অণু গল্পঃ ভুল ভালোবাসা

রিমনের বাবার চিকিৎসার জন্য জলের মতো টাকাগুলো খরচ হয়ে গিয়েছিল, তবুও বাবাকে বাঁচাতে পারেনি সে। যা অবস্থা আজ পৈত্রিক ভিটেটুকু ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই নেই। মা ছাড়া এই পৃথিবীতে রিমনের নেইও কেউ আর। বাবা মারা যাবার পর প্রচুর কষ্ট হলেও ভেঙে পড়েনি এতটুকু।
পড়াশুনায় মেধাবী রিমন টিউশনি করেই সংসারের খরচটুকু সামলে নিচ্ছিল। তারপর যখন এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে পেল, মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিল রিমন। আজকের দিনে বাবা বেঁচে থাকলে কত খুশীই না হত।
তমলুক শহর থেকে বেশ কিছুটা দুরে এক নামী স্কুলের মাস্টার রিমন। একটা পাড়ায়- মাকে নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকে। পৈত্রিক বাড়িটা দুর সম্পর্কের এক ফুফুকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।
কয়েক মাসেই রিমন যেমন স্কুলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তেমনই পাড়ায়ও। জলিল সাহেবের মেয়ের বিয়েতে হাসতে হাসতে অনেক দায়িত্ব নিজেই নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। বর আসতে একটু দেরী হচ্ছে দেখে উপস্থিত নিমন্ত্রিতদের খেতে বসিয়ে তার দেখভাল করছিল সে।
হঠাৎ একটা হৈচৈ শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখে- তিন মাস আগে পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়া সেই পরিচয়হীন পাগল যুবকটা ফিরে এসে ঢুকে পড়েছে বিয়ে বাড়িতে।
চুপচাপ স্বভাবের পাগলটা হঠাৎ করেই ক্ষেপে গেল, চিৎকার শুরু করে দিল কনের সাজে সাজা ঝুমার নাম ধরে- ঝুমা, তুমি আমার, শুধুই আমার। কিছুতেই অন্যর হতে পারনা। আমি এ হতে দেবনা…
কেউ কিছু বুঝার আগেই জলিল সাহেব হাতে একটা লাঠি নিয়ে ছুটে গেলেন পাগলটার দিকে। রিমনও দৌড় দিল; কিন্তু সে পৌঁছার আগেই জলিল সাহেব যুবকের মাথায় বসিয়ে দিলেন এক ঘা। মাটিতে পড়ে গেল পাগল যুবক। দ্বিতীয় আঘাতটা অবশ্য রিমন থামাতে পারল। কিন্তু ততক্ষণে নিজের রক্তে ভিজে গেল যুবক। তবুও অবিরত- “ঝুমা তুমি আমার” এ কথাটাই বলতে থাকল।
হুলস্থুল একটা কান্ড! বরপক্ষের আসি আসি সময়। এমন বিশ্রী অবস্থায় কেউ বুঝতে পারছেনা কি করবে। জলিল সাহেবকে কোনভাবেই সামলানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে পাগল যুবক রক্তক্ষরণে ধীরে ধীরে ক্লান্ত হচ্ছে
আর কখনো ক্ষীণ স্বরে কখনো উচ্চ স্বরে ঝুমাকে ডেকে যাচ্ছে।
রিমন হাঁটু গেড়ে বসলো রক্তাক্ত যুবকের পাশে। কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বললো। মোহগ্রস্ত এক দৃষ্টি উপহার দিল পাগল যুবক। মলিন একটা হাসি দিয়ে রিমনের সাথে উঠে দাড়াল এবং তার সাথে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো বিয়ে বাড়ি থেকে।
গ্রামটার দক্ষিণে বিশাল এক অরণ্য; তার উপত্যকায় একটা ছোট্ট বাজার। সেখানে বসবাসরত একমাত্র ডাক্তারের কাছে আহত যুবককে নিয়ে যাচ্ছে রিমন। তারা যখন বাজারের কাছাকাছি এক নির্জন স্থান অতিক্রম করছে তখন হঠাৎ করে কেউ একজন পিছন থেকে দৌঁড়ে এলো।
ঝুমাকে দেখে চমকে ওঠে রিমন। আর পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল পাগল যুবক। মুহূর্ত সময় পর ঝুমা ঝাপ দিল যুবকের বুকে। ঝুমার আলিঙ্গনে জ্ঞান হারালো পাগলটা। কাহিনীটা অনেকটাই বোধগম্য হয়ে গেল রিমনের কাছে।
কিন্তু হঠাৎ করে তাকে অবাক করে দিয়ে ঝুমা আলতো করে যুবককে শুইয়ে দিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়ালো আর জ্ঞানহীন পাগল যুবক অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে পড়ে রইল সবুজ ঘাসের গালিচায়, রিমনের ভাবনার আঙিনায়।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
