অনুপমা অটোমেশন
বেশ চলছিল। বি.এড কমপ্লিট করার পর অখণ্ড অবসর। কয়েকটা টিউশনি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর ছিল বাবার হোটেলের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা। কিন্তু সেই বাবার আকস্মিক মৃত্যু তুহিনকে একেবারে ধপ করে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে আছড়ে ফেলেছে। অর্থনৈতিক চিন্তা আর নিরাপত্তাহীনতায় এ যেন অন্য তুহিন! ঘরে মা, এক বৃদ্ধা ফুফু আর এক ছোটো বোনের অন্ন জোটাতে একটা চাকরি এবারে না করলেই নয়। সকালের পেপারটা খুলে কর্মখালির পাতাটা উল্টাতেই বিজ্ঞাপনের জগতে হাবুডুবু খেতে লাগলো।
অসংখ্য বিজ্ঞাপনের ভিড়ে উঁকি দিচ্ছে একটা অদ্ভুত বিজ্ঞপ্তি- “পশ্চিমের বনে আগুন লেগে পুড়ে গেছে উত্তরমুখী বাংলো। হাইওয়ের পাশে রেস্তুরেন্টটা নতুন করে খোলা হবে। একজন সুদর্শন বডিগার্ড দরকার মালিকের প্রিয়জনের জন্য। আগ্রহীরা ভোর পাঁচটা হতে ঊনত্রিশ ঘন্টার মধ্যে যোগাযোগ করুন- সেলুন ক্যাফেটেরিয়ার অভ্যর্থনা কক্ষে।”
বিজ্ঞপ্তিটা পড়ে শতকার আটানব্বই জনেরই এড়িয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। বাকি দু’জনের একজন ভাববে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের সাংকেতিক কোন বার্তা। আর অবশিষ্ট একজনের মধ্যে জাগবে অনুসন্ধানী ভাব। তুহিনও সেই শেষের জনের দলে পড়ে গেল। সে ভাবল এখানে কর্তৃপক্ষ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কাউকে খুঁজে নেওয়ার একটা চেষ্টা করেছেন হয়তো।
সমস্যা হলো সেলুন ক্যাফেটেরিয়ার কোন ঠিকানা নেই। তবে বিজ্ঞপ্তিটার নিচের কোণে খুব ছোট করে চতুর্থ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য লেখা আছে। তুহিন চতুর্থ পৃষ্ঠায় আবিষ্কার করলো- একটা ফোন নম্বর। অপেক্ষা না করে ফোন দিল। কলটা রিসিভ করলো মিষ্টি কন্ঠের একটা মেয়ে। জানতে চাইল ফোন করার কারণ। তুহিনের জিজ্ঞাসার উত্তর দিল মাত্র চারটি কথায়। তুহিন জেনে গেল সেলুন ক্যাফেটেরিয়ার ঠিকানা।
সাথে সাথেই তুহিন যাবতীয় কাজগপত্র নিয়ে রওয়ানা দিল। যেতে হবে প্রায় তিনশত মাইল উত্তরে অচেনা এক পাহাড়ী শহরে।
সন্ধ্যার পর পরই সে যথাস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হলো। সেলুন ক্যাফেটেরিয়াও পেয়ে গেল- শহর অতিক্রম করে বেশ কিছুটা বাহিরে এক পাহাড়ী উপত্যকায়। অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো একটা বিশাল বাড়িই বলা চলে এটাকে। একদম নিরিবিলি পরিবেশে দাঁড়িয়ে যখন কলিংবেলটায় টিপ দিল তখন সাথে সাথেই খুলে গেল কপাট। নীল চোখের চঞ্চল এক যুবতী দৃষ্টি নিবন্ধন করে তুহিনকে বিচলিত করে দিল ক্ষণিকের জন্য। তুহিনের আগমনে উদ্দেশ্য শুনে অপূর্ব একটা হাসি ফুঁটে উঠল ঠোঁটের কোণে।
তুহিনকে বসানো হলো চিমচাম একটা কক্ষে- অনেকটা অতিথিদের মত করে। ক্ষণকাল পরেই এসে হাজির হলেন সাদা শিফন শাড়ি পরা এক অপরূপা মহিলা। জানালেন তিনিই নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ। আরও জানালেন তুহিনই তার কাছে আসা একমাত্র চাকরি প্রার্থী। অতএব চাকরি কনফার্ম। বেশ ভালো বেতনের বিনিময়ে তুহিনকে মহিলার ব্যক্তিগত সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হবে। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও উনার।
তুহিন আত্মতৃপ্তি নিয়েই তখনই অলিখিতভাবে কাজে যোগদান করলো। সেই নীল নয়না একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বললেন- খাওয়া দাওয়া সেরে একটা ঘুম দেন। কাল সকাল থেকেই আপনার ডিউটি শুরু হচ্ছে।
তুহিন বাড়িতে ফোন করে সুসংবাদটা তার মাকে জানিয়ে দিল। তারপর সারাদিনের ক্লান্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করে ঘুমের রাজ্যে নিজেকে আত্মসমর্পন করে দিতে বাধ্য হলো।
তুহিনের ঘুম ভাঙ্গল তীব্র রোদের উত্তাপে। সে অদ্ভুতভাবে নিজেকে আবিষ্কার করলো একটা পাহড়ী উপত্যকায় ঘাসের ওপর শুয়া অবস্থায়। লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আশে-পাশে কোথাও কোন মানুষজনের চিহ্ন নেই! তাহলে সেই প্রসাদময় বাড়িটা কোথায় গেল! কোথায় গেল গত রাতের চঞ্চল যুবতী আর সেই মহিলা!
তুহিন এখনো ভাবে- তখন সে একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছিল তার পকেটে। ফিরে এসে সে এটা নিয়ে যোগদানও করেছিল অনুপমা অটোমেশনে। কিন্তু তার পরিবার জানে তুহিনকে পাগলা গারদে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে আজ ছেচল্লিশ দিন হলো।
লেখকঃ
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

 
			 
 