কুরবানীর গুরুত্ব ও ফজিলত


ইসলামি দিবসগুলোর মধ্যে ঈদুল আজহা হলো অন্যতম। পশু কোরবানির মাধ্যমে এই দিনে আত্মত্যাগের অপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ঘরে ঘরে দ্বীনি আমেজে প্রাণ স্পন্দিত হয়। ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির গভীর বন্ধনে শান্তির সুবাতাস বয়ে চলে। দীনহীন অনাথ এতিম এক দিনের জন্য হলেও নিজেদের অধিকার ফিরে পায়। মানুষ হাসিমুখে একে অপরের সাথে মিলিত হয়। কুরআন-হাদিসে কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনে পাকের সবচেয়ে ছোট সূরা আল-কাওছারে বলেছেন,ন “‘অতএব তুমি তোমার প্রভুর উদ্দেশে নামাজ পড়ো এবং কোরবানি করো।” (কাউসার-২)

কোরবানি আন্তরিকতা ছাড়া কবুল হয় না। আল্লাহর প্রতি নিবেদিত প্রাণ হয়ে শরিয়তের প্রতি অগাধ আস্থা সহকারে কোরবানি পেশ করতে হবে।

মানবজাতির জন্য আল্লাহ পাকের তরফ থেকে যত শরিয়ত নাজিল হয়েছে প্রত্যেক শরিয়তে কোরবানির হুকুম ছিল। সব উম্মতের ইবাদতের এক অপরিহার্য অংশ কোরবানি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক রীতিনীতি নির্ধারণ করেছি যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহ তায়ালার নাম নিতে পারে, যেগুলো তিনি তাদেরকে দান করেছেন।” (সূরা হজ্ব,-৩৪)

আদি পিতা হজরত আদম আ:-এর সন্তান হাবিল ও কাবিল প্রথম কোরবানি করেন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “ আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা শুনিয়ে দিন যখন তারা দুইজনেই কোরবানি করল, তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো অপরজনের কোরবানি কবুল হলো না।” (সূরা মায়িদা, ২৭)

আল কুরআনে হজরত ইব্রাহিম আ:কে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে আর কোরবানি তারই অন্যতম সুন্নাত ও আদর্শ। আর কোরবানির সাথে যে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা রয়েছে তা আল-কুরআনের সূরা সাফ্ফাতের সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন সে (ইসমাঈল আ:) তার সাথে চলাফেরার বয়সে পৌঁছল তখন একদিন ইব্রাহিম (আ:) তাকে বলল : প্রিয় বৎস! স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যেন জবেহ করছি। ‍তুমি চিন্তা করে বল তোমার অভিমত কি? পুত্র বিনা দ্বিধায় বলল, আব্বা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে, তা শিগগির পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীল দেখতে পাবেন। অবশেষে পিতাপুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করলেন এবং ইব্রাহিম (আ:) পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন (জবেহ করার জন্য) তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, ইব্রাহিম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এ রূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার পরিবর্তে দান করলাম এক মহান কুরবানীর পশু । আর পরবর্তি উম্মতের জন্য ইব্রাহিমের এ সুন্নাতকে স্মরণীয় করে রাখলাম। ইব্রাহিম (আ:)-এর ওপর সালাম বর্ষিত হোক। আর এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চিতরূপে সে মুমিন বান্দাদের মধ্যে শামিল।”(সাফ্ফাত-১০২-১১২)

তাফসিরে এসেছে, হজরত ইব্রাহিম আ: তদীয় পুত্র ইসমাঈল আ:কে জবেহ করতে বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থমনোরথ হলে ছুরি হাত থেকে ফেলে দেন। এমতাবস্থায় হজরত জিবরাঈল আ: ওহি প্রত্যাদেশে হজরত ইসমাঈল আ:-এর বদলে কোরবানির জন্য একটি দুম্বা নিয়ে হাজির হলেন। এভাবে কোরবানিপ্রথা অদ্যাবধি চলে আসছে।

কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহভীরু মন থাকা শর্ত। নির্ভেজাল চেতনাসহকারে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কোরবানি করতে হবে। আল-কুরআনে এসেছে ‘আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হলো, তিনি আল্লাহভীরু পরহেজগারদের কর্মই গ্রহণ করেন।’ সব দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত কেবল আল্লাহর উদ্দেশে হতে হবে।

সামাজিক লৌকিকতা ও অহমিকা থাকলে কোরবানিসহ কোনো ইবাদতই গ্রহণযোগ্য হবে না।

মূলত গোশত ও রক্তের নাম কোরবানি নয়, কোরবানি হলো আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালন, আত্মত্যাগ এবং সব কুপ্রবৃত্তির ওপর ছুরি চালানোর নাম। অসদুপায়ে উপার্জিত সম্পদ দিয়ে কোরবানি করলে তা গৃহীত হবে না। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহ তায়ালা হালাল বস্তু ছাড়া আর কোনো কিছুই কবুল করেন না। ( বুখারী)

সাধারণত যাদের ওপর জাকাত ফরজ তাদের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। জাকাতের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ মালামাল পুরো এক বছর বর্তমান থাকা শর্ত। তবে কোরবানির ক্ষেত্রে শুধু জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ মাগরিব পর্যন্ত সময় নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেও কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে কোরবানি করার জোর তাগিদ দিয়ে রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের ধারেকাছেও না আসে। (ইবনে মা-জাহ)

কোরবানির পশুর চোখ-কান ভালো করে দেখে নেয়ার জন্য রাসূল সা: তার সাহাবিদের নির্দেশ দিতেন। তিনি বলতেন, তোমরা এমন পশুর কোরবানি কোরো না যার কানের অগ্রভাগ বা গোড়ার অংশ কাটা, কানের অংশ ছিদ্র বা যার কান লম্বালম্বিভাবে ফেঁড়ে দেয়া হয়েছে। খোঁড়া জন্তু যার খোঁড়ামি সুস্পষ্ট, অন্ধ পশু যার অন্ধত্ব পুরোমাত্রায় বিদ্যমান, রোগাক্রান্ত ও ক্ষীণকায় পশু রোগের কারণে যার হাড়ের মজ্জা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে তা কোরবানি করা যাবে না।’

উট, গরু, মহিষ, ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া ছাড়া অন্য কোনো পশু দিয়ে কোরবানি করলে তা জায়েজ হবে না। একটি উট, গরু বা মহিষ সাত ভাগে কোরবানি করা যায়। এতে একজনে একা বা পৃথক পৃথক সাতজনে কোরবানি করলেও সহিহ হবে। সবার নিয়ত বিশুদ্ধ হতে হবে। ছাগল, দুম্বা ও ভেড়ার শুধু এক ভাগ কোরবানি হবে। দুম্বা, ছাগল ও ভেড়ার বয়স পূর্ণ এক বছর হতে হবে। তবে এসব পশু এক বছর বয়সের আদৌ পাওয়া না গেলে দেখতে এক বছর বয়সের মতো লাগে, ছয় মাস বয়সের হলেও এমন চলবে। গরু ও মহিষ পূর্ণ দুই বছর এবং উট পাঁচ বছর বয়সের হতে হবে। তার কম বয়সের হলে কোনোটির কোরবানি জায়েজ হবে না। কোরবানির গোশত নিজে খাবেন এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বণ্টন করবেন। এক-তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করে বাকিটুকু নিজের জন্য এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ভাগ করাই উত্তম। গরিবদের মধ্যে তার কম বিতরণ করলেও তেমন দোষ নেই। রাসূল সা:-এর সময়ে কোরবানির নিয়মকানুন প্রসঙ্গে সাহাবি আবু আইয়ুব আল অনছারী র: বলেন, ‘তখন সামর্থ্যবান ব্যক্তি তার ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কোরবানি করত এবং তা নিজেও খেত, অন্যদেরও খাওয়াত। অবশেষে লোকেরা গর্ব ও আভিজাত্যের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলো। ফলে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তা তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছ।’

কোরবানি একটি মহা পবিত্র ধর্মীয় বিধান। এ কাজে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া কিছুতেই উচিত নয়। ইসলামি শরিয়ত যেভাবে এ মহান বিধান পালনের জন্য নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা দান করেছে, আমাদের উচিত সেভাবেই তা আন্জাম দেয়া। আল্লাহ পাক সবাইকে গ্রহণযোগ্য কোরবানি করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন!!!

লেখকঃ
দারুল হাদীস (এম.এ, ইসলামিক স্টাডিস)
জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ