হৃদয়ে রক্তক্ষরণ
মায়াবী চেহারার যুবক যখন দেখলো মেয়েটি বিপদে পড়েছে তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। যদিও একটু আগে মেয়েটা তাকে অন্য জগতে ঠেলে দিয়েছিল এবং একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল তবুও এখন আর বসে থাকলে চলবে না।
বাসে ওঠার একটু পরেই একাকী মেয়েটার প্রতি দৃষ্টি পড়লো যুবকের। বিদ্যুৎ প্রবাহ বহে গেল তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। দুই বছর আগের এক গোধূলী রাঙা সন্ধ্যায় তার সমস্ত আশা ভালোবাসা পা’য়ে ধলে চলে যাওয়া ছলনাময়ী মেয়েটা মুহূর্তেই চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। যুবক গভীর দৃষ্টি দিল এলোচুলের মেয়েটার দিকে। তারপর অসংগতিটা ধরা পড়লো। এ মেয়েটা সেই চলে যাওয়া ছলনাময়ী নয়। তবে বিধাতার নিখুত শৈল্পিক প্রতিভা এখানে স্পষ্ট- হঠাৎ করে তাকলে কোন অমিল না পেলেও একটু স্থির দৃষ্টি দিলে অনেক পার্থক্যই ধরা পড়বে।
ছলনাময়ী সেই প্রেয়সী চলে যাওয়ার সময় অবশ্য একটা অপবাদ দিয়ে গিয়েছিল- কাপুরুষ। সত্যি বলতে কি- তার আধুনিকতায় যুবক তাল মেলাতে পারেনি বিধায় এই অপবাদ সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য একটা কৈফিয়ত ছিল মাত্র। সেই থেকে যুবক আর নিজেকে ফেরাতে পারেনি নিজের মাঝে। বাধ্যতামূলক একটা কষ্টের বোঝা বহে চলছে প্রতিনিয়ত।
ছলনাময়ীর সেই কাপুরুষ অপবাদটা সম্পর্ক ছিন্ন করার একটা কৌশল হলেও সে নিজে আসলে কতটা সাহসী তা তার জানা ছিল না। তবে আজ এই মুহূর্তে বাসে বসে থাকা মেয়েটার করুণ অবস্থা দেখে তার অন্তরে প্রতিবাদের যে বাঁধ ভাঙতে চাচ্ছে, সেটাই তাকে তার নিজের কাছে প্রমাণ করলো- আসলে সে কাপুরুষ নয়।
আধুনিকতার যত লেবাস আছে সব কিছুতে নিজেদের মোড়ে চারজন যুবক মেয়েটাকে জ্বালাতন করেই যাচ্ছে। মেয়েটা কোণঠাসা শিকারের মত দিশেহারা। যুবক চারিদিকে দৃষ্টি দিল। কত শক্ত সামর্থ মানুষ বসে আছে নিজেদের জগৎ নিয়ে নির্বিকার। শুধু বয়স্ক এক লোক কথা বলেছিলেন। ছেলের বয়সি একজনের হাতে চড় খেয়ে নির্বাক হয়ে গেলেন। আর চড়ের ঠা্স শব্দটা সবাইকে আরও মাথা নিচু করে বসতে বাধ্য করলো।
কষ্টের বোঝা বহে চলা যুবক প্রতিবাদী হয়ে সিট ছেড়ে উঠে দাড়ালে যুবকের সাহসে অন্যরাও সাহসী হলো। একসাথে সবাই রুখে দাড়িয়ে চলন্ত বাস থামিয়ে নেশায় ডুবে থাকা চার যুবককে পুলিশের হতে তুলে দিল।
সেই পরিচয়। সেই হাতছানির শুরু। সোনালি সকালে হাত ধরে কুয়াশায় পা ভিজিয়ে একসাথে হাঁটার আহবান। যুবক মেয়েটিকে বুঝায়- সে বেকার। ফাইলবন্দি সার্টিফিকেট নিয়ে ফুটপাতেই তার ঠিকানা। গ্রামে বৃদ্ধ অসুস্থ মা-বাবার অনাহারে র্নিঘুম রাত কাটানো। আরও বুঝায় দু’জনের আকাশ-পাতাল অমিলের কথা। তবুও মেয়েটি অবুঝই রয়ে যায়।
যুবক র্নিঘুম রাত কাটিয়ে বিষয়টি বিশ্লেষণ করে। যোগফল মিলাতে পারেনা কোনভাবেই। শেষে সিদ্ধান্ত নেয়- এ শহর ছেড়ে চলে যাবে দূরে কোথাও; যেখানে এমন কঠিন আহবান নেই, নেই এমন রূপসীর হাতছানি।
কিন্তু যাওয়া হয় না যুবকের দূরে কোথাও। মেয়েটি কিভাবে যেন বুঝে যায় যুবকের হৃদয়ের গহিণের সিদ্ধান্তটা। সামনে দাড়িয়ে অবুঝের মতো চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দু’হাত প্রসারিত করে পথ রোধ করে। থামতে বাধ্য হয় মা-বাবার ঝাপসা দৃষ্টির একমাত্র অবলম্বন, বেকার, আশ্রয়হীন, সার্টিফিকেটের বোঝা বহে চলা রোদে পোড়া ক্লান্ত যুবক।
একবছর সময়ের ব্যবধানে ভালোবাসার কপাট যখন পুরোপুরি উন্মুক্ত। ঠিক তখনি এক পড়ন্ত বিকালে যুবকের মুখোমুখি দাড়ায় সেই চার মাতাল। প্রতিশোধের হাত ওঠে অচঞ্চল চোখের মায়াবী যুবকের গা’য়। রক্তে ভেসে যায় প্রেমিকা মেয়েটির বাড়ির সাদা রঙের গেইট আর পিচ ঢালা কালো রাস্তা।
বেশ কিছুদিন পর এক গোধূলী রাঙা সন্ধ্যায় যুবক যখন হাসপাতাল থেকে রাস্তায় নামে তখন সে হারিয়ে ফেলেছে তার একটা হাত ও একটা পা।
সে হয়তো বাঁচত-ই না, যদি ব্যবসায়ী বাবার সেই আদরের দুলালি প্রেমিকা মেয়েটি সার্বিকভাবে তাকে সাহায্য না করত। যুবক নিজেকে নিজে মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়- পঙ্গু হলেও ক্ষতি নেই। পৃথিবীর আলো আঁধারিতে প্রেম, ভালোবাসাময় এক প্রেয়সী আছে তার- যে ভালোবাসে তাকে।
কিন্তু ভালোবাসা এখানে বড়-ই স্বার্থপর। মেয়েটি যুবককে বাঁচাতে আপ্রাণ সাহায্য করলেও তার হৃদয় কিন্ত আর যুবকের তরে সপে দিল না। সবচেয়ে নিষ্টুর নির্মম সত্য হলো- যুবককে যখন সে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে পিছন ফিরে দাড়ালো; যুবক তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুছকি হেসে এক পায়ে হাটতে লাগলো পৃথিবীর পথে ঠিক যেমন ছিল আগে তার চেয়ে একটু অন্যরকম, অন্য ছন্দে, চরম শান্তির ঠিকানা মায়ের আঁচলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

