ফেরারী


যখন কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করি; বিশেষ করে অদৃশ্য কোনো ক্রিমিনালের খুঁজে পথে প্রান্তরে ঘুরি তখন নিজের নিরাপত্তার জন্য গুটি কয়েক অফিসার ছাড়া আর সবার কাছ থেকে নিজেকে বিছিন্ন করে রাখি। নিঃসঙ্গ মানুষ হওয়ায় অবশ্য এ নিয়ে কোনো অসুবিধেও হয় না।

নৃশংস এক খুনের অস্পষ্ট কিছু আলামত নিয়ে খুনিকে খুঁজতে যখন এই পাহাড়ী শহরে ঢুকলাম তখন নিজেকে অনেকটা অরক্ষিত মনে হলো। একজন স্পাই হিসেবে এ ব্যাপারটা কোনো দিনই গায়ে মাখি না। তবে আজ মাখতে বাধ্য হলাম। কারণ প্রথম সন্ধ্যাই হঠাৎ করে আমর গতিপথে ডানা এসে দাঁড়াল।

ব্যবসায়ি বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে ডানার সাথে কলেজেই প্রথম পরিচয়। অহংকারহীন স্বাভাবিক এক মেয়ে ডানা। বাবার অঢেল টাকার জৌলুস তার মাঝে ছিলনা। তবুও তাকে এড়িয়ে যেতাম খুব ভদ্রভাবেই। কিন্তু ডানা যেন কিছু বলতে চাইতো, বুঝাতে চাইতো সবসময়। আমি অবুঝ থাকতাম। তারপরও একসময় ডানা প্রকাশ করলো তার প্রেম। দু’জনের আকাশ-পাতাল ব্যবধানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমার অক্ষমতা তাকে বুঝিয়ে বললাম। তবুও ডানা অবিচল থাকল। বাধ্য হয়েই হারিয়ে যেতে হলো ডানার আকাশ থেকে। কিন্তু পরে অবশ্য অনুশোচনা হয়েছিল। ভেবেছিলাম- হয়তো ডানাকেই নিয়ে সুখী হতে পারতাম।

বেশ কয়েক বছর পর আবার দু’জনার দেখা হলো। ডানা তার বাবার এ শহরের ব্যবসা দেখাশুনা করে। বলতে গেলে পুরোদমে ব্যবসায়ী। দেখা হওয়ার পর যখন জানলাম সে এখনো বিয়ে করেনি তখন খ্চ করে একটা কাঁটা বিঁধল মনে। মনটা আন্দোলন শুরু করলো। ডানার মুখের ভাষায় আমার জন্য অপেক্ষা আর চাহনিতে অপেক্ষার প্রহর শেষ হওয়ার একটা আকুল আবেদন দেখতে পেলাম। আমার মনটাও চাইলো ফুল ফোঁটাতে সব বাধা ডিঙ্গিয়ে। কিন্তু এখন সময়ের খেয়ায় তো আমি বন্দি। তাই অ্যাসাইনমেন্টটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে একজন সাধারণ চাকুরীজীবি সেজেই থাকতে হবে ডানার কাছে এবং তার থেকে একটু বিচ্ছিন্ন ভাবে।

অফিসের জরুরী কাজটা শেষ করা দরকার- এ কথা বলে তার কাছ থেকে দু’দিনের সময় চেয়ে চলে আসি। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই আমার মূল সাবজেক্টের পরিচয় পেয়ে গেলাম। কল্পনাতীত হুচট খেলাম; যখন দেখলাম আমার তদন্তের সব ক’টা আঙ্গুল ডানাকে নির্দেশ করছে। এলোমেলো হয়ে গেল সব। প্রচণ্ড কষ্টে দিশেহারা হয়ে গেলাম। ভেবে পেলাম না কিভাবে ডানার মতো একটা মেয়ে খুন করতে পারে!

আবেগের কাছে দায়িত্বকে বিক্রি করতে না পেরে কষ্টে বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। তবুও দায়িত্বের শপথ ভঙ্গ করলাম না। শুধু তার পরিচয়টা গোপন রেখে ফোন করে লোকেশনসহ বাকি সব উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে জানালাম। প্রয়োজনীয় নির্দেশ পেয়ে হাঁটা দিলাম ডানার ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে।

ডানা ফ্ল্যাটেই ছিল। আমার উপস্থিতিতে সে ব্যাকুল হয়ে গেল। তার গৃহিণী মনোভাব স্ফুটিত হতে লাগলো। আমার সেবার জন্য পাগলপ্রায়। তবুও বুকের কোণে চিন চিন ব্যথা নিয়ে তাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বাস্তব সত্যটা প্রকাশ করলাম।

মূর্তি হয়ে গেল সে ক্ষণিকের জন্য। পরমুহূর্তে সব দ্বিধা দ্বন্ধ মুছে নিজের কাছে ফিরে আসলো। জানালো এক করুণ ঘটনা-

ডানার আকাশ থেকে আমি হারিয়ে যাওয়ার পর সুজনের সাথে দেখা। তার কাঙাল মন যখন ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল তখন সুজন নিজে এসে বলল- ভালোবাসি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। প্রচণ্ড টানে পরস্পর কাছাকাছি আসলো। সুখের নদীতে সাঁতারে তারা অজানায় হারাতে চাইল। এমনি ভালোবাসাময় এক সন্ধ্যায় ডানার সরলতার সুযোগ নিয়ে সুজন তাকে ধর্ষণ করলো।

ঘটনাটার দু’দিন পরই সুজন তাকে ত্যাগ করলো। কিছুদিন পরই এক সন্ধ্যায় ডানার ছোট বোনটা বাসায় ফিরলো বিধ্বস্ত অবস্থায়। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে- এ কথা বলে বাসার সবাইকে সান্ত্বনা দিলেও গভীর রাতে তার কাছে ভয়ংকর সত্যিটা ধরা পড়ে গেল। বাসার কাউকে না জানানোর শর্তে; শর্ত ভঙ্গ করলে আত্মহত্যা করবে এ মর্মে তার বোনটা চুপিচুপি জানালো- সে তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা। খলনায়ক সেই সুজন।

বিষয়টা জেনে যখন ডানার নিজেকে জ্ঞানশূণ্য মনে হচ্ছে তখন আরও একটা করুণ কথা শুনালো তার বোনটা। সুজন নাকি আজ সন্ধ্যায় সম্পর্কটার সমাপ্তি ঘটিয়ে শহর ছেড়ে চলে গেছে।

নিঃস্ব ডানার অন্তরে একটা প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলো। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে সুন্দর একটা ছক করে হায়েনাটাকে ধাওয়া করে বুকে ছুরি বসিয়ে দিল। খুনের সব আলামত মুছে ফেলে ডানা জনারণ্যে হারিয়ে যেতে পারলেও মনের সেই রক্তাত কষ্টময় দাগ মুছতে পারলো না শত চেষ্টা করেও।

সব শুনার পর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলাম। ডানার একটা কথা বারবার মগজে আঘাত করলো- “আইন কি পারতো দু’টি মেয়ের লুট হওয়া অমূল্য সম্পদ ফিরিয়ে দিতে?”

ভাবলাম ঠিকই তো বলছে ডানা- আইন বিচার করতে পারতো ঠিক কিন্তু পারতো না ডানা আর তার বোনের হাহাকার দূর করতে।

কোনকিছু না ভেবেই ডানাকে বললাম- যদি পার পালিয়ে যাও। আমি তোমাকে ছেড়ে দিলাম। কথাটা শুনে ডানা প্রচণ্ড উল্লাসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো- “আমি স্বাধীনভাবে এ পৃথিবীর বুকে বাঁচতে চাই আর যদি সম্ভব হয় তাহলে ভালোবাসতে চাই শুধু তোমাকে। তাই এ মুহূর্তে পালিয়ে গেলাম। যদি ফিরে আসা সম্ভব হয় তবে ফিরব তোমার দরজায়। আমার হারানো সম্পদের কথা না ভেবে আমার ভালোবাসার কথা ভেবে যদি আমাকে গ্রহণ করো তবে থাকবো। না চলে যাবো অন্তহীন সীমানা পেরিয়ে।”

ডানা লিফটে করে নেমে গেল আর আমি সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। ডানার ধূসর ক্যাডিলাক যখন শহরের প্রথম বাঁকে হারালো, ঠিক তখনই সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি এসে থামলো ডানার ফ্ল্যাটের সামনে। আর আমি পোস্ট অফিসটাকে বায়ে রেখে পা বাড়ালাম উদ্দেশ্যহীনভাবে অন্তহীন পথে- শুধু ডানার মতো একজন ফেরারী হতে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

আরও সংবাদ