‘ঠিকানা’- মনস্তাত্ত্বিক গল্প

যদিও আমার আমি ছাড়া আর কেউ নেই- এমন পিছুটানহীন নিঃসঙ্গ একাকী মানুষ আমি তবুও মেঘকন্যা মেঘালয়ের মওলুম-চেররা সিমেন্টস লিমিটেড এ গিয়েছিলাম জীবিকার সন্ধানে। যোগ্যতার দৌঁড়ে পিছিয়ে পড়ায় বিশাল শূণ্যতার অভ্যর্থনায় অসহনীয় নিরাশা নিয়েই গন্তব্যহীন চলছিলাম। চলতি পথেই নিঃসঙ্গতার অদ্ভুত এক আবেশ পেয়ে বসল মনে।
অলঙ্ঘনীয় তৃষ্ণা জাগানো খাসি পর্বতমালা আমাকে চিনে নিয়ে ইশারায় ডাক দিয়ে বসলো। অরণ্যের বিস্ময়াভিভূত আকস্মিকতার আগ্রাসী উৎফুল্লতাময় ডাকে সাড়া দেইনি এমন কোন নজির নেই আমার এই ঠিকানাহীন জীবনে। তাই এবারও সুচারু চিত্তের সোনালি শিহরণে চেরাপুঞ্জি-মাওসিম্রাম রিজার্ভ ফরেস্টের আহবানে সাড়া দিলাম স্বচ্ছন্দে।

অবুঝ থাকতেই প্রিয়জনকে হারিয়ে ঠিকানাহীন হয়েছিলাম। পথের ছেলে হয়ে পথেই চলছিল জীবন। প্রতিদিনই শতবার শুনতাম- আমার কোন ঠিকানা নেই; নেই কোন পরিচয়। কিন্তু যখন নিজের বুঝটা প্রকট হলো তখনই মনে আঘাত লাগলো। ভাবনাসংকুল আকাঙ্ক্ষা আর স্বত্বলিপির সন্ধানে চাঞ্চল্যময় এক জটিলতার শিকার হয়ে গেলাম। সদূরপ্রসারি একটা ভাবনা খেলে গেল মনে। ঠিকানার খোঁজে সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে গেলাম বিস্তীর্ণ মাঠে, শিল-কড়ইয়ের ছায়ায়, রেইনর্ট্রির ঘন বিস্তারে, সীমান্ত শহরে, অচেনা নগরের অজানা বন্দরে, কুঠিল অন্তরে, ধূ ধূ মরুর প্রান্তরে। পৃথিবীর অদ্ভুত খটকাময়তায় বারবার ব্যর্থ হয়েছি বটে কিন্তু সংগোপনে লালন করা স্বপ্নটাকে বাস্তবতার আঁচলে গিঁট বাঁধার চেষ্টা ছেড়ে দেইনি অদ্যাবধি পর্যন্ত। জীবনের বিবর্ণ রং আমাকে রংধনু দেখাতে পারেনি কোনদিন কিন্তু আমি রংধনু দেখেছি আকাশের সামিয়ানায়। বিচিত্র আলো ছায়ার নকশা দেখেছি তন্বী শরীরের স্নায়ু-উপস্নায়ুতে। নীল শাড়ির ভাঁজে এসেন্সের গন্ধ আমাকে পাগলও করেছে। মাধকতাময় মেয়েলী ঘ্রাণে তীব্র ক্ষুধা আর আকাঙ্ক্ষাও জেগেছে হাজারবার। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতাম প্রথম প্রথম। কিন্তু প্রকাশের সাথে সাথেই ঠিকানাহীন অপবাদে আশার পৃথিবীতে অমাবস্যা নেমে যেত। গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পড়তো খয়েরি খেত। সুর হারাতো বসন্তের গান। তাই এখন আর তা প্রকাশ করিনা, তবে তীব্র জ্বালাতনে ছটফট করি মনোজগতের দৃশ্যপটে। আর ঘুরে বেড়াই প্রকৃতিময়তার সুশীতল পরশের সন্ধানে।

বিশ্বের চতুর্থ উচ্চতম জলপ্রপাত মোসমাই এর পাশেই প্রথম দেখেছিলাম ঝর্ণাকে- যদিও তখন তার নামটা আমার অজানাই ছিল। জলপ্রপাতের অপূর্বতা তার সৌন্দয্যের কাছে হার মেনে গেছে দেখে অপলক নয়নে তাকে দেখেছিলাম বেশ কয়েক মহূর্ত। মোসমাই দেখতে এসে আমি যার দেখা পেলাম তার বর্ণনা আমার দ্বারা দেওয়া সম্ভব হবে না হাজার চেষ্টায়ও। শুধু এটুকুই বলতে পারি- তার অর্ধনিমীলিত চোখ, মোনালিসাময় মুখের নৈর্ব্যত্তিক দৃষ্টি, স্নায়ু চমকানো নিরাসক্ত গলা- আমার চলমান পৃথিবীর প্রতি নিস্পৃহাময় অচেনা ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিল। তবে তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রবীন ভদ্রলোক বেহায়ার মতো বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছেন তন্বী মেয়েটার শরীর- এটা দেখে কেমন যেন বেমানান লাগলো। দু’জনের পরিচয় জানার আগ্রহ বেড়ে গেলেও সীমা অতিক্রম করার আগেই নিজেকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হলাম।
পরেরবার তার দেখা পেলাম চেরাবাজার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কালিকাই ফলস এর পাশে। মোসমাইকে হার মানানো এই কালিকাইকেও হার মানিয়ে দিল মেয়েটা। তবে এখানেও তার ছায়ায় থলথলে শরীরের লোকটা সেই একই ভাবে বিচরণ করছেন দেখে আমার অগ্নিবৎ শরীরে বাসবাসরত গুপ্তচর মন কল্পনায় অ্যাটমিক বোম নিক্ষেপ করতে লাগলো।

মেয়েটা আমাকে এতটাই আকর্ষিত করলো- অবলিলায় ভুলে যেতে পারলাম সেই প্রবীন লোকটাকে। মনে হলো এখানে এই কালিকাই-এ সে আর আমিময়তায় শতশত অর্কিড, অসংখ্য প্রজাপতি ছাড়া আর কেউ নেই। তবে ক্ষণকাল পরেই তার বিষাদময় দৃষ্টি আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়লো। হঠাৎ করে দেখলাম- সে চঞ্চল চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। সাথে কোর্ট টাই পরা সেই লোকটাও কটমট করে দৃষ্টির আগুনে পুড়াতে চাচ্ছেন ঠিকানাহীনতার ছাপ মারা এই আমাকে। নিজেকে ফিরে পেতে একটুও বেগ পেতে হলো না আমার। এলোমেলো ভাবনা শুধুই নিজের জন্য জমা করে সাথে নিয়ে হাঁটা দিলাম সব ভুলে নিজের পথে।
কেইনরেম ফলস-এ আর মেয়েটার দেখা পেলাম না। দূর থেকে দেখা পাহাড়ের মাথায় দূর্গ সাদৃশ্য বিরাট প্রাসাদের সারিতেও মনে মনে খোঁজলাম তাকে। কিন্তু সে হারিয়ে গেছে কালিকাই থেকেই পৃথিবীর পথে খাসি পর্বতের আড়ালে- আমার জীবনের বিজ্ঞাপনে।
পোলো রিসোর্টে রাত্রি যাপন করে পরদিন যখন রওয়ানা দিলাম শিলং-এর পথে তখনও মেয়েটার রেশ রয়ে গেছে আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। যাত্রা পথের শুরুতেই খেয়াল হলো- তার পাগল করা রেশটা শুধু রয়েই যায়নি বরং ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে চলছে। অদ্ভুত একটা অজানা শিহরণ কেন জানি বারবার কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমার সমস্ত আমিত্বকে।

স্বপ্নকে হার মানিয়ে আবারও তার সাথে দেখা হয়ে গেল সোহরা-লাইটকিনসওয়ে আরডি-তে। এবার ঘটনাক্রমে পরিচয়ও হয়ে গেল। তাদের নিশান গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে দেখে স্বেচ্ছায় এগিয়ে গেলাম। নিজ উদ্যোগে বনেট উঠিয়ে সারিয়ে দিলাম সমস্যাটা। ভদ্রলোককে যতটা অসামাজিক মনে করেছিলাম আসলে তিনি তার সম্পূর্ণ বিপরীত- একদম সহজ সরল একজন মানুষ। অঞ্জন দত্ত নামে নিজের পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে মেয়েটাকেও নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। চমকে উঠার সাথে থমকে যাওয়া অবস্থায় ঠিক তখনই তার নামটা জেনে গেলাম। ছুঁয়ে দিতে গিয়ে কামড়ে ধরলো সুখের বৃহস্পতি; সাথে রূপালী আগুন জ্বলে উঠলো প্রেমের বিস্তৃত ভূখণ্ডে।
ঝর্ণার অবস্থানের কথা ভেবেই বাউণ্ডুলে মন নিজ বৈশিষ্ট্যে ফিরে এলো দ্রুত। তার সৌন্দয্য আর রিনঝিন কন্ঠের মাধকতা শুধু ভালো লাগায় সীমাবদ্ধ করে দিলাম- দিতে বাধ্য হলাম। পরস্পরের পরবর্তী গন্তব্য এক জেনে ভদ্রলোক আমার সাহায্যের প্রতিদান হিসেবে উনার গাড়িতে লিফট দিতে চাইলেন। ঝর্ণার দৃপ্ত ভঙ্গিমা, শরীরের স্ফুলিঙ্গ আর অজ্ঞান করা সুগন্ধ লিফটের প্রস্তাবটা গ্রহণ করতে আমাকে বাধ্য করে দিল।
শিলং পৌঁছা অবদি ভদ্রলোক ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে আমার পরিচয়সহ যাবতীয় বিষয়াদি জানতে চাইলেন। আমি দ্বিধাহীনভাবে পাঠ করে গেলাম আমার একাকী নিঃসঙ্গ জীবনের বাউণ্ডুলেময় অধ্যায়গুলো। প্রথমে তিনি সমবেদনা জানালেন। তারপর খোশগল্প জুড়ে দিলেন। কিন্তু আমার মন তার গল্পে আটকালো না; সে বিচরণ করতে লাগলো ঝর্ণাময় ভাবনায়! এটার কারণটা আমি তখন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে ঝর্ণার অঙ্গভঙ্গির হস্তক্ষেপ আর শরীরের নেশাধরা ঘ্রাণের পোস্টমর্টেম করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার নিঃশ্বাস আর তার শরীর বারবারই বিশ্বাসঘাতকা করতে লাগলো দু’জনের সাথেই। তার অনাসৃষ্টিময় ইশারায়- আচ্ছন্নতার প্রশস্ত বিস্তার ঘটাল আমার অন্তরের অন্তরস্থলে।
ভদ্রলোক যখন জানলেন আমার মেঘালয় আসাটা শুধুই ঘুরে বেড়ানো জন্য নয় বরং জীবিকার সন্ধানেও বটে তখন তিনি একটা প্রস্তাব রাখলেন। বিষয়টা আমার জন্য অকল্পনিয় হয়ে গেল। জীবন নামের উপাখ্যানটা নিভৃত প্রকোষ্ঠে বুনোবৃষ্টির গান শুনাতে লেগে গেল তৎক্ষণাত।

ভদ্রলোক দক্ষিণ-পশ্চিম গারো পাহাড়ময় জিকজাক-এ একটা কনভিনিয়েন্স স্টোরের মালিক। স্ত্রী’কে নিয়ে স্টোর সংলগ্ন বিল্ডিং-এ থাকেন। মূলত বিল্ডিং-এর একটা কক্ষই কনভিনিয়েন্স স্টোর। গত বছর পর্যন্ত তিনি কুমারই ছিলেন। এর কারণও অবশ্য পরে জেনেছিলাম- ব্যর্থ প্রেম। কিন্তু শেষ বয়সে এসে কেন জানি হঠাৎ করেই সেই গল্প থেকে বেরিয়ে আসার প্রবল ইচ্ছা জাগলো। উমলিং আর লাসকেইং এর মাঝামাঝি পশ্চিম জয়ন্তিয়া পবর্তের পাশেই এক গরিব পরিবারে বেড়ে ওঠা এতিম ঝর্ণাকে পেয়ে গেলেন অনেকটা স্বপ্নের মতোই। নিঃসন্তান পরিবারটা ঝর্ণাকে খুব ছোট থাকতে খুঁড়িয়ে পেয়ে সাদরেই গ্রহণ করেছি। কিন্তু এরই তিন বছর পর দু’বছরে তাদের সংসারে নিজের দুটি সন্তান আসলো।
সংগত কারণেই ঝর্ণা অবঞ্চিত হয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল তার প্রতি বিশ্বাসের বৃত্ত ধূলিধূসরিত করা উচ্ছ্বসিত মস্করা। তবুও সে সেখানেই পড়ে রইল, বেড়ে উঠল হেলেনের ট্রয়কে হার মানানো এক রূপসী হয়ে। অঞ্জন বাবু চলার পথেই মেয়েটাকে দেখে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। খোঁজ খবর নিয়ে যখন তিনি পালক বাবা-মা’র কাছে গেলেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তখন তারা র্নিদ্বিধায় রাজি হয়ে গেল। দু’দিনের মধ্যেই বিয়ে সম্পন্ন করে তিনি ঝর্ণাকে নিয়ে ফিরে এলেন। এতিম ঝর্ণার নিজের স্বপ্ন আর আশার অকাল মৃত্যু হয়ে গেল বাবার বয়সী স্বামীর পেয়ে। যন্ত্রের মতো এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকলো না তার। তবে স্বামীর সংসারে এসে দারিদ্রতার বেড়াজাল থেকে সে মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু অদৃশ্য একটা অপূর্ণতা দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হতে লাগলো। রাতময় যে বিপর্যস্ত ভগ্নাংশের ক্রুব্ধ অস্থিরতায় ছটফট করতো সে- তাতে ভূমিকম্প বা ঝংকার তোলার সক্ষমতা ছিলনা বিষণ্ণতার প্রলুব্ধে ডুবে থেকে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া অঞ্জন বাবুর।
ভদ্রলোক নিজের ব্যবসা নিজেই দেখাশুনা করতেন- এখনো করেন। কিন্তু একা আর তা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না বিধায় আমাকে উনার স্টোরে কাজ করার প্রস্তাব দিলেন। লোভনীয় একটা বেতনের আশ্বাসও পেলাম উনার কাছ থেকে। ছাপমারা ঠিকানাহীন মানুষ আমি- শুধু এই কারণে নয় বরং অন্য কি একটা তাড়নায় যেন রাজি হয়ে গেলাম। বিসাদৃশ্য বিভোরতায় তৎক্ষণাত প্রজ্বলিত হলো নিষিদ্ধ এক প্রেরণা। গাঢ় সংকল্পে নিমজ্জিত হলো জীবনের বিচ্ছুরিত অনুরাগ।

শিলং শহরে ভদ্রলোকের কিছু জরুরী কাজ শেষ করে পরদিনই আমরা জিকজাক এর পথে রওয়ানা দিলাম। পর্বতশৃঙ্গের দুর্ভেদ্য রহস্যময় বুনো লাবণ্যে আর সবুজ ফড়িং-এর ডানায় ঝর্ণাকে কল্পনায় ঘুম পাড়িয়ে স্বপ্নকে নির্বাক করে দিলাম। স্বপ্নশীল চলা, স্বপ্নময় স্পন্দন আর সঙ্গোপনে লালন করা এক বিপরীতমুখী বীভৎস চিন্তা মস্তিষ্কের কোষে ধারণ করে কোন অঘটন ছাড়াই অবশেষে অচেনা গন্তব্যে পৌঁছিলাম।

প্রথম সপ্তাহ শুধু দেখে দেখেই চলে গেল। পরের সপ্তাহেই শুরু হয়ে গেল নিজের পরিপূর্ণ ডিউটি। এখন আর স্টোর বন্ধ রেখে কোথাও যেতে হয়না ভদ্রলোকের। আমার অনুপস্থিতিতে অঞ্জন বাবু আর উনার অনুপস্থিতিতে আমি। ভদ্রলোক আমাকে খুব আপন করে নিলেন। যদিও উনাকে দাদা ডাকতাম তবুও উনি মনে হয় উনার সন্তান ভেবেই ভালোবাসতেন। কর্মচারীর সাথে যে আচরণ করা হয় তা কখনো প্রকাশিত হয়নি উনার মাঝে।
ঝর্ণা ভূগোলময় টেবিলক্লথে তার ঝরে পড়া অশ্রুর নকশা দেখালো আমায়। ধুলোয় মোড়া সন্ধ্যায় করলো নীরব আমন্ত্রণ। অপূর্ণতার হাহাকার দেখালো নিশুতিরাতে। জ্যোৎস্নায় দেখালো ঘুম ভাঙ্গা স্বপ্নের মাধুর্য্য। ক্লান্ত দুপুরে দেখালো নীল বিছানায়- শূণ্যতার বিদগ্ধতা। টালমাটাল বিকেলের নিঃসঙ্গতায় বাজালো নেশাধরা ঘুঙুর।
আসক্তিময় উদ্বিগ্নতায় ঘটল দীর্ঘ পরাগায়ণ। অদৃশ্য এক সম্মোহনী শক্তি আমাকে ঝর্ণার সৌন্দয্যের মোহমায়া থেকে কিছুতেই বের হতে দিল না। অথচ এ জটিলতা থেকে, এ দোটানার নিন্দিত নির্বাসন থেকে আমার বের হয়ে আসা উচিত তা আমি খুব ভালোভাবেই তখন বুঝেছিলাম।

কিন্তু আমি ক্ষণে ক্ষণে ডুবেই যেতে লাগলাম আরও গভীরে। একদিন হিরণ্ময় মুহূর্তে উষ্ণতার শুভ্রতায় যখন ঝর্ণা আর আমি মিলেমিশে একাকার হচ্ছিলাম তখন ধরা পড়ে গেলাম অঞ্জন বাবুর কাছে। তবে আমাকে ভাবনার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে তিনি যেন কিছুই দেখেননি, কিছুই বুঝেননি এমন ভাব নিয়ে স্বাভাবিকই রয়ে গেলেন।
যেদিন ঝর্ণার অন্তঃসত্ত্বার সুসংবাদ এলো সেদিন অঞ্জন বাবুকে বেশ উৎফুল্ল দেখা গেল। অথচ তিনি জানতেন সন্তানটা তার নয়। তিনি যে সন্তান দানে অক্ষম ছিলেন তা আমিও জানতাম। উনার রিপোর্টটা আমিই বহন করে এনে উনাকে দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিলেন- বিষয়টা যেন আমরা দু’জন ছাড়া এখানকার আর কেউ না জানে।
আমি আমার কথা রেখেছিলাম। কাউকে বলিনি- এমনকি ঝর্ণাকেও নয়। কিন্তু এখন যে সুখবর প্রকাশিত হয়েছে তার মর্মার্থ আমরা তিনজনই জানি।

দুপুরে পর পরই অঞ্জন বাবু ঝর্ণার সামনেই আমাকে জানালেন- সদ্য প্রাপ্ত সুখবর উপলক্ষ্যে তিনি ঝর্ণাকে নিয়ে চেরাপুঞ্জিতে বেড়াতে যাচ্ছেন। ফিরতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যাবে- আমি যেন সবকিছু ভালোভাবে দেখে রাখি।
আমাকে জানানোর দু’ঘন্টার মধ্যেই তারা বেরিয়ে পড়লেন। সর্বগ্রাসী অদ্ভুত একটা অনুভব সঞ্চারিত হলো আমার সমস্ত অস্তিত্বে। উৎকন্ঠার ছায়া সরে গিয়ে শুরু হলো অবিশ্রান্ত ক্রিমিনাল বৃষ্টি। দ্রুতালয়ে গড়িয়ে চলতে লাগলো সময়।

দু’দিন পর খবর এলো মোসমাই গুহায় যাওয়ার পথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অঞ্জন দত্তের গাড়িটা গভীর খাদে পড়ে গেছে। ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন তিনি আর তার স্ত্রী। খবরটা শুনে পরিচিতজনরা অবাক হলেও আমি ঠিক এরকম খবরের অপেক্ষায় বসে ছিলাম সেই মুহূর্ত থেকেই- যেই মুহূর্তে তারা এখান থেকে বের হয়েছিলেন।
এবার হুইলের কাজে হাত দেব ভাবছিলাম। এমন সময় এক উকিল ভদ্রলোক এলেন আমার সাথে স্বাক্ষাত করতে। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে তিনি জানালেন- অঞ্জন দত্ত তার এখানকার যাবতীয় সম্পত্তি আমাকে দান করে দিয়ে গেছেন!
আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কোন বাঁধা নেই। দাবী করার মতো ভদ্রলোকের কোন আপনজনও নেই। আর উনার সম্পত্তি বলতে শুধু এখানকার কনভিনিয়েন্স স্টোর আর স্টোর সংলগ্ন বাড়িটাই।

পৃথিবীর কেউ জানে না ঠিকানার খোঁজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই আমি ঘুরে বেড়িয়েছি শতশত মাইল। কিন্তু হয়নি আমার একটা ঠিকানা। সেই অবুঝ মনে লাগা দাগটা অবশেষে একটা প্রহসনের প্রসস্থ বিস্তার ঘটালো। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াল রমনীর শরীরের ভাঁজে। যদিও আমার নামে করে যাওয়া অঞ্জন দত্তের হুইলটা রহস্যময়ই ছিল তবুও নিজের বুদ্ধি আর দক্ষতায় দু’টি জীবনের বিনিময়ে অবশেষে আমার একটা ঠিকানা হয়ে গেল। আর তার সাথে প্রেমময় একটা মানুষকে হারানোর বেদনাসহ হৃদয়ের আঙিনায় উঁকি দিতে লাগলো একটা ঝর্ণাময় অনুভব।

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ