জিলহজ্জের প্রথম দশকের করণীয় (পর্ব তিন)

পবিত্র জিলহজ্জের প্রথম দশকের নবম দিন তথা আরাফার দিন হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতের দিন। ঐ দিন লক্ষ লক্ষ হাজীদের উপস্থিতিতে মক্কার কিছু দূরবর্তী আরাফার ময়দানে খতিব সাহেবের খুতবা আর হাজীগনের আমিনের ধ্বনিতে বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে মূখরীত হয়ে উঠে আরবের আকাশ-জমিন। সেখানে গিয়ে যারা উপস্থিত হন আল্লাহ তায়ালা তাদের জীবনের গুনাহগুলো মাফ করে দেন। আর যারা যেতে পারেননি তাদের জন্য ও আল্লাহ গুনাহ মাফ করানোর কিছু সুযোগ দান করেছেন। সুতরাং কুরআন হাদিসের আলোকে ঐ দিনের কিছু ফজিলত ও গুনাহ মাফের সুযোগ গুলো জেনে নেই।

দ্বীন ইসলাম পূর্ণাঙ্গ হওয়ার দিন।

আল্লাহ তায়ালা ইসলাম ধর্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম হিসেবে তার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দান করেছিলেন। ইসলামে এমন কোন বিষয় নেই যে বিষয় মানবজাতির জন্য দরকার আর তা নেই। বরং সৃষ্টি জগতের সবার জন্য যা দরকার এবং যার যে অধিকার তা একমাত্র ইসলাম ধর্মেই আছে। এজন্য এটা হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ একটি ধর্ম। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দীর্ঘ ৬৩ বছরের বিশেষ করে নবুওয়তের পরবর্তি ২৩ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছে। আর এই পূর্ণাঙ্গতার স্বীকৃতি আল্লাহ নিজেই যেদিন ঘোষণা করেছেন সে দিন ছিল পবিত্র আরাফার দিন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত ত্বারিক ইবনে শিহাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়াহূদীগণ হযরত উমার ফারূক (রাঃ) কে বলল যে, আপনারা এমন একটি আয়াত পড়ে থাকেন তা যদি আমাদের মধ্যে নাযিল হত, তবে আমরা সেটাকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করতাম। তখন হযরত উমার (রাঃ) বললেন, আমি জানি এটা কখন নাযিল হয়েছে, কোথায় নাযিল হয়েছে এবং নাযিলের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় ছিলেন, আয়াতটি আরাফাতের দিন নাযিল হয়েছিল। আল্লাহর শপথ আমরা সবাই সে দিন আরাফাতে ছিলাম, সেটি হলো সূরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াত- “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম”।

আরাফার দিন হচ্ছে ঈদের দিন।

আমরা জানি ঈদ অর্থ হচ্ছে খুশি বা আনন্দ। মুসলিম জাতির জন্য যদিও শরীয়তে মূলত দুটি ঈদ আছে তারপরও আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিধান অনুযায়ী ইসলামে আরো কিছু ঈদের দিন রয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে মুসলিমদের জন্য খুশি বা আনন্দের দিন হিসেবে পরিচিত। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পবিত্র আরাফার দিন। কারণ পূর্বেই আমরা বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস উল্লেখ করেছি এই দিন ইসলাম ধর্মকে আল্লাহ পূর্ণাঙ্গ ও মনোনীত ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাই এটা মুসলিমদের জন্য ঈদেন দিন। হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি বহু সনদের মাধ্যমেও বর্ণিত হয়েছে। ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেন যে, হযরত কাব (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ) কে বলেন, যদি অন্য কোন উম্মতের উপর এ আয়াতটি অবতীর্ণ হতো তবে তারা ঐ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার দিনটিকে একটি ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করতো এবং সেই দিনে তারা সকলেই একত্রিত হতো। তখন হযরত উমার (রাঃ) হযরত কাব (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কোন, আয়াত? তিনি উত্তরে বললেন-
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম”। তখন হযরত উমার (রাঃ) বললেন, আমি এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার দিন ও সময় সম্পর্কে জানি। ওটা ছিল পবিত জুমার ও আরাফার দিন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, এ দুই দিনই আমাদের ঈদের দিন”।

হযরত ইবনে জারীর (রঃ) আম্মারা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, একদা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতটি পাঠ করেন। তখন একজন ইয়াহূদী তাঁকে বলল, যদি এ আয়াতটি আমাদের উপর অবতীর্ণ হতো তবে আমরা ওর অবতীর্ণ হওয়ার দিনকেই ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করতাম। উত্তরে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন ওটা দুটি ঈদের দিনে অবতীর্ণ হয়েছে। একটি ঈদের দিন এবং অপরটি জুমার দিন”। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)

 আল্লাহ এ দিনের শপথ করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে যখনি যেটার শপথ করছেন তখনি তার গুরুত্ব কিন্ত বহুগুন বেড়ে গেছে। কারণ আল্লাহ এমনিতেই কোন কিছুর শপথ করেননি। বরং যেটার গুরুত্ব, মর্যাদাও ফজিলত রয়েছে সেটার শপথ করেছেন। তেমনি আল্লাহ তায়ালা আরাফার দিনের ও শপথ করেছেন। সূরা ফজরের ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “শপথ জোড় ও বেজোড়ের”।

উক্ত আয়াতের তাফসীরে মুসনাদে আহমদের হাদীসে এসেছে- “হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- বেজোড় এর অর্থ আরাফার দিন (যিলহজ্জের নবম তারিখ) এবং জোড় এর অর্থ ইয়াওমুন্নাহার (যিলহজ্জের দশম তারিখ)”।

তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল-ইয়াউমুল মাওঊদ (সূরা বুরূজ ২) অর্থ-ক্বিয়ামাতের দিন, আল-ইয়াউমুল মাশ্হুদ (সূরা হূদ ১০৩) অর্থ- আরাফাতে (উপস্থিতির) দিন এবং আশ-শাহিদ (সূরা বুরূজ ৩) অর্থ- জুমার দিন”।

 প্রতিশ্রুতি গ্রহণের দিন।

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে আরাফার দিনে নুমান নামক জায়গায় আল্লাহ তায়ালা আদম সন্তান হতে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। হযরত আদম (আঃ) এর সকল সন্তানদেরকে তার পৃষ্ঠদেশ হতে বের করলেন এবং তাদেরকে নিজের সামনে (পিপীলিকার মত) ছড়িয়ে দিলেন ও তাদের থেকে এ স্বীকারোক্তি নিলেন।

সূরা অরাফের ১৭২ ও ১৭৩ নম্বর আয়াতের তাফসীরে মুসনাদে আহমদের হাদীসে উল্লেখা আছে- “হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, নিশ্চয় আল্লাহ নামানে -অর্থাৎ আরাফার ময়দানে- আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। তিনি আদমের মেরুদণ্ডে তাঁর যত বংশধরদের রেখেছেন তাদের সবাইকে বের করে এনে অণুর মত তাঁর সামনে ছড়িয়ে দেন। এরপর সরাসরি তাদের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা সকলে বলেন হ্যাঁ অবশ্যই আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা এ জন্যে যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন না বল, আমরা তো এ বিষয়ে গাফেল ছিলাম। কিংবা তোমরা যেন না বল, আমাদের পিতৃপুরুষরাও তো আমাদের আগে শির্ক করেছে, আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর, তবে কি (শির্কের মাধ্যমে) যারা তাদের আমলকে বাতিল করেছে তাদের কৃতকর্মের জন্য আপনি আমাদেরকে ধ্বংস করবেন”।

মুসনাদে আহমদে আরেকটি হাদীস রয়েছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ আরাফাবাসীদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গৌরব করে বলেন, আমার বান্দাদের দিকে তাকাও তারা এলোমেলো চুল ও ধুলোমলিন হয়ে আমার কাছে এসেছে”।

 বেশি বেশি ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া।

এই দিন যেহেতু আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের খুব নিকটে তথা জমীনের আকাশে এসে গুনাহগারদের গুনাহ মাফ করে দেন। তাই আমাদের উচিত হবে সে দিন বেশি বেশি তাওবাহ ইস্তেগফার করে কৃত গুনাহের জন্য মাফ চাওয়া ও দোযখের আগুন থেকে পানাহ চাওয়া। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আরাফার দিনের তুলনায় এমন কোন দিন নেই যেদিন আল্লাহ তায়ালা সর্বাধিক লোককে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হন, অতঃপর বান্দাদের সম্পর্কে মালায়িকার সামনে গৌরব করেন এবং বলেন তারা কী উদ্দেশে সমবেত হয়েছে (বা তারা কী চায়)”?

আরাফার দিনের রোজা।

এই দিনের আমল সমুহের মধ্যে অন্যতম একটি আমল হচ্ছে নফল রোজা রাখা। যারা যিলহজ্জের প্রথম থেকে রোজা রাখতে সক্ষম হবে না তারা যেন অন্তত এই দিনের রোজা রাখা থেকে বঞ্চিত না হয়। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আরাফার দিনের রোজা সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী বছর ও পরবর্তী বছরের গুনাহের ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে”।

 হাজীগন রোজা রাখবেন না।

যারা হজ্জে গিয়েছেন, তাদের জন্য আরাফার দিন রোজা না রাখা উচিত। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত উম্মুল ফাযল বিনতে হারিস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা আরাফার দিন তার নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রোজা পালন (করা না করা) সম্পর্কে আলোচনা করছিল। তাদের কেউ কেউ বলল তিনি রোজা নন। এরপর আমি তাঁর নিকট এক পেয়ালা দুধ পাঠালাম, তিনি আরাফাতে উটের উপর বসা অবস্থায় ছিলেন। দুধটুকু তিনি তখনি পান করে নিলেন”।

তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত ইবনে আবূ নাজীহ (রহঃ) হতে তার পিতা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আরাফাতের দিন রোজা পালন প্রসঙ্গে ইবনে উমার (রাঃ) কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে হাজ্জ করেছি, তিনি সেদিন রোজা পালন করেননি। হযরত আবূ বাকর (রাঃ) এর সাথেও হাজ্জ করেছি, ঐ দিন তিনিও রোজা পালন করেননি। হযরত উমার (রাঃ) এর সাথেও হাজ্জ করেছি, ঐ দিন তিনিও রোজা পালন করেননি। হযরত উসমান (রাঃ) এর সাথেও হাজ্জ করেছি, ঐ দিন তিনিও রোজা পালন করেননি। এ দিন আমি নিজেও রোজা পালন করিনা, কাউকে রোজা রাখতেও বলি না এবং নিষেধও করি না”।

সুনানে আবু-দাউদ ও তিরমিজীর আরেক হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিনে আরাফার ময়দানে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন”।

বিশেষ দোয়া।

আরাফাতের দিন হচ্ছে দোয়া ও মুনাজাতের দিন। এ দিনের দোয়া ও মুনাজাত আল্লাহর দরবারে বিশেষ স্থান লাভ করে থাকে। আপনার মনের ইচ্ছায় যে কোন দোয়া করতে পারেন। তবে এই বিশেষ দিনে রাসূলুল্লাহ পা এর বলে দেওয়া বিশেষ দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করা উত্তম হবে। তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আমর ইবনে শুআইব (রহঃ) কর্তৃক পর্যায়ক্রমে তার বাবা ও তার দাদা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আরাফাতের দিনের দোয়া উত্তম দোয়া। আমি ও আমার আগের নাবীগণ যা বলেছিলেন তার মধ্যে সর্বোত্তম কথা- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর”।
অর্থাৎ- আল্লাহ ছাড়া কোন মাবূদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই, সার্বভৌমত্ব তারই এবং সমস্ত কিছুর উপর তিনি সর্বশক্তিমান”।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এই সম্মানিত ও ফজিলত পূর্ণ দিনে নফল রোজা রাখা সহ অন্যান্য নফল ইবাদাত করার তৌফিক দান করুন। ঐ দিনের উছিলায় তিনি যেন আমাদের সবাইকে মাফ করেন এবং করোনা ভাইরাস থেকে হেফাজতে রাখেন । (আমিন)

———–চলবে ইনশা আল্লাহ

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ