আমার গল্প তুমি
স্ক্যাচার টা হাতের নাগালের মাঝে নাই আদনান এর। কিছুটা হামাগুড়ি দিয়েই স্ক্যাচারটা হাতে নিল সে। পাশের টেবিলের উপরের আলমারির চাবিটা দেখা যাচ্ছে। তার পছন্দের তালিকার সবগুলো জিনিস ঠাই পেতো এই আলমারিতে। একেবারে ছোট্ট বেলার ভাংগা ঘড়ি থেকে শুরু করে সেহেনাতের দেয়া সব গুলো গিফট ও সাজানো আছে এ আলমারি তে।
গত এক বিবাহবার্ষিকী তে একটা লাল রঙের পাঞ্জাবি গিফট করেছিল সেহেনাত।
কিছুটা লালচে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে পাঞ্জাবিটা।
লাল সেহেনাতের পছন্দের কালার। একগুচ্ছ লাল গোলাপ ও পাঞ্জাবিটা হাতে দিয়ে বলেছিল, লাল নাকি ভালোবাসার রঙ। সেই বার লাল পাঞ্জাবি আর লাল গোলাপ হাতে নিয়ে সাড়া বিকাল রিক্সা দিয়ে ঘুরেছিল তারা দুজন। বাহন হিসেবে রিক্সা সেহেনাতের প্রথম পছন্দ। তারা প্রায়ই রিক্সা দিয়ে ঘুরত।
চাবিটা হাতে নিল আদনান। আলমারি খুলতেই চোখে পড়ল সাজানো ভালোবাসার সকল সৃতিগুলো।
সেহেনাতের সাথে পরিচয় এর দশ বছর আজ। এই দিনেই প্রথম ভালো লাগার কথা জানিয়েছিল সেহেনাত। তারপর কেটে গেল অনেকটা সময়। সবার অমতে গিয়ে গত ৩ বছর আগে, এই দিনেই একজন পুর্ন বেকার আদনান কে বিয়ে করেছিল সেহেনাত। তারপর কত ত্যাগ তিতিক্ষা মধ্য দিয়ে চলতে থাকে তাদের জীবন। এরই মাঝে সেহেনাতের কোলজুড়ে আসে তাদের ভালোবাসার ফসল, তাদের একমাত্র মেয়ে তাহিয়া। তাহিয়া যখন জন্মনিল, সবাই বলল কি সুন্দর, বাবুটা!!! একে বারে রাজকন্যা।
তাহিয়া আসলেই রাজকন্যা ও রাজকপাল নিয়ে জন্মেছিল। তাহিয়া জন্ম নেয়ার মাসেই আদনানের একটা ভালো চাকুরিও হয়ে গেলো। সবাই বলতে লাগল তাহিয়ার ভাগ্যেই নাকি আদনান চাকুরি পেলো। রেললাইন ধরে হাটা সেহেনাতের খুব পছন্দ। তাই রেল স্টেশনের পাশেই বাসা ভাড়া নিল তারা।
প্রতিদিনের মত সেদিন ও অফিসের চলে গেল আদনান। রেল স্টেশনের পার হলেই তার অফিস।
অন্যদিকে আদনান কে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য সম্পুর্ন ঘরকে সাজাতে লাগল সেহেনাত ও তার ছোট্ট মেয়ে তাহিয়া। বিকাল হতেই মা মেয়ে বের হয়ে গেল কেকের দোকানের উদ্দেশ্যে। বাসা থেকে বের হয়েই রিক্সা নিল সেহেনাত। কেকের দোকান থেকে আবার রওনা দিল তারা। বাসায় যেতে যেতে অনেক প্ল্যানিং করতে লাগল মা মেয়ে মিলে। হঠাত করেই উলটো দিক থেকে প্রচন্ড গতিতে ছুটে আসা একটা প্রাইভেট কার চাপা দিয়ে দিল তাদের রিক্সা। মুহুর্তের মধ্যেই দুমড়েমুচড়ে দিয়ে গেল দুটি তাজা শরীর। সারা রাস্তা ভেসে গেলো তাদের রক্তে।
অন্যদিকে আদনানও আজ একটু আগেই অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।
পাশের জোনাকি মার্কেটের উদ্দেশ্যে হাটতে লাগল আদনান। এ মার্কেটের ৬ তলার কুয়েতি জুয়েলারি শপের জুয়েলারি সেহেনাতের খুব পছন্দ। আদনান অনেক দেখে শুনে একটা হাত ঘড়ি কিনে নিল সেহেনাত এর জন্য। হাত ঘড়ি সেহেনাত এর খুব পছন্দ। জুয়েলারির তালিকায় হাত ঘড়িকেও সে জায়গা দেয়। পাশের দোকান থেকে অনেক গুলো চকোলেট, আর লাল রঙের গোলাপ কিনে রওনা দিল। খানিক বাদেই পকেটে মোবাইল বেজে উঠল।
সেহেনাত এর কল।
কল রিসিভ করতেই ভিন্ন কন্ঠের কেউ হ্যালু বলল।
আদনান কিছুটা চমকে গেলো।
লোকটি তাকে এ জেড হাবিব হাসপাতালে দ্রুত আসতে বলল। তার বাসার পাশেই হাসপাতালটি।
খুব দ্রুত একটি সিএনজি গাড়ি নিয়ে রওনা হল সে।
আধ ঘন্টার মাঝে পৌছে গেলো আদনান। কিন্তু এই আধ ঘন্টাকে তার কাছে কয়েক লক্ষ ঘন্টা মনে হচ্ছিল। চড়ম উৎকণ্ঠা টেনশন নিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করতেই আবারো ফোন বেজে উঠল।
লোকটি তাকে ৩০৫ নম্বর রুমের সামনে যেতে বলছে।
সে দ্রুত ৩০৫ নম্বর রুমের সামনে চলে গেলো।
সেখানে যেতেই কয়েকটা যুবকের সাথে দেখা হলো।
তার মধ্য থেকেই একজন বলে উঠল, ভাই আমিই আপনাকে কল দিয়েছি।
মোবাইল টা যার তিনি আপনার কি হয়?
কেনো? সে আমার স্ত্রী। কি হয়েছে তার? আপনারা কারা?
জ্বি,ভাইয়া আপনার স্ত্রী অল্প কিছুক্ষণ আগেই এক্সিডেন্ট করেছে। উনি আর নেই। আপনি প্লিজ একটু শক্ত হউন।
কি বলেন এসব!!!
হাত থেকে গিফট, চকোলেট, ফুল ততক্ষনে ফ্লোরে পরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠল আদনান। আর আমার তাহিয়া, আমার মেয়ে কোথায়??
কথা বলছেন না কেনো আপনি?
তাহিয়ার মৃত্যুর খবর টি আর ঐ লোকটি উচ্চারণ করতে পারছিল না।
পাশ থেকে একটা মুরুব্বি টাইপের লোক বলে উঠল, বাবাজি, তারা দুজনেই আল্লাহর কাছে চলে গেছে।
তুমি একটু শক্ত হউ বাবা।
আদনান কাঁদছে, ভিষনভাবে কাঁদছে।
তার কান্নায় ভারী হয়ে গেছে সম্পূর্ণ হাসপাতাল।
অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে তাকে ঘিরে।
সবাই খুব আফসোস করছে তার জন্য।
আদনানের এক দূর সম্পর্কের চাচাকে খবর দেয়া হলো। আদনানের আপন জনের তালিকা খুব ছোট।
বাবা মা অনেক আগেই পরপারে চলে গেছেন।
স্ত্রী আর মেয়েকে হাড়িয়ে আপনজনের তালিকাটা একেবারে শূণ্যে দাড়ালো।
এখন আপন বলতে ঐ চাচা ছাড়া আর কেউই বেঁচে নেই।
মনির চাচা খবর পেয়েই দ্রুত ছুটে এলেন। তিনি আদনান কে খুব স্নেহ করেন। অনেক বিপদে আপদে আদনান তাকে সাহায্য করেছেন। মনির চাচা নিজেও বাকরুদ্ধ।
এ শোক বইবে কেমনে আদনান!!
এটা ভেবেই কোনো কিনারা করতে পারছেনা সে।
সেই বিকাল থেকেই আদনান কাদছে। ততক্ষণে একটা এম্বুলেন্স ভাড়া করে নিয়ে আসল মনির চাচা।
লাশ দুটো এম্বুলেন্স এ তুলে দিল তিনি।
জোড় করেই আদনান কে হাসপাতাল থেকে নিয়ে রওনা দিল সে।
আদনান কেঁদেই চলছে।
লাশ নিয়ে যখন তারা বাসায় ফিরল তখন রাত ১০ টা।
মহল্লার মসজিদে মৃত্যু ও জানাজার ঘোষণা হল।
কিছু এতিম ছেলে এসে কোরআন তিলাওয়াত করতে লাগল।
আদনান অপলক দৃষ্টিতে সেহেনাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
তার কোলে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে তাহিয়ার লাস। একটু পরপর ই কথা বলছে তাহিয়া সেহেনাতের সাথে।
কত কথা।
সাড়ারাতই কথা বলল আদনান।
কতো কথা।
একটু পর পর ই ঢেকুর তুলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছিল সে।
সারারাত তার পাশে বসে থাকল মনির চাচা।
পরেরদিন সকাল দাফন হয়ে গেলো সেহেনার আর তাহিয়া।
আদনানের বিলাপে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো।
সবাই তাকে অনেক শান্তনা দিল।
দুই দিন হয়ে যায় কিছুই খায় নি আদনান।
জোর করেই তাকে নিয়ে খেতে বসল মনির চাচা।
এভাবেই কাটতে লাগল আদনানের দিন গুলো।
চাকুরি ছেড়ে দিল সে।
সাড়াদিন এই ঘরটার ভিতরেই কাটিয়ে দেয়।
কিছুতেই বের হয় না।
বের হতে বললেই বলে, সেহেনাত আর তাহিয়া একাএকা ভয় পাবে। আবার একা একা মার্কেটে যাবে, বাহিরে যাবে।
আবার এক্সিডেন্ট করবে।
না না, আমি তাদের ছেড়ে একা বাহিরে যাবো না।
সাড়াদিন ঐ একটা ঘরেই সেহেনাত আর তাহিয়ার জামা কাপড়ের সাথে কথা বলত আদনান।
অনেক রোগা হয়ে গেছে সে। স্ক্যাচার ছাড়া হাটতে পারেনা।
অনেকগুলো ডাক্তার দেখানো হয়েছে তাকে।
কিছুতেই উন্নতি হয় নি।
মনির চাচা এখন তার সাথেই থাকে।
ছেড়ে যেতে পারোনি অসহায় আদনানকে।
গতকাল হঠাৎ করেই মনির চাচার ছোট মেয়ে টা খুব অসুস্থ। প্রচন্ড পেট ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বাবার উতলা মন আর থাকতে পারলোনা।
আদনান কে অনেক বুঝিয়ে রেখে রওনা দিল মনির।
আদনান ও খুব মাথা নাড়ালো।
আলমারি থেকে লাল পাঞ্জাবিটা তুলে নিল।
আজ সে লাল পাঞ্জাবি পড়বে।
সাথে সেহেনাতের দেয়া কালো ফিতার ঘড়ি, কালো ফিতার জুতা জোড়াও পরিষ্কার করে নিল সে।
কালো ফিতার ঘড়ি টা তাহিয়ার খুব পছন্দ।
আর কালো জুতা পছন্দ সেহেনাতের।
জুতা, ঘড়ি পড়ছে আর বিড়বিড় করে কার সাথে যেনো কি বলছে।
আবার মুচকি মুচকি হাসছেও।
বাসা থেকে বের হয়েই রিক্সা ডেকে নিল সে।
রিক্সা করেই ঘুরত তারা। রিক্সায় উঠে আবার কথা শুরু করল আদনান। কত খুনসুটিরর গল্প।
রিক্সাওয়ালা বারবার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে, আর অবাক হচ্ছে।
বিড়বিড় করে কি বলে তাও বুঝতে পারছেনা সে।
কয়েকবার জিজ্ঞাসা ও করল, ও ভাই আমাকে কিছু বলেন?
২য়বার জিজ্ঞাসা করাতে আদনান, রাগ দেখালো।
না না আপনাকে কিছু বলিনা।
আপনি গাড়ি চালান।
রিক্সা চলছে রেলস্টেশন এর দিকে।
খানিক বাদেই পৌছে গেলো সে।
ভাড়া মিটিয়ে আবারো হাটতে লাগলো সে।
আশেপাশের সবাই তাকাচ্ছে তার দিকে।
সে কিছুটা বিরক্ত ও রাগান্বিত। তার বউকে কেনো সবার দেখতে হবে।
তুমি দেখছ, সবাই কেমন তোমার দিকে তাকাচ্ছে??
আরে না, আমার দিকে না তোমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমার দিকে তাকাবে কেনো??
আমি কি মেয়ে মানুষ!! তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে তাই তোমার দিকে তাকাচ্ছে।
বলেই সজোড়ে হেসে উঠল আদনান।
আবারো আশপাশের মানুষ তাকালো তার দিকে।
সেহেনাত এর কোলে তাদের আদরের তাহিয়া।
আজ তাদের ৪র্থ বিবাহবার্ষিকী।
অনেক প্ল্যানিং নিয়ে বেরিয়েছে তারা। হাতে হাত রেখে রেল লাইনে হাটা হয় না অনেকদিন।
আজ অনেকটা বেলা হাটবে দুজনে।
কিন্তু আদনান তো স্ক্যাচার ছাড়া ভালো মত হাটতেই পারেনা।
সাহস দিল সেহেনাত।
আজকে অনেক খুসি আদনান।
হাটতে লাগল রেললাইনের দিকে।
সাড়াক্ষণ বিড়বিড় করেই চলছে।
একটু পরপর হাসি।
ততক্ষনে রেললাইন ধরে হাটতে লাগল আদনান।
পড়নে সেহেনাতের খুব পছন্দের রঙের লাল পাঞ্জাবি। হাতে কালো ঘড়ি । পায়ে কালো ফিতার জুতা।
স্ক্যাচার দিয়ে হাটতে কষ্ট হচ্ছে তার।
কিন্তু তাও হাটছে সে।
রেললাইন ধরে হাটা সেহেনাতের অনেক পছন্দ।
তাদের কত বিকাল কেটেছে এই রেললাইনে!!
গুণে শেষ করা যাবেনা।
প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেল,
পিছন থেকে পারাবত এক্সপ্রেস এর ট্রেন ছুটে আসছে।
কয়েকবার হুইসেল বেজে উঠল।
আদনান হেটেই চলছে।
একহাতে স্ক্যাচার, অন্যহাতে সেহেনাতের হাত ধরে হাটতে লাগল সে।
সেহেনাত ও আজ অনেক হাসিখুসি।
আবারো প্রচন্ড শব্দে হুইশেল বেজে উঠল।
পাশ থেকেই একজন মধ্য ববয়সী লোক দৌড়ে আসছে তাকে বাঁচাতে ।
হয়ত বা এখনই কাটা পরবে আরেকটি লাশ।
ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লালচে পাঞ্জাবী টাও হয়তো একটু পরেই হয়ে উঠবে রক্তিম।
সেহেনাত হাসছে।
তাহিয়াও হাসছে।
হাসছে আদনানও ।
তার হাসির শব্দে কেপে কেপে উঠছে উপরের আকাশ।
ম্লান হয়ে যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল।
শিক্ষকঃ মৌলভীবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান