নিষ্টুর নিয়তি

আজ বছর পাঁচেক হলো কৌশিকের ডিভোর্স হয়ে গেছে সুমিতার সাথে। সুমিতা তার মেয়ের সাথে আলাদা একটা ফ্ল্যাটে থাকে। যদিও ভালোবেসে কৌশিককে বিয়ে করেছিল সুমিতা কিন্তু কাজপাগল কৌশিকের কাজের পেছনে ছুটে বেড়ানোর নেশা, পরিবারকে সময় না দেওয়া- মেনে নিতে পারেনি সুমিতা। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি দু’জনের সেপারেশান।
ডিভোর্স হয়ে গেলেও কৌশিক মেয়ে কৌশানিকে ভুলতে পারেনি কিছুতেই। নিয়মকরে প্রায় প্রতি শনিবার স্কুল ছুটির পর মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করে আসে। জানে সুমিতা এসব পছন্দ করেনা। কিন্তু তবুও মন মানেনা কৌশিকের। কৌশিক চেয়েছিল সুমিতা, কৌশানি আর বাবা-মাকে নিয়ে একসাথে থাকতে। কিন্তু বাবা হঠাৎ করে মারা যাবার পর সব যেন ওলটপালট হয়ে গেল। মৃত্যুশয্যায় বাবা কৌশিকের হাত ধরে বলেছিলেন- আমার তৈরী এই কোম্পানিটা আমার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এটাকে বড় করে যেতে পারলাম না। সেই দায়িত্বটা আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম। তোমার পরিশ্রম, অধ্যবসায়ে এই কোম্পানি যেদিন দেশের অন্যতম সেরা কোম্পানি হয়ে উঠবে, জানবে সেদিন আমি শান্তি পাবো।
ব্যাস, সেই থেকে কাজের নেশা, কোম্পানিকে বড় করার নেশায় কৌশিক সব ভুলে যেন উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিল। দশবছরের নিরলস পরিশ্রমে আজ তার কোম্পানি অন্যতম, দেশসেরা। সে ভেবেছিল আর কেউ না বুঝলেও সুমিতা তাকে ঠিক বুঝতে পারবে, কিন্তু ভুল ভেবেছিল। বাবা মারা যাবার পাঁচ বছর পর সুমিতা মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। সেইসময় কৌশিকের পেছন ফিরে তাকানোর কোন অবকাশই ছিলনা…
আজ শনিবার মেয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে দাড়িয়েছিল স্কুলগেটের সামনে। কৌশানিও জানতো বাবা ঠিক আসবে।
অবশেষে দু’জনের দেখা হলো। দু’জনে একটা গাছের তলায় বসে কথা বলছিল। এমনসময় হঠাৎ উঠে দাড়ালো কৌশানি। …মা, তুমি!
কৌশিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ঠিক হাতখানেক পিছনে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে সুমিতা। কেমন যেন ঘোর লেগে গেল কৌশিকের। কিছুক্ষণ অচঞ্চল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সুমিতার দিকে; তারপর দৃষ্টিটা তাকে ছাড়িয়ে বেশ কিছু দূরে একটা নিশান কারের ওপর ফোকাস হয়ে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক গাড়িটির গা’য়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে এদিকে চেয়ে রয়েছেন। কৌশিক লোকটাকে চেনে না তবে আগেও বেশ কয়েকবার সুমিতার সাথে দেখেছে। কৌশানিকে সে জিজ্ঞাসও করেছিল কিন্তু মেয়েটা কোন সঠিক উত্তর দিতে পারেনি।
ভাবনার অতল থেকে নিজেকে ফিরে পেল তখন, যখন তার দৃষ্টিপথে চলে আসলো সুমিতা আর কৌশানি। ততক্ষণে সুমিতা কৌশানিকে নিয়ে গাড়িটার কাছাকাছি চলে গেছে। কচ্ করে একটা বিষাক্ত কাঁটা যেন বিধল কৌশিকের হার্টে। তীব্র একটা ব্যথা অনুভব করলো সারাটা বুক জুড়ে। কৌশানির জন্য হাহাকার করে উঠলো সমস্ত অস্তিত্ব। এর মধ্যে গাড়িটা ঐ ভদ্রলোক, সুমিতা আর কৌশানিকে নিয়ে হারিয়ে গেল শহরের ব্যস্ত রাস্তার প্রথম বাঁকের আড়ালে। হাজারও প্রশ্ন মনের অলিতে গলিতে বিচরন করতে দিয়ে অনেকটা সময় পাথরের মতো বসে থাকলো কৌশিক।
সব ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সে নিজেকে ফিরে পেতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে অনুভব করলো সে এখনো সুমিতাকে ঠিক আগের মতোই ভালোবাসে। হতাশা, অপূর্ণতা, সুমিতা, কৌশানি আর পলাতক ভালোবাসা তাকে দিশেহারা করে দিল। চুপচাপ উঠে দাড়িয়ে যেই পা বাড়াতে গেল হঠাৎ তার পৃথিবী দোলে উঠলো। পড়ে গেল ধুপ করে।
হাসপাতালের বেডে যখন কৌশিকের জ্ঞান ফিরলো তখন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনীত কারণে সে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি। আর তৃতীয়দিন যখন কৌশিককে উন্নত চিকিৎসার জন্য লণ্ডন নেওয়া হচ্ছিল তখন আকাশেই আবার দেখা হয়ে গেল সেই অপরিচিত ভদ্রলোক, সুমিতা ও কৌশানির সাথে। সুমিতা নতুন সংসার সাজাবে বলে উড়াল দিয়েছে আকাশে আর কৌশিক উড়ছে মৃত্যুপথের যাত্রি হয়ে। অবশেষে মৃত্যু আসলো আকাশেই!
পরদিন সারা বিশ্বের সকল মিডিয়ায় একটা খবরই প্রাধান্য পেল- “যাত্রিবাহী বিমান- দুর্ঘটনার স্বীকার; নিহত ১২০ জন।”
ভাগ্য কৌশিককে নিয়ে খেলায় মত্ত হলো। বেঁচে গেল সে!!! কিন্তু সুমিতা আর কৌশানির হয়ে গেল সলিল সমাধি।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

 
			