ) বলেছেন- তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ কর । কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে”।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়াঃ
নফল নামাজ সমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামাজ। রাসূল (ﷺ) এ নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন। কুরআনুল কারীমের সূরা বনী ইসরাঈলের ৭৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
وَ مِنَ الَّیۡلِ فَتَہَجَّدۡ بِہٖ نَافِلَۃً لَّکَ ٭ۖ عَسٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَکَ رَبُّکَ مَقَامًا مَّحۡمُوۡدًا.
“আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় কর তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন”।
সূরা মুযাম্মিলের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-
قُمِ اللَّيْلَ إِلاَّ قَلِيلا – نِصْفَهُ أَوِ انقُصْ مِنْهُ قَلِيلا.
“রাতে নামাজে দাঁড়াও কিছু অংশ ছাড়া। রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কিছুটা কম”।
মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে-
عن أَبِي هُرَيرَةَ رضي الله عنه قَالَ – قَالَ رَسُولُ اللهِ (ﷺ) أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ – شَهْرُ اللهِ المُحَرَّمُ – وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الفَرِيضَةِ – صَلاَةُ اللَّيْلِ.
“হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন- ররামাদ্বানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা এবং ফরয নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হচ্ছে রাতের নামাজ”।
সাদাকাহ করাঃ
আল্লাহর রাস্তায় দান করার অনেক ফজিলত রয়েছে। আর সেটা যদি রামাদ্বান মাসে করা যায় তাহলে তার সাওয়াব সত্তর গুন বেশি পাওয়া যাবে ইনশা আল্লাহ। দান করীদের সম্পর্কে সূরা বাকারার ২৬১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
مَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَہُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ کَمَثَلِ حَبَّۃٍ اَنۡۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ فِیۡ کُلِّ سُنۡۢبُلَۃٍ مِّائَۃُ حَبَّۃٍ ؕ وَ اللّٰہُ یُضٰعِفُ لِمَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ.
“যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ”।
আল্লাহর রাস্তায় দান করলে পাহাড় পরিমান সাওয়াব পাওয়া যাবে। যেমন বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে-
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قَالَ رَسُولُ اللهِ (ﷺ) مَنْ تَصَدَّقَ بعَدلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ، وَلاَ يَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيبَ، فَإنَّ اللهَ يَقْبَلُهَا بِيَمِينِهِ، ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهَا كَمَا يُرَبِّي أحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُونَ مِثْلَ الجَبَلِ.
“হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- যে ব্যক্তি (তার) বৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ থেকে একটি খেজুর পরিমাণও কিছু দান করে, আর আল্লাহ তো বৈধ অর্থ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণই করেন না, সে ব্যক্তির ঐ দানকে আল্লাহ ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর তা ঐ ব্যক্তির জন্য লালন-পালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ তার অশ্ব-শাবককে লালন-পালন করে থাকে। পরিশেষে তা পাহাড়ের মত হয়ে যায়”।
ইতিকাফ করাঃ
রামাদ্বান মাসে ইতিকাফ করা রাসূল (ﷺ) এর অন্যতম একটি আমল ছিল। আর এটা আমাদের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। তাই সময় সুযোগ থাকলে এটা করা অনেক সাওয়াবের কাজ হবে।
বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে-
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ.
“হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্নু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) রামাদ্বানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন”।
লাইলাতুল কদর তালাশ করাঃ
এই রাত সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে সূরা কদর নামে একটি সূরাই আল্লাহ নাযিল করেছেন। সেই সূরার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ۬ۙ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَہۡرٍ.
“লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম”।
ইবনে মাজাহ ও তিরমিজী শরীফের হাদিসে এসেছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله قَالَ – قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) - مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
“আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশা যে লোক লাইলাতুল কাদরের (ইবাদাতের জন্য) রাতে জেগে থাকে, তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়”।
সাদাকাতুল ফিতর আদায় করাঃ
ঈদের নামাজের আগেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما قَالَ فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ عَلَى الْعَبْدِ وَالْحُرِّ، وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى، وَالصَّغِيرِ وَالْكَبِيرِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ.
“হযরত ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রত্যক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতের বের হবার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন”।
সর্বোপরিঃ
এই মাস হচ্ছে দোয়া কবুলের মাস। তাই ফরয রোজা, ফরয নামাজ ও নফল ইবাদত করার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে জীবনের সব গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। এবং জাহান্নম থেকে মুক্তি চেয়ে জান্নাত কামনা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রামাদ্বানের রোজাগুলো রাখার পাশাপাশি সকল নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)
লেখক- ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মসজিদ, যুক্তরাজ্য
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

