‘স্মৃতি’

ছোটবেলা থেকেই হোস্টেলে থাকা অভ্যাস আমার। প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর সেই যে স্কুলের হোস্টেলে ঢুকেছি স্কুলের চাকরি পাওয়ার পরও এখনও সেই হোস্টেল আমার পিছু ছাড়েনি। এখনও সপ্তাহে একটা দুটো রাত আমাকে হোস্টেলেই কাটাতে হয়। হোস্টেলের একটা ছেলে আর তার কয়েকজন বন্ধুকে দেখে কেন জানিনা আমার সেই পুরনো দিনের কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেল। আমি, কৌশিক, প্রবির, বাদশা আর সৈকত এই পাঁচজনকে নিয়ে আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। স্কুলের হেন কাজ নেই যেখানে আমাদের দেখা যেতনা। আমরা পঞ্চ পাণ্ডব নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলাম। বলা বাহুল্য বদমাইশিতেও আমরা কম যেতাম না। রাত্রে স্কুলের গাছে নারকেল পাড়া, পুকুরের মাছ ধরে হোস্টেলের রুমে ফিস্ট করা এরকম আরও কত কাজ যে করেছি বলে শেষ করা যাবেনা। কিন্তু পড়াশোনাতেও আমারা তুখোড় ছিলাম। তাই কাজে-অকাজে স্যারদের কাছ থেকে একটু প্রশ্রয় পেতাম বৈকি। বিশেষভাবে হেডস্যার আমাদের পাঁচ জনকে খুবই স্নেহ করতেন।
বনভোজন সামনে। চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে প্যান্ডেল, বাজার হাট সবই আমাদের ওপর। সারাদিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর বিকেলে হাট করতে হবে- বনভোজনের বাজার বলে কথা। আমরা একটা ভ্যান-রিক্সায় কিছু থলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাজার করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শীতের সন্ধ্যা যেন তাড়াতাড়ি নেমে যায়। হাটটা স্কুল থেকে একটু দুরেই ছিল। আর পথেই পড়ত একটা কবরস্থান। এই কবরস্থান নিয়ে নানা গল্প চালু ছিল। অতি বড় সাহসীও রাতের বেলা এই পথ এড়িয়েই চলত। আসলে আমরা যখন স্কুল থেকে বেরোই তখন এই জায়গাটার কথা কারও খেয়ালে ছিলনা। যদিও আকাশে চাঁদ ছিল কিন্তু মেঘ থাকার জন্য অন্ধকার যেন চেপে আসছিল। কবরস্থানের কাছে পৌঁছাতেই একটা বড় মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে ফেলল। আমাদের হাত-পা যেন ভয়ে হিম হয়ে এল। কাছে পিঠে কোথাও একপাল শিয়াল ডেকে উঠল। হঠাৎ দেখি…
কবরস্থানের দক্ষিণ প্রান্তের শিরিশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে এক সাদা মুর্তি। তাহলে এই কবরস্থান নিয়ে চালু থাকা গল্পটা সত্যি! সারা শরীর যখন প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে কেঁপে উঠল ঠিক তখন ভয়টা মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করল। বাদশাকে সুরা কেরাত পড়তে বলব বলে যখন ঘাড় ঘুরালাম- দেখলাম কোথাও কেউ নেই। ভ্যান-রিক্সার ড্রাইভারসহ বাকি চারজনই গায়েব হয়ে গেছে।
মুর্তিটা ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। পেটে আমাশয় যেন মোচড় দিয়ে উঠল। পাশের বাড়ির আঙ্কেলকে কাতলা মাছ বলে ক্ষেপালে তিনি যখন বাবার কাছে একশত একটা অভিযোগ সহকারে বিচার প্রার্থী হতেন তখন বাবা “দাঁড়া উজবুক” বলে আমার দিকে স্টীম এঞ্জিনের মতো ধেয়ে আসলে চিতার ক্ষিপ্ততায় যে দৌড় দিতাম সে মুহূর্তে ঠিক সেই দৌড়টাই দিলাম।
ঘন্টাখানেক পর বেশ কয়েকজন লোক নিয়ে আমরা আবার ফিরে আসলাম বাজার সদাই নিয়ে যেতে। এসে দেখি ভ্যান-রিক্সাটা উদাও। যতটা সম্ভব খোজার পর না পেয়ে আমরা শূণ্য হাতে ফিরে আসলাম। পরদিন অবশ্য সেটা পাওয়া গেল কবরস্থান থেকে মাইল খানেক পূর্বের এক ডোবায়।
ঘটনাটা ঘটার পর এলাকাময় গল্পটা বিভিন্ন আকার আকৃতিতে বিস্তৃতি লাভ করল। এমন সময় সৈকত ঘটিয়ে ফেলল আরেক ঘটনা। স্কুলের সেরা সুন্দরী স্মৃতির আহবানে সাড়া দিতে সাহসী হওয়ার প্রস্তাব উপস্থাপন করল আমাদের সংসদ অধিবেশনে। চার ভোটে তার প্রস্তাব পাশ হল। সিদ্ধান্ত হল আজ রাতেই আমরা সৈকতকে নিয়ে যাব স্মৃতিদের বাগানে। প্রমাণ হিসেবে নিয়ে আসবো বাগানের পশ্চিম প্রান্তের গোলাপ গাছের সবকটা ফুটন্ত গোলাপ।
রাতের গোলাপ অভিযান সফল হয় হয় সময় হঠাৎ করে হাতে টর্চ লাইট নিয়ে কোথা থেকে উদয় হলেন স্মৃতির কাকা; সাথে উনার পোষা ভয়ংকর কালো কুকুরটাও। অভিযান অসমাপ্ত রেখেই ঝেঁড়ে দৌড় লাগালাম। তবে আজ আর ছত্রভঙ্গ হয়ে নয় বরং একসাথেই গা’য়ে গা’ লাগিয়ে। যখন আমাদের হুশ ঠিক হল তখন দেখি আমরা দাড়িয়ে আছি সেদিনের সেই সাদা মুর্তি যেখানে দাড়িয়ে ছিল সেখানে। ভয়টা গ্রাস করার আগেই অদ্ভুত এক সত্যি আবিষ্কার করে ফেললাম আমরা। দেখলাম দুটি সাদা মুর্তি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ঘাসের উপর শুয়ে আছে হাত বিশেক দূরে। আকাশের ঝলমলে চাঁদটা তাদের পরিচয় উন্মুক্ত করে দিল। একজন হলো সৈকতের বাবা আর অন্যজন স্মৃতির মা। তারপর… থাক; পরের গল্পটা না হয় আরেক দিন বলি।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
