বসন্ত বৃষ্টি

রূপে, গুনে, ব্যাক্তিত্বে অতুলনীয় সৃষ্টিকে সেই ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি। কিন্তু এ বসন্তের শুরুতে যখন থাকে দেখলাম বাসন্তি শাড়ীতে তখন প্রেমে পড়া থেকে নিজেকে কিছুতেই রক্ষা করতে পারলাম না। দু’জনের সব ব্যবধান ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে গেল মন- আমি প্রেমে পড়লাম, প্রেমিক হলাম।
সুন্দরী মেয়েরা যেমন একটু রহস্যময়ী হয় সেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তবে তার মধ্যে আলাদা একটা কিছু ছিল যা আমার কাছে অস্পষ্ট। আর সেই অস্পষ্ট উপাদানটা-ই আমাকে তার প্রতি হঠাৎ করে দূর্বল করে দিল এবং ক্ষণে ক্ষণে প্রচন্ড গতিতে বাড়তে লাগল। কিন্তু যখনই ভেবেছি প্রেমের ডালি সাজিয়ে নিয়ে তার সামনে দাড়াব ঠিক তখনই দৃশ্যত অসমতা দেয়াল হয়ে দাড়িয়ে গেল।

শহরের একদম পূর্ব প্রান্তে আমাদের দুই পরিবারের পাশাপাশি বসবাস। ব্যবসায়ী বদমেজাজী বাবার আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকায় সৃষ্টি থাকে আর সেই অট্টালিকায় ছায়ায় পড়ে থাকা টিনসেড একটা বাড়িতে আমার মাকে নিয়ে আমি থাকি। ওটা আমাদের পৈত্তিক সম্পত্তি। শুধুমাত্র মায়ের চাকুরীর সুবাদে আমাদের সংসারটা টেনে-টোনে চলে। নিজে লেখাপড়া শেষ করে সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সার্টিফিকেটের বোঝা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। হচ্ছে হচ্ছে বলে কিছুই হচ্ছে না।

এই করুণ অবস্থায় বড় অসময়েই প্রেম এল আমার জীবনে। সৃষ্টির জন্য হঠাৎ করেই কেমন যেন একটা অজানা শিহরণ বহিতে লাগল আমার অন্তরাত্মা জুড়ে। অথচ অবুঝ থেকে সবুজ হয়ে গেছি গত আটাশ বসন্তে একটি বারও সেরকম অনুভূতি হয়নি। আর সেই ছোট সৃষ্টি বাইশ বসন্ত ছোঁয়ে তেইশ বসন্তে দাড়িয়ে এমন এক দৃষ্টি দিল আমার প্রতি যার রেশ রক্তে বিচরণ করতে লাগল মাতালের মত। কিন্তু সে তো আমার নাকের ডগাতেই ছিল এতকাল। কখনো তো স্বপ্নেও আসেনি। তবে হঠাৎ করে কেন যে এ বসন্তে এমন হল- কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।

ছোট থেকে দু’জনের কখনো মেশা হয়নি একমাত্র আমার দিন্যতার কারণে। দৃশ্যত ব্যবধানে দুই পরিবার বরাবরই অনেকটা দূর দিয়ে চলাফেরা করত। সৃষ্টির বাবার একটা লোভ অবশ্য ছিল আমাদের বাড়িটার প্রতি। তাই আমার বাবাকে কম যন্ত্রণা সহ্য হয়নি। তখন অবুঝ হলেও ততটা অবুঝ ছিলাম না। তাই সেই সময়ে বাবার মৃত্যু আমার কচি মনে গভীর একটা দাগ কেটেছিল।

অবশ্য বাবা মারা যাওয়ার পর রহস্যময় কারণে ভদ্রলোক লোভটা সামনে নেন। হয়তো আমাদের অসহায়ত্ব তাকে একটু ভাবিয়েছিল। সেই থেকেই আমরা পড়ে আছি যার যার মত। তবে রাস্তায় দেখা হলে ভদ্রলোককে সালাম না দেওয়ার মত অভদ্রতা আমার মা আমাকে শেখাননি। কিন্তু ভদ্রলোক ভুলেও একদিন আমাদের কোশলাদি জিজ্ঞাস করেননি। সৃষ্টি অবশ্য সে রকম ছিল না। দেখা হলেই মায়ের খোজ খবর নিত।
সৃষ্টি যখন লাল মারুতিতে চড়ে চলে যেত আমি তখন ফুটপাত ধরে হাটতাম। সাহসগুলো থমকে যেত। যখন আমাদের বাড়ির ভাঙা গেটে দাড়িয়ে তাদের অট্টালিকার চূড়া দেখার আশায় ঘাড় বাকা করে আকাশ পানে তাকাতাম তখন ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথার উৎপত্তি হত। সাথে সাথে আমার এ বসন্ত প্রেম চুপসে যেত। মাঝে মাঝে এ ভাবনাও উকি দিত মনে- সৃষ্টিদের প্রাসাদের জন্য সারাটা শীতকাল আমরা রোদহীন থাকতাম। সূর্যটাকে আড়াল করে রেখে দিত তাদের বাড়িটা। তবুও সাহসী হতে চাইতাম।

সৃষ্টি গিটার প্রিয় ছিল তা আগে না জানলেও সেদিনই প্রথম জানলাম। নতুন একটা গিটার কিনে যখন মার্কেট থেকে বের হচ্ছি ঠিক তখন হঠাৎ করেই তার সাথে দেখা হয়ে গেল। আমার হাতে গিটার দেখে সে আগ্রহী হলে দুজনে কথা হল। শেষে তার গাড়ীতে আমাকে লিফট দিতে চাইল। প্রথমে না বললেও পরে কিভাবে যে তার গাড়িতে ওঠে তার পাশে বসলাম নিজেও জানি না। অদৃশ্য কি যেন একটা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করল।
গাড়ি যখন উত্তরে ছুটতে লাগল তখন সৃষ্টি আবেদন করে বসল গিটার শুনবে। আমি নিজে তখন প্রায় অন্তঃসার শূণ্য। কিন্তু সৃষ্টির তৃতীয় বার করা অনুরোধটা ফেরাতে পারলাম না। বাজালাম নিজের সমস্ত মনোযোগ একত্র করে। শেষে যখন দেখলাম মুগ্ধ সৃষ্টি আবেগ আপ্লুত ঠিক তখন আমি সাহসী হলাম- কোনোকিছু না ভেবেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিতে ম্লান করা অব্যক্ত মধুর কথাটি বলে দিলাম।

তারপর-ই নিজেকে নিজের মাঝে ফিরে পেলাম। ভয়ের শীতল হাওয়া বয়ে গেল শিরায়। যত বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল সব আমার মনে এসে ভিড় করল। হয়তো সৃষ্টি গাড়ি থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দেবে। বাড়ি গিয়ে তার বাবাকে জানিয়ে দেবে তাদের বাড়ির ছায়ায় বসবাস করা এক পতঙ্গের আস্ফালন মেনে নেওয়ার মত নয়।
কিন্তু সাহসের বিজয় হল। অভাবনিয়ভাবে সৃষ্টি সাড়া দিল। সূচনা হল নতুন অধ্যায়ের। শুরু হল নতুন এক পথে পথ চলা। আমি প্রেমিক হলাম।

আশা নিরাশা নিয়ে যখন আমাদের লুকোচুরি তখন চাকুরীটা হয়ে গেল। আর অবিশ্বস্য হলেও সত্যি- সাথে সাথে মায়ের বয়সটা বেড়ে গেল দ্বিগুন। মা দায়িত্ব মুক্ত হতে পেরেছেন ভেবেই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন । আর সেই সুযোগটা নিল বয়স। দূর্বল করে দিল মায়ের অঙ্গ প্রতঙ্গ। মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
এ ক্ষেত্রে যা হয় তাই হল। মা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। আমি মাকে সৃষ্টির কথা বললাম। মায়ের চোখের উজ্জ্বল আলো মৃয়মান হয়ে গেল। মাকে আশ্বাস দিয়ে নিজেই সৃষ্টির বাবার সাথে কথা বলতে বেরিয়ে গেলাম।

ভদ্রলোক আমার কথাটা শুনে চুপ হয়ে গেলেন। অনেক পরে স্লেশা জমা কন্ঠে বললেন- আমার মেয়েকে দেয়ার মত কি আছে তোমার? আমিও সাহসের সাথে দৃঢ় কন্ঠে বললাম- একটা বিশাল মন আছে আমার। তারপর তিনি মায়ের সাথে আলাপ করবেন বলে আমাকে বিদায় দিলেন।
জানি না কি হয়েছিল সেদিন তবে পরদিনই সৃষ্টি বদলে গেল। অচেনা হয়ে গেল। আমি কৈফিয়ত চাওয়া সুযোগ পেলাম না। তার আগেই সৃষ্টি অন্যের হয়ে গেল। বিধ্বস্ত আমি মায়ের আঁচলে ঘুমিয়ে গেলাম।
হাসপাতল কর্তৃপক্ষ যখন আমাকে ছাড়পত্র দিল তখন আমি অনেকটা সুস্থ। নিজেকে নিজের মধ্যে খুঁজে পেলাম না। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আমিত্ব।

(২)

বসন্তের শেষ প্রান্তের এক বিকেল। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল শহরময়। ভিজে গেল রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি সব। হঠাৎ দেখলাম সৃষ্টিদের বাগানে বসন্ত বৃষ্টিতে ভিজছে সৃষ্টি আর এক যুবক। প্রচন্ড কষ্টে নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। মনে ভর করল এক পাগলামি। দৌড়ে গেলাম সৃষ্টিদের বাড়ির গেটে; কাক ভেজা হয়ে গেলাম। কোথাও কেউ নেই দেখে ঢুকে পড়লাম। তারপর দ্রত সিড়ি ডিঙ্গিয়ে চলে এলাম ছাদে যাওয়ার দরজায়। আর তখন হঠাৎ করেই নিজেকে ফিরে পেলাম।

পাগল হয়ে গেলাম নাকি? কোথায় যেতে চাচ্ছি? কেন যাচ্ছি? এ প্রশ্নগুলো ভিড় করল মনে; তবে শত চেষ্টা করেও এর কোনো জবাব পেলাম না নিজের কাছে। ঘুরে নেমে আসতে লাগলাম। হঠাৎ মনে হল কে যেন ছাদের দরজাটা একটু ফাঁক করে আমায় ডাকছে। আমি ছাদে উঠে গেলাম। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল আমার দেহ। অজান্তেই হেটে গেলাম- যেদিকে সৃষ্টিদের বাগান সেদিকে। অনেকটা উপর থেকে দেখলাম সৃষ্টির উল্লাস। নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকা করতে প্ররোচনা দিল মন। দাড়িয়ে গেলাম ছাদের কিনারায়। মায়ের কাছে মনে মনে ক্ষমা চাইলাম একবার। পাখি হয়ে উড়ব এখন।

সাহসী হলাম আবার। পিছু হেটে চলে এলাম। নেমে গেলাম রাস্তায়। হাটতে লাগলাম শহর ছেড়ে আরও পূবে। জানি এবার কোথায় যাচ্ছি। মৃত্যুকে তার মত করে আসতে দিতে চাই। নিজেকে আর কখনো মৃত্যুর কাছে বিনামূল্যে বিক্রি করব না এই শপথ নিয়ে হাটতে লাগলাম। একসময় বৃষ্টি থেমে শেষ বেলার রোদ ঝিলিক দিল। অতঃপর আমি অক্ষত ফিরে এলাম সন্ধ্যায় আমার মায়ের আঁচলের নিচে।

লেখক : মোঃ তোফায়েল হোসেন
           কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার। 

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

আরও সংবাদ