চাহিদা
প্রায় ছ’মাস পর নাদিম অনেক কষ্টে ছুটিটা পেয়েছে। ৩২/বি কমান্ডের জুনিয়র লেফটেন্যান্ট নাদিম চৌধুরী গত বছর থেকেই এই হিল-এ পোস্টেড আছে। বেশ আগে থেকেই সে চেষ্টা করছে; অনেক অনুনয় বিনয়েও ওপরওয়ালাদের মন গলাতে পারেনি। কিন্তু এবারে সহজেই কাজ হাসিল হয়েছে। স্ত্রী মৌমিতাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে সে কথা। আগামী পরশু প্যাকিং করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে।
নিশ্চিত মনে রাতের খাওয়ার খেয়ে শুতে গেল নাদিম। মোবাইলটা মিষ্টি আওয়াজে বেজে উঠল। এই সময় মৌমিতা প্রতিদিন ফোন করে। কিন্তু এতো মৌমিতার নয়- আননোন নাম্বার!
ফোনটা রিসিভ করার আগেই কেন জানি নাদিমের মেরুদণ্ড বেয়ে হিম শীতল একটা অনুভূতি বহে গেল। আর যখন রিসিভ করে কন্ঠটা শুনলো তখন জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হয়ে গেল তার। অপর প্রান্ত থেকে শুধু একটা বাক্যই উচ্চারণ হয়েছিল- সব ফাঁস হয়ে গেছে।
নাদিম জানে এবার নিশ্চিত কোর্ট মার্শল হবে। আর তারপর কি হবে তাও তার অজানা নয়। কিন্তু নাদিম বেঁচে থাকতে চায়। তাই সিদ্ধান্ত নিল সাথে সাথেই। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মুহূর্তের নোটিশে চুপচাপ ব্যারাক ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
এই অনিশ্চিত যাত্রায়- নাদিমের মন চলে গেল বছরখানেক আগে। সদ্য বিয়ে করা বউকে বাড়িতে রেখে ফিরে এসেছিল ব্যারাকে। বিগত আট রাতের উষ্ণতার রেশ তার নিঃসঙ্গ সৈনিক জীবনটাকে খুব ভোগাতে লাগলো।
জৈবিক চাহিদাটা এতই তীব্র হলো যে- তখন পাহাড়ি তরুণী রূপসী হেপীর হাতছানি পৃথিবীর অন্য সব কথা ভুলিয়ে দিল। চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে ডুবিয়ে দিল তন্বী দেহের অতলে।
ঘুর্ণাক্ষরেও ফাঁদটা বুঝে উঠতে পারেনি সে। কিন্তু যখন বুঝলো তখন তার আর কিছুই করার থাকলো না। তবে হেপী তার প্রতিদান দিতে কোন কার্পণ্য করেনি কখনো। নাদিমও সব ভুলে যায় হেপীর সেই কামনার ঢেউ-এ।
অবশেষে সে দেশদ্রোহিতা করতে বাধ্য হয়; বলা যায় একটা অপরূপ নারী দেহের কাছে সে হেরে যায়। ৩২/বি কমান্ডের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয় হেপীর কাছে।
তৃপ্তির ঢেকুর তুলে হেপী। আর নাদিম সমস্ত শরীরে হঠাৎ বহে যাওয়া এক অনুভূতি শেষে ক্লান্তিতে নিথর হয়ে পড়ে থাকে হেপীর উন্মুক্ত বুকে।
যখন ভাবনার সুঁতা কেটে যায় তখন সে ব্যারাক থেকে প্রায় পনেরো মাইল উত্তরের একটা নির্জন পাহাড়ি পাকা রাস্তায় দাড়িয়ে।
হঠাৎ একটা গুলির শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে যায় । তীব্র ব্যথা অনুভব করে সে তার ডান উরুতে। বসে পড়তে বাধ্য হয়।
এমন সময় দেখে বেশ অনেকটা দূরে- ৩২/বি কমান্ডের একদল সৈন্য তার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। চোখের জলে নাদিমের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। বেঁচে থাকার আকূল এক আকাঙ্ক্ষা জাগে মনে।
কিন্তু সে জানে জীবনের সমাপ্তি এখানেই। তার নশ্বর দেহের তীব্র চাহিদা তাকে ডুবিয়ে দিল অবশেষে। দেশদ্রোহিতার অভিশাপ নিয়ে জীবনাবসান হতে যাচ্ছে তার। কিছুই করার নেই এ মুহূর্তে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া।
ধীরে ধীর দু’হাত তুলতে লাগলো মাথার ওপর। এমন সময় হঠাৎ করেই ঘটল একটা অদ্ভুত ঘটনা। কোথা থেকে একটা গাড়ি তীর বেগে এসে থামল তার কাছে। মেয়েলি একজোড়া হাত তাকে দ্রুত তুলে নিল এবং তাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
ক্ষণকাল পর রাতের ধূসর আধারের মাঝে নাদিমের ঝাপসা দৃষ্টিতে ধরা দিল হেপীর মিষ্টি হাসি আর তার টানাটানা দু’টি চোখ।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান