অনু গল্পঃ চোরের মেয়ে

আকাশ জুড়ে রাশি রাশি কালো মেঘ,ধীরে বয়ে চলা দখিনা বাতাস অকস্মাৎ থেমে গিয়েছে।এটা ঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ।বর্ষাকালে এটা নিয়মিত ঘটনা।প্রায়ই হুলস্থূল করে ঝড় আসে আবার হুড়মুড় করে থেমেও যায়।এরপর শুরু হয় টিপটিপ বৃষ্টি।প্রায় সারাদিন চলে বৃষ্টির এই টিপটিপানি।গ্রামের রাস্তা ঘাটের অবস্থা তখন হাঁটার উপযোগী থাকে না।রাস্তার আঠালো মাটি ভিজে গিয়ে এমন অবস্থা হয় যে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে হাঁটাতে গেলে স্যান্ডেল আটকে যায় মাটিতে আর মানুষ আটকে থাকে রাস্তায়।মাটির রাস্তায় হাঁটতে নারাজ মানুষ তখন প্রাণ খুলে অত্র এলাকার চেয়ারম্যানের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে,আচ্ছামত গালাগাল দেয়,ভবিষ্যতে ভোট না দেয়ার শপথ নেয়।সুন্দলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহেদুল করিমের কানে এসব কথা আসলেও কানে তোলে না সে।চেয়ারম্যান সাহেব জানে নির্বাচনের আগে কিছু টাকা ছিটালেই ভোটের পরীক্ষায় পাশ করা যাবে।

শাহেদুল করিমের একমাত্র মেয়ে ফারহানা করিম বসে আছে জানালার পাশে। ঝড় আসবে না বৃষ্টি আসবে এই নিয়ে তার ভ্রূক্ষেপ নেই।তার দৃষ্টি দক্ষিণ দিকের জানালার কার্নিশে বসা দুটো চড়ুই পাখির উপর।যারা ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে।একটু পরপরই এরা একে অন্যের উপর উঠানামা করছে।ক্ষুদ্র এই পাখি দুটোর সঙ্গম দৃশ্য খানিকটা এলোমেলো করে দেয় ২৬ বছর বয়সী ফারহানাকে,শরীরটা কেমন চড়চড়িয়ে উঠে।হাসানকে মনে পড়ছে খুব,লকডাউনের এই সময়টাতে হাসানের সাথে সময় কাটাতে পারলে কি মজাই না হতো।হাসান এই এলাকারই আজমত মাস্টারের ছেলে,ফারহানার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত।সেখান থেকেই মন দেয়া নেয়া শুরু।এরপর দীর্ঘ দিন চলে তাদের সম্পর্ক।ঢাকা শহর হওয়ায় তাদের সম্পর্কের কথা কেউ জানতে পারে নি।তারাও এই সময়ে পরিবারকে বিষয়টি জানাতে চায় নি।হাসান একটা ভালো চাকরি পেলেই বাবাকে বিয়ের কথা বলবে ভেবে রেখেছিল ফারহানা।কিন্তু গ্রামে দুয়েক বার হাসানের সাথে দেখা করায় তার বাবা বিষয়টা জেনে গিয়েছেন এবং স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন সামান্য একজন স্কুল মাস্টারের ছেলের সাথে ফারহানার বিয়ে তিনি দিবেন না।ফলে হাসানের সাথেও আর যোগাযোগ করার কোন মুখ তার নেই।

গ্রামে তেমন বন্ধু বান্ধবও নেই ফারহানার।চেয়ারম্যানের মেয়ে হওয়ায় সাধারণ মানুষ তার কাছে তেমন একটা আসতে চায় না।সে ইচ্ছে করে কারো সাথে মিশতে চাইলেও তারা নিজেদের সংকুচিত করে রাখে,কেমন ভয়ার্ত চোখে তাকায়।বিরক্ত লাগে ফারহানার,চেয়ারম্যানের মেয়ে বলে কি সে কারো বন্ধু হতে পারে না?আর প্রাণ খুলে কথা বলতে না পারলে কি আর বন্ধু হওয়া যায়?তাই অঘোষিত লকডাউনের এই সময়টাতে বন্ধুহীন অবস্থায় চার দেয়ালের মাঝেই সময় কাটছে ফারহানার।মাঝে মাঝে বাগানে বসে বই পড়া ছাড়া রুম থেকে বের হয় না সে।ঝড়ের পুর্বাভাস পেয়ে রুমের লাইট,ফ্যান বন্ধ করে জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ফারহানা।
ধীর পায়ে শাহেদুল করিম কখন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা টের পায় নি সে।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে চেয়ারম্যান সাহেব বলেন,
-কিরে মা,মন খারাপ?
বাবার কথার কোন উত্তর দেয় না ফারহানা।হাসানকে প্রত্যাখ্যান করা ও কিছুদিন আগে বাবার এক কুকীর্তির কারনে বাবার উপর প্রচণ্ড রেগে আছে সে।মেয়ের মন ভালো করতে নিজের পরিবর্তিত সিদ্ধান্তটি মেয়েকে জানায় শাহেদুল করিম ,
-মা রে,হাসানকে ফোন দিস।করোনার প্রকোপ শেষ হলেই তোদের বিয়ের আয়োজন করবো।
আচমকা নিজের সব রাগ উগড়ে দিয়ে বাবার কথার জবাব দেয় ফারহানা,
-হাসানকে আমি ফোন দিবো কোন মুখে বাবা? আর হাসানই একজন চোরের মেয়েকে বিয়ে করতে যাবে কোন দুঃখে?
কিছুদিন আগে ৫০০ বস্তা ত্রাণের চাউল আত্মসাতের মামলায় ১৫ দিন জেল খেটে আসা চেয়ারম্যান সাহেব মেয়ের কথায় দারুণভাবে চমকে উঠলেন।

লেখকঃ
বিমানবন্দর, ঢাকা থেকে

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ