আল্লাহ যাদেরকে ভালোবাসেন (পর্ব চার)
ভালোবাসা একটি গোপন বিষয়। কারো প্রতি কারো কতটুকু ভালোবাসা আছে তা পরিমাপ করা খুব কঠিন। তবে কিছু কিছু মাপকাঠি আছে যেগুলো দিয়ে অনেক সময় বুঝা যায় বা অনুমান করা যায় কতটুকু ভালোবাসা আছে। আর তার মধ্যে অন্যতম হলো একে অপরের অবস্থা ও পারস্পরিক ব্যবহারের চিহ্ন ও লক্ষণাদি দেখে বা জেনে নেয়া। কিন্ত আল্লাহ তায়ালা কাদের ভালবাসেন সে মাপকাঠি তিনি নিজেই বলে দিয়েছেন। সেগুলো যদি কোন মানুষের মধ্যে থাকে তাহলে সে আল্লাহর ভালবাসায় শিক্ত হবে। তাহলে আসুন দেখি আমাদের মধ্যে সেই মাপকাঠি গুলো আছে কি না?
পঞ্চম মাপকাঠি
তাওবাহকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন।
পঞ্চম মাপকাঠি হচ্ছে যারা গুনাহ করার পর আল্লাহর কাছে তাওবাহ ইস্তিগফার করেন তাদের আল্লাহ ভালোবাসেন। সূরা বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালবাসেন”।
যেহেতু আমরা শয়তানের কুমন্ত্রনায় পড়ে গুনাহ করে থাকি। তাই এসব গুনাহ থেকে কিভাবে তাওবাহ করব, কখন করব ও কার কাছে তাওবাহ করব এই সমস্ত বিষয়ে কুরআন হাদীসের দিকনির্দেশনা রয়েছে। সেগুলো খুব সংক্ষিপ্ত আকারে আমরা জেনে নিব ইনশা আল্লাহ।
বিশুদ্ধ তওবা করতে হবে।
সূরা তাহরিম এর ৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর বিশুদ্ধ তওবা। সম্ভবতঃ তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলোকে মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার নিম্নদেশে নদীমালা প্রবাহিত”।
তাফসীরে কুরতুবীর মধ্যে এসেছে- তাওবার শাব্দিক অর্থ ফিরে আসা। উদ্দেশ্য গুনাহ থেকে ফিরে আসা। কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় তওবার অর্থ বিগত গুনাহের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে তার ধারে কাছে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা। আয়াতে বর্ণিত نصوح শব্দটির বিভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। এক- যদি نصحة থেকে উদ্ভূত ধরা হয়, তবে এর অর্থ খাঁটি করা। আর যদি نصاحة থেকে উদ্ভূত ধরা হয়, তবে এর অর্থ বস্ত্র সেলাই করা ও তালি দেয়া। প্রথম অর্থের দিক দিয়ে “তাওবাতুন নাসূহ” এর অর্থ এমন তাওবা, যা রিয়া ও নাম-যশ থেকে খাঁটি-কেবল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন ও আযাবের ভয়ে ভীত হয়ে এবং গুনাহৃর কারণে অনুতপ্ত হয়ে গুনাহ পরিত্যাগ করা। দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে “তাওবাতুন নাসূহ” শব্দটি এই উদ্দেশ্য ব্যক্ত করার জন্যে হবে যে, গুনাহৃর কারণে সৎকর্মের ছিন্নবস্ত্রে তাওবা তালি সংযুক্ত করে। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেন, “তাওবাতুন নাসূহ” হল মুখে ক্ষমাপ্রার্থনা করা, অন্তরে অনুশোচনা করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ভবিষ্যতে সেই গোনাহ থেকে দূরে রাখা।
তাওবাহ কার কাছে করবেন?
সূরা হুদের ৯০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর তোমরা তোমাদের রবের কাছে ইস্তিগফার কর অতঃপর তাঁরই কাছে তাওবা কর। নিশ্চয় আমার রব পরম দয়ালু, অতীব ভালবাসা পোষণকারী”।
আল্লাহ তাওবাহ কবুলকারী।
সূরা বাকারার ১৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “অতএব, আমি তাদের তাওবা কবূল করব। আর আমি তাওবা কবূলকারী, পরম দয়ালু”।
তাওবাহ পাপগুলিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে।
সূরা ফুরকান ৭০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “তবে যারা তওবা করে, বিশ্বাস ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদের পাপকর্মগুলিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”।
তাওবাহকারী সফলতা পেয়ে থাকে।
সূরা নূর এর ৩১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার”।
আল্লাহ বড় খুশি হন।
সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, আমার উপর বান্দার ধারণা অনুযায়ী আমি তার সাথে আছি। সে যেখানেই আমাকে স্মরণ করে আমি তার সাথে আছি। আল্লাহর কসম, শূণ্য মাঠে তোমাদের কেউ হারানো প্রাণী পাওয়ার পর যে আনন্দিত হয় আল্লাহ তায়ালা বান্দার তাওবার কারণে এর চেয়েও বেশি আনন্দিত হন। যদি কেউ একবিঘত সমান আমার দিকে অগ্রসর হয় তাহলে আমি তার দিকে একহাত অগ্রসর হই। যদি কেউ একহাত সমান আমার প্রতি অগ্রসর হয়, তাহলে আমি একগজ সমান তার প্রতি অগ্রসর হই। যদি কেউ আমার দিকে পায়ে হেঁটে আসে তবে আমি তার দিকে দৌড়ে আসি”।
সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে আরো এসেছে- “হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তাওবাহ করে তখন আল্লাহ ঐ লোকের চেয়েও বেশি আনন্দিত হন, যে মরুভূমিতে নিজ সাওয়ারীর উপর আরোহিত ছিল। তারপর সাওয়ারীটি তার হতে হারিয়ে যায়। আর তার উপর ছিল তার খাদ্য ও পানীয়। এরপর নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় এসে আরাম করে এবং তার উটটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় হঠাৎ উটটি তার কাছে এসে দাঁড়ায়। অমনিই সে তার লাগাম ধরে ফেলে। এরপর সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠে, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার রব। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে ভুল করে ফেলেছে”।
তাওবাহকারী আল্লাহ অভিমুখী হয়।
সূরা ফুরকানের ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “যে ব্যক্তি তওবা করে ও সৎকাজ করে, সে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ অভিমুখী হয়”।
দিনে কতবার তওবা করবেন।
সহীহ বুখারি শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি- আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে সত্তরবারেরও অধিক ইস্তিগফার ও তাওবাহ করে থাকি”।
সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আগার মুযানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমার অন্তর আল্লাহর স্মরণ থেকে নিমেষভর বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেহেতু আমি দিনে একশত বার আল্লাহর নিকট ক্ষমা ভিক্ষা চাই”।
তাওবাহ কখন করবেন?
সূরা নিসার ১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আল্লাহ অবশ্যই সেই সব লোকের তওবা গ্রহণ করবেন, যারা অজ্ঞাতসারে মন্দ কাজ করে বসে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে নেয়। এরাই তো তারা, যাদের তওবা আল্লাহ গ্রহণ করেন। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়”।
সালাতুত তাওবাহ।
তিরমিজী ও আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আলী বিন আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আবূ বকর (রাঃ) আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তিনি সত্য বলেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কোন ব্যক্তি গুনাহ করার পর উত্তমরূপে উযু করে দুই রাকাত সালাত পড়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থণা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন”।
সহীহ বুখারি শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত শাদ্দাদ ইবনু আউস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার হলো বান্দার এ দোয়া পড়া- হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে কৃত প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নিয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। যে ব্যক্তি দিনে (সকালে) দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ ইস্তিগফার পড়বে আর সন্ধ্যা হবার আগেই সে মারা যাবে, সে জান্নাতী হবে। আর যে ব্যক্তি রাতে (প্রথম ভাগে) দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ দোয়া পড়ে নেবে আর সে ভোর হবার আগেই মারা যাবে সে জান্নাতী হবে”।
তাওবাহ করার জন্য উৎসাহ প্রদান।
সূরা মাঈদার ৭৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “সুতরাং তারা কি আল্লাহর নিকট তাওবা করবে না এবং তাঁর নিকট ক্ষমা চাইবে না? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”।
মাফ করা আল্লাহ পছন্দ করেন।
সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আইয়ূব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, যখন তাঁর মৃত্যু সমুপস্থিত তখন তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে শুনা একটি হাদীস আমি তোমাদের নিকট হতে গোপন রেখেছিলাম। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, যদি তোমরা পাপ না করতে তবে আল্লাহ তায়ালা এমন মাখলূক বানাতেন যারা পাপ করতো এবং আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিতেন”।
আল্লাহর রহমত।
সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যখন আল্লাহ তায়ালা মাখলূক সৃষ্টি করলেন তখন তিনি তাঁর কিতাবে লিপিবদ্ধ করলেন এবং তা তাঁর নিকট আরশের উপরে রয়েছে। (তিনি লিখেছেন) আমার গোস্বার উপর রাহমাত বিজয়ী থাকবে”।
সহীহ মুসলিমের আরেক হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা একশ ভাগ রাহমাত সৃষ্টি করে একভাগ সৃষ্টির মধ্যে রেখে দিয়েছেন এবং নিরানব্বই ভাগ নিজের নিকট লুকায়িত রেখেছেন”।
আল্লাহ আমাদের তাওবাহকারী বান্দাদের মধ্যে শামিল করুন। (আমিন)
——–পরের পর্ব আসছে ইনশা আল্লাহ
লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান