এক বিকেলের মেয়ে
এক অজানা প্রত্যাশা নিয়ে দীর্ঘ দশ বছর ধরে একটা নির্দিষ্ট পত্রিকায় নিয়মিত চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। যার খুজে আমার এই অপেক্ষা হয়তো সে আর কোনদিন আমাকে ডাকবে না। তবুও মরীচিকায় ডুবে আমার এই পথচলা।
অভ্যাসের দাস হিসেবে পত্রিকাটায় যথারীতি চোখ বুলাচ্ছি। মধ্য পৃষ্ঠায় গিয়েই দৃষ্টি আটকে গেল। সাথে সাথে একটা ভূমিকম্প বয়ে গেল সমস্ত আমিত্ব জুড়ে। অবশ হয়ে গেল শরীর।
যা পাওয়ার আশায় প্রতিদিন পত্রিকার অক্ষরে অক্ষরে খুজে বেড়ানো তা এ মুহূর্তে আমার দৃষ্টির সীমায়। মধ্য পৃষ্ঠার একদম শেষ কোণে এক ইঞ্চির একটা বিজ্ঞাপন- “মোবাইল ক্যামেরা; আমার ডান চোখ তোর ছবি তুলবে চন্দনের বনে।”
স্বাভাবিকভাবে বিজ্ঞাপনটা দেখে পাগলামিই মনে হবে। কিন্তু আমি যেহেতু এর মর্মার্থ জানি সেহেতু আমাকেই দিশেহারা হতে হলো।
মুহূর্তের নোটিশে রাতের ট্রেনে চড়ে পশ্চিম-উত্তরে ছুটতে লাগলাম। শত শত মাইল অতিক্রম করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। যেহেতু বাউণ্ডডুুুুলে মানুষ সেহেতু এমন ছুটে চলা আলাদা কোন অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে না। তবুও কিসের একটা টান যেন চাচ্ছে আমাকে বিদ্যুৎ গতিতে উড়িয়ে নিয়ে যেতে।
নির্জন টিলার ওপর ধূসর রং এর কর্টেজটা আমার নামেই ভাড়া করা ছিল। অবস্থান করার পর থেকে একমাত্র কাজ হলো অপেক্ষা করা। সময় যেন থমকে আছে। আর স্মৃতি সেই সময়কে আরও উত্থাল করে আমাকে দিয়ে তার ডায়রীটা পুনরায় পড়িয়ে নিল-
আজ হতে দশ বছর আগের এক বসন্ত দিনে এই কর্টেজেই চন্দনা আমাকে বিদায় দিয়েছিল। প্রেম হঠাৎ করেই এসেছিল তারুণ্যকে ছুয়ে। চন্দনা বাজারে বিক্রি হয় জেনেও যখন তাকে নিয়েই সুখী হতে চেয়েছিলাম ঠিক তখনি চন্দনা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল- “আমাকে তোমার ছায়ায় শোভা পাবে না। আমি তোমার পবিত্রতাকে অপবিত্র করতে পারি না। তাই তোমার মহত্যকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিলাম। পার যদি ক্ষমা করে দিও।”
আমার আবেগী প্রেমকে হারিয়ে চন্দনাই জয়ী হলো। কিন্তু যদি কখনো কাউকে কারও কোন প্রয়োজন হয় অথবা ক্ষণিক প্রেমের ক্ষত যদি কখনো পুনরায় অতীত দেখতে চায় তখন কি হবে এই প্রশ্ন উঠলে অভিনব এক পন্থা বেচে নেয় চন্দনা। জানায় বহুল প্রচলিত একটা পত্রিকার নাম, একটা অদ্ভুত বিজ্ঞাপনের কথা আর দুইটি স্থান। প্রথমটা হলো এই কর্টেজ আর দ্বিতীয়টা হলো চার মাইল দক্ষিণের একটা পার্ক। শুধুমাত্র প্রথমটা ব্যর্থ হলে পরেই দ্বিতীয় স্থান। যে বিজ্ঞাপন দিবে সে-ই কর্টেজ ভাড়া করে রাখবে।
জানি না চন্দনার কি হয়েছিল তবে বিদায়ের পর আমার আবেগী প্রেম আমাকে অনেক ভোগিয়েছিল। বারবার চেয়েছিলাম ফিরে যাই বিজ্ঞাপন দিয়ে। বাস্তবতার কাছে হার মেনে বারবার ফিরে আসি নিজের কক্ষপথে বাউণ্ডুলে রূপে, অবাঞ্চিত এক যাযাবর হয়ে। তবে সেই থেকে একটা অপেক্ষায় কেটেছে প্রহরগুলো। যদি কোন দিন ডাকে চন্দনা। জানি এর কোন সমাধান নেই তবুও কেন যেন ফিরতে চায় মন।
যখন বিকেল যৌবনে পা দিল ঠিক তখন প্রত্যাশিত সেই হারানো প্রেয়সী না এসে এলো এক ডানা কাটা পরী, অঝর বৃষ্টি সঙ্গে করে নিয়ে। অপরূপ একটা সৃষ্টি যেন আমার ঘুমন্ত সত্ত্বাকে জাগাতে এসেছে। তার মুখাবয়ব ইংগিত করছে সে এখনো কিশোরী আর ঢেউ উঠা শরীর বলছে সে তরুণী।
মাতালের মতো হেলে দোলে এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি বসে অধরা নামে পরিচয় দিল নিজেকে। আমার পরিচয়ের সত্যতা জেনে নিয়ে সে তার এখানে আসার ব্যাখ্যা দিতে লাগল-
ঘুণে ধরা সমাজের ঘুণপোকা আর আবেগী বয়সের প্রেমের কারণে নিজের অজান্তেই পণ্য হতে বাধ্য হলাম। ঠিক এমন এক রাতে ঘরে ফেরার সময় রাস্তায় কুড়িয়ে পাই একটা ডায়রী। বাসায় নিয়ে এসে খুলে পড়তে বসি। চন্দনা নামের একটা মেয়ে লিখেছে ডায়রীটা। ডায়রীতে লেখা ঠিকানাটা বেশী দূর না হওয়ায় পরদিন ফেরত দিতে গিয়ে জানতে পারি চন্দনা মারা গেছে দু’বছর আগেই। ওখানে তার কেউ ছিল না বিধায় ডায়রীটা ফিরিয়ে নিয়ে আসি।
সমস্ত ডায়রী জুড়ে চন্দনা আপনার কথা লিখে গেছে। লিখেছে আপনাকে নিয়ে তার ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, স্বপ্ন, অপেক্ষা, সমাজ, ভাঙ্গা হৃদয়ের হাহাকারের করুণ ইতিহাস।
পড়ে, আপনার মহত্য আমাকে ছুঁয়ে যায়। একজন বাজারে বিক্রি হওয়া মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সংসারের যে স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিলেন। সেই স্বপ্ন ভিড় করে আমার চোখ জুড়ে। বিশ্বাস করুন আমি এই জীবন আর বয়ে বেড়াতে পারছি না। আমার কোন সমাজ নেই, নেই কোন স্বপ্ন। আমি ফিরতে চাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমি ফিরতে পারব এই মুহূর্তেই। শুধু একটা অবলম্বন দরকার আমার। আমি চাই এমন একটা অবলম্বন, যে আমাকে বুঝবে। আমাকে সাহায্য করবে অন্ধকার থেকে উঠে আসতে। অনেক দেখেছি পৃথিবীর রং। অনেক খুজেছি এমন একটা কিছু। কিন্তু মিথ্যা আর লোভ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। সব আশা ছেড়ে দিয়ে জীবনকে যখন ভাসিয়ে দেব ঠিক তখন চন্দনা নামের এক অচেনা মেয়ের ডায়রী আমাকে পুনঃজাগরণের মন্ত্র দিল। আমাকে সেই দেবদ্রুতের সন্ধান দিল। তাই আপনাকে এমন করে ডাকলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি চন্দনাকে নিয়ে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মনস্থির করে এসেছেন। আপনার চোখ বলছে আপনি চন্দনাকে আজও ভালোবাসেন। জানি না আমি আর আপনার সেই চন্দনার মাঝে কতটা মিল আর অমিল। তবুও আমাকে চন্দনা ভেবে যদি সেই স্বপ্নটা একবার দেখান; সৃষ্টির কসম- আমি আপনার দাসী হয়ে রব।
চন্দনার মৃত্যু আর অধরার এমন আহবান আমাকে বিচলিত করে তুললো। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি এই অধরা মেয়েটা আর চন্দনাকে পাশাপাশি দাঁড় করালে রূপ যৌবন সব কিছুতেই চন্দনা হেরে যাবে। বাউণ্ডুলে মন ভাবনা হারায়। দিশেহারা হয় আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। অধরার অসহায়ত্ব আর ফিরে আসার আকুলতা আমাকে এলোমেলো করে দেয়।
আমি তো নিঃশ্ব। আমার তো হারানোর মতো কিছু নেই। তাই হাত বাড়িয়ে দেই অধরার দিকে। অশ্রুসজল চোখ নিয়ে অধরা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। একটা হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। উড়ে এসে পড়ে আমার শরীরে। আমি ধরে আটকানোর আগেই লুটেয়ে পড়ে মেঝেতে।
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে অধরা আমার জন্য অধরাই থেকে গেল। হয়তো অধরার কলঙ্ক জড়ানো সেই পরিচয়টা গোপন থাকলেও থাকতে পারে এই প্রত্যাশায়, আমার মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে তার ঘুমন্ত চোখ, নিথর রংহীন ঠোঁট, ফ্যাকাশে গাল আর সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহের কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে চিরতরে ঘুমন্ত অধরাকে একা রেখে শত প্রশ্নের সম্মুখিন না হয়ে পালালাম লোকালয় ছেড়ে, নির্জন পাহাড়ী রাস্তা ধরে, কষ্টের বোঝাটা আরও একটু ভারি করে, আমার সেই বাউণ্ডুলে সাজে, অরণ্যের গহীনে।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

 
			 
 