আল্লাহ যাদেরকে ভালোবাসেন (পর্ব ছয়)
ভালোবাসা একটি গোপন বিষয়। কারো প্রতি কারো কতটুকু ভালোবাসা আছে তা পরিমাপ করা খুব কঠিন। তবে কিছু কিছু মাপকাঠি আছে যেগুলো দিয়ে অনেক সময় বুঝা যায় বা অনুমান করা যায় কতটুকু ভালোবাসা আছে। আর তার মধ্যে অন্যতম হলো একে অপরের অবস্থা ও পারস্পরিক ব্যবহারের চিহ্ন ও লক্ষণাদি দেখে বা জেনে নেয়া। কিন্ত আল্লাহ তায়ালা কাদের ভালবাসেন সে মাপকাঠি তিনি নিজেই বলে দিয়েছেন। সেগুলো যদি কোন মানুষের মধ্যে থাকে তাহলে সে আল্লাহর ভালবাসায় শিক্ত হবে। তাহলে আসুন দেখি আমাদের মধ্যে সেই মাপকাঠি গুলো আছে কি না?
সপ্তম মাপকাঠি
আল্লাহর উপর ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।
আল্লাহ তায়ালা যে সমস্ত গুণের কারনে বান্দাকে ভালোবাসেন তার মধ্যে সপ্তম প্রকারের গুণ হচ্ছে যারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন। সূরা আল-ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “নিশ্চয় আল্লাহ (তার উপর) ভরসাকারীদের ভালোবাসেন”। উপরের আয়াতে কারীমা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যারা আল্লাহর উপরে সব সময় ভরসা রাখেন তাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন। আল্লাহর উপরে কিভাবে ভরসা রাখবেন, কতটুকু রাখবেন এবং ভরসা রাখলে তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার সাথে সাথে আরো অনেক কিছুই হাসিল করা যায় সে সব বিষয়ে কুরআন হাদীসে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। আমরা খুব সংক্ষিপ্ত আকারে সে গুলো জানার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ।
কার উপর ভরসা রাখবেন?
সূরা মাঈদার ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর আল্লাহর উপরই ভরসা কর, যদি তোমরা মুমিন হও”। সূরা ফুরকানের ৫৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার উপর যিনি মরবেন না। তাঁর প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ কর। তাঁর বান্দাদের পাপ সম্পর্কে খবর রাখার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট”। সূরা হুদৃর ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আমি অবশ্যই তাওয়াক্কুল করেছি আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর উপর”। সূরা আহযাবের ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর তুমি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কর এবং কর্মবিধায়ক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট”।
ভরসাকারীগন আল্লাহর উপরই ভরসা করেন।
সূরা যুমারের ৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “বলুন আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ভরসাকারীগণ তাঁর উপরই ভরসা করে”।
সব কিছুই সমর্পণ করতে হবে আল্লাহর উপর।
সূরা মুমিনের ৪৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর আমার বিষয়টি আমি আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে সর্বদ্রষ্টা”। সূরা মুমতাহিনার ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা আপনার ওপরই ভরসা করি, আপনারই অভিমুখী হই আর প্রত্যাবর্তন তো আপনারই কাছে”।
ভরসাকারীর জন্য আল্লাহ যথেষ্ট।
সূরা বনী ইসরাঈলের ৬৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ আবারও বলেছেন- “নিশ্চয় আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার রবই যথেষ্ট”।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভরসা করেছিলেন।
সূরা আলে-ইমরানের ১৭৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “যাদেরকে মানুষেরা বলেছিল যে, নিশ্চয় লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর। কিন্তু তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক”। উক্ত আয়াতে কারীমার তাফসীরে সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হাসবি-ইয়াল্লাহু ওয়া-নিমাল-ওয়াকিল কথাটি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বলেছিলেন, যখন তিনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন যখন লোকেরা বলল, নিশ্চয় তোমাদের বিরুদ্ধে কাফিররা বিরাট সাজ-সরঞ্জামের সমাবেশ করেছে, সুতরাং তোমরা তাদের ভয় কর। এ কথা তাদের ঈমানের তেজ বাড়িয়ে দিল এবং তারা বললেন আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কার্যনির্বাহক”।
আল্লাহর রাহমতের উপরে ভরসা রাখা।
সূরা যুমারের ৫৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে নবী আপনি বলুন, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”।
কল্পনার বাইরে রিযিক আসে।
সূরা তালাকের ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট”। তিরমিজী ও ইবনে মাজাহ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহ্ তায়ালার উপর নির্ভরশীল হতে তাহলে পাখিদের যেভাবে রিযিক দেয়া হয় সেভাবে তোমাদেরকেও রিযিক দেয়া হতো। এরা সকালবেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় ভরা পেটে ফিরে আসে”।
কিভাবে ভরসা করবেন।
জামে আত-তিরমিজির হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন কোন একজন লোক বললো, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি কি সেটা (উট) বেঁধে রেখে আল্লাহর তায়ালার উপর ভরসা করবো, না বাঁধন খুলে রেখে আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করবো? তিনি বললেন, তুমি সেটা বেঁধে রেখে (আল্লাহ তায়ালার উপর) ভরসা করবে”।
ঘর থেকে বের হওয়ার দোয়া।
সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যখন কোন ব্যক্তি তার ঘর হতে বের হওয়ার সময় বলবে “বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, ওয়া লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”-তখন তাকে বলা হয়, তুমি হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছো, রক্ষা পেয়েছো ও নিরাপত্তা লাভ করেছো। সুতরাং শয়তানরা তার থেকে দূর হয়ে যায় এবং অন্য এক শয়তান বলে, তুমি ঐ ব্যক্তিকে কি করতে পারবে যাকে পথ দেখানো হয়েছে, নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে এবং রক্ষা করা হয়েছে!
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর উপরই নির্ভরশীল থাকার তৌফিক দান করুন।
—————–পরের পর্ব আসবে ইনশা আল্লাহ
লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান