বাউণ্ডুলেঃ ‘যাযাবর মন’

আমি বেকার, তাই ঘুরাঘুরিই আমার একমাত্র কাজ। শত চেষ্টা করেও নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য ঠিক করতে পারিনা। যেদিকে ইচ্ছে যাই- পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ। অথচ ঘুরে ফিরে বাবার হোটেলেই প্রত্যাবর্তন করি, করতে বাধ্য হই।

চাকুরীর সন্ধানে জুতার তলা কাগজের মতো পাতলা হয়ে গেছে। লেমেনিটিং করা সার্টিফিকেটগুলোতে ঘামের দাগ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। তবুও ফুটপাত আমাকে অবহেলা করেনি। আমিও তার হাতছানির অমর্যাদা করিনি কোনদিন। তাই আমার সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা রাত্রি অষ্ট প্রহরই হাতের মুঠোয় নাচানাচি করে। আমি প্রহরগুলো ব্যয় করতে চাই, কিন্তু বারবার ব্যর্থ হই।

গতানুগতিক প্রক্রিয়া। হ্যাঁ, তাই বলা যায়। দাড়িয়ে আছি সদ্য স্লাব বসানো ফুটপাতে। আড়মোড়া ভেঙ্গে সামনে তাকালাম। সীমাহীন রাজপথ। যানবাহন আর মানুষ- সবই ছুটছে তো ছুটছেই। আমার মতো শত শত বেকারদের দ্বারা ফুটপাত সরগরম। পরিচয়পত্র লাগে না, চেহারা দেখলেই চেনা যায় এরা ডিগ্রীর বোঝা বহে চলা ক্লান্ত কিছু যন্ত্রমানব! একটা ফাইল বগলবন্ধি করে প্রত্যাশার স্বপ্ন নিয়ে ছুটছে অবিরাম অনিশ্চিত গন্তব্যে।

ভাবছি, আজ আমি কোথায় যাব, কোনেদিকে যাব? সিদ্ধান্তহীনতা! খামাখাই দাড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই। সবাই যেহেতু ছুটছে সেহেতু আমি দাড়িয়ে থাকব কেন- কার আশায়, কার প্রত্যাশায়? তাই পা বাড়াতে বাধ্য হলাম অনিশ্চিত গন্তব্যে। চললাম আশা নিরাশার এক নিজস্ব জগৎ মাথায় নিয়ে।

হঠাৎ করেই একটা গন্ধ মাথা ঘুলিয়ে দিল। রুমাল বের করে নাক মুখ চেপে ধরলাম! ডাস্টবিন! এলোমেলো। ময়লা আবর্জনা। এদিক সেদিক। এমনকি পিচঢালা রাস্তার অর্ধেক জোড়ে। এমন খারাপ অবস্থায় আমার চোখ গেল ডাস্টবিনের ভিতরে। আমি সব ভুলে বরাবরের মতো পাথর হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।

নিজেও জানিনা এসব দেখলে কেন আমার এমন হয়। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ এসব অবলিলায় পাশ কাটিয়ে চলে যায়, সেখানে আমার মতো একজন ভবঘুরে কেন এসবে বিচলিত হবে। না; এসব আমার সাজে না। তবুও আমি নিজের অজান্তে মানিয়ে নেই, সাজিয়ে নেই। মানতে বাধ্য হই, সাজাতে বাধ্য হই।

একটা সাত/আট বছরের ছেলে। ছেড়া একটা প্যান্ট আর ছেড়া একটা বস্তা ছাড়া সম্বল বলতে আর কিছু নেই তার। হাড্ডিসার দেহটা নিজের অজান্তে টেনে, ঠেলে চলা। আর প্রতিনিয়ত একটা অনাকাংঙ্ক্ষিত জীবনে অনাহার দূর করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।

আমি দেখেছি এরা প্রধানত ডাস্টবিনগুলোকেই নিজেদের অনাহার দূর করার একমাত্র ভরসা মনে করে। আসলে বাস্তব সত্যিটাও তাই। ক্ষুধার জ্বালায় অসহায় অবুঝ শিশুরা এখানেই নিজেদের জীবিকা খুঁজে বেড়ায়। কেউ নেই এদের। তারা বিছিন্ন দ্বীপের মতো বিছিন্ন। তারা অবহেলিত। তারা ঘৃণিত। তারা সমাজের সভ্য (!) মানুষের কাছে প্রতারিত। কিন্তু একবার একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, এটা আসলে কার লজ্জা! এটা আসলে কার কাপুরুষতা! এটা আসলে কার ব্যর্থতা!

কচি ছেলেটা ওখানেও শান্তি পায় না। বেওয়ারিশ কুকুর আর অগণিত কাক জ্বালাতন করে অবিরত। তবুও সে দুঃখী নয়, অন্তত নিজের কাছে। মনের সুখে দু’ঠোঁট গোল করে সুর তোলে- “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। বাহ! কি সুখ! যেন নিজের সবচেয়ে বেশি পছন্দের নামি দামি কোন হোটেল থেকে নিজের খাবার সংগ্রহ করছে।

ফ্রেশ উচ্ছিষ্ট কিছু খাবারের সাথে কিছু পঁচা, কিছু বাসি, কিছু বর্জ্য, বিভিন্ন ব্যবহৃত জিনিস- পলিথিন, প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম বক্স, ফুলটাইম ভাঙা জিনিস, লোহা, কাঠ, ইট, পাথর, কলার খোসা, ভাঙা কাচ, মাছের কাটা, মুরগীর পাকস্থলী, ব্যবহৃত কনডম, সিরিঞ্জ, স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্যামপার্স, ব্লেড, খুনের পরিনতিতে অথবা বৈথ অস্ত্রোপচারের পরিনতিতে মানব শিশুর খণ্ডিত লাশের একাংশ, রক্তাত ব্যান্ডেজ ইত্যাদি ইত্যাদি। চোখ বন্ধ করে একবার চিন্তা করে দেখুন- এসবের মাঝে নিজের হাত রক্তাক্ত করে কাক কুকুরের সাথে খাদ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতা করছে একটা অবুঝ শিশু।

কী… বমি আসছে? আসার-ই কথা! কিন্তু আমাদের প্রজন্মকে আমরা এভাবেই খাবার দিচ্ছি। এভাবেই তাদের সাথে প্রতারণা করছি। এভাবেই এদেরকে অবহেলা করে এভাবেই নিজেদের উদর বড় করছি আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নিজেরা নিজেদের জয়গান গাচ্ছি।

স্পর্শহীন আমার একার একটা জগৎ সৃষ্টি করি- যেখানে আমি নিজেই রাজা, মন্ত্রী, প্রজা, নিজেই বাজার সরকার, সুইপার, পাচক এবং খাদক। ভাবতেই বড় লজ্জা লাগে। স্পর্শহীন জগৎ থেকে নিজেকে বিছিন্ন করে লোকালয়ে ফিরে আসি। দাম তো সবকিছুর বাড়ে বৈ কমে না। কিন্তু এই অবহেলিত প্রজন্মের দাম কমে বৈ বাড়তে তো দেখি না। এদেরকে যদি ডাস্টবিন থেকে তুলে আনার চেষ্টা করি তবে কি আমাদের খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? আমরা কি খুব বেশি ছোট হয়ে যাব এই শিশুদের বুকে টেনে নিলে?

এমনিতেই দ্রব্য মূল্যের যে অবস্থা হচ্ছে ধীরে ধীরে, একসময় আমাদেরকেও তাদের সাথে লাইন দিতে হবে। কি… মিথ্যে বললাম? যদি এমন হয় আমার মনে হয় তারা ঠিকই আমাদের সাদরে গ্রহণ করে নেবে। তখন তারা আমাদের মতো এত নিষ্টুর হবে না। তবুও নিজেদের দায়বদ্ধতা এড়াতে তাদের একটু নিজেদের দিকে টানি। তাহলে হয়তো বিধাতা আমাদের এই পরিনতি দেবেননা। বিধাতা এদের মাধ্যমে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন পৃথিবীর রহস্য। আমরা সভ্যতার ছোঁয়ায় সভ্য হয়ে আঙুলের গিট গুনে গুনে বছর পার করছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না- বর্তমানে যেখানে দিন পার করা বড় কঠিন, সেখানে বছরের সমঝোতা করা রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু কথা বলে সচেতনতা বা অচেতনতা কোনটাই আমরা এলিবাই করতে পারব না। একদিন বিপদ কন্ঠনালী চেপে ধরে এর হিসেব চাইবেই।

হঠাৎ বমি আসায় আমার সচেতনতা ফিরল। আমি কয়েক টন ওজনের পা’গুলো টেনে টেনে সামনে চলতে বাধ্য হলাম। অপরাধবোধ আমাকে পিছন থেকে দাওয়া করতে লাগল। আমার মতো অনেককেই দেখলাম ধাওয়া খাওয়া চোরের মতো ছুটছে। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।

আজকাল মানুষ আর গাড়ির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। চলার ভঙ্গি দেখে বুঝা মুশকিল কোনটা গাড়ি আর কোনটা মানুষ। জ্বালানি তেলের দামের কারণে পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি পেলে কাচা বাজারে নাকি দাম বৃদ্ধি পায়। তা… এতসব দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি, অভাব-অভিযোগ, অবুঝ কচি প্রজন্মের ডাস্টবিনে জীবিকার সন্ধান, নাক চিটকিয়ে আমাদের অবজ্ঞার দৃষ্টি নিক্ষেপ, মানুষের লাগামহীন দৌড়ের পরও এত তেল আসে কোথা থেকে, কিভাবে, কেমন করে? দাম বৃদ্ধির পরও কেন গাড়ি হ্রাস পায়না? হয়তো এর অনেকগুলো কারণ আছে- যা আমার ছোট মাথায় ধরছে না। তবে বুঝে উঠতে পারি না নিজেদের দাম বাড়ার পরও মানুষগাড়ীগুলো কিভাবে তাদের চাহিদা যোগান স্থীর রাখে! নাকি সব রিজার্ভ ট্যাংকের তেলে চলে?

হাসবো নাকি কাঁদব বুঝে আসে না। এই আমি; এবং আমার মতো আমরা সবাই মনে হয় রিজার্ভ ট্যাংকের তেলে চলছি। একদিন তাও ফুরিয়ে যাবে। থেমে পড়ব, থামতে বাধ্য হব। স্ক্র টাইট করে, পালিশ করে, দামি অকটেন নল দিয়ে ঢুকিয়েও কিছুই হবে না। কিন্তু তখনও সেই কচি শিশুটা ডাস্টবিনে গতানুগতিকভাবে খুঁজে যাবে তার পেট নামক দেবতার ভোগ। মনে মনে হাসবে আর নিজেকে বলবে- যতই দাম বাড়ুক না কেন, আমার গোডাউন কখনও খালি হবে না। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আইটেমের কিছু একটা পাওয়া যাবে এখানেই, এভাবেই।

জীবনের গুঞ্জনে আর কতদিন এমন প্রতারণা চলবে। এমন প্রতারিত হবো আর কতদিন, কতরাত? এমন হবে আর কতো পথশিশুর জন্ম? আর কতো হবে এমন রক্তে রঞ্জিত এই সভ্যতা, এই সোনার বাংলা, এই জাতি এবং আমার বাউণ্ডুলে এই অস্তিত্ব?

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কেকে
আরও সংবাদ