বাউণ্ডুলেঃ স্বপ্ন ফেরিওয়ালা

আমি স্বপ্ন ফেরিওয়ালা। শুধু স্বপ্নই ফেরি করি; লাল, নীল, হলুদ, কালো, সাদা অসংখ্য রংয়ের স্বপ্ন ফেরি করি। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত এমনকি আন্তর্জাতিক সীমানার ওপারেও আমি স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াই। আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমার জাগ্রত স্বপ্নগুলো ফেরির ডালিতে সাজাই। আমার মুগ্ধ করা ফেরির গানে সবাই মুগ্ধ হয়েই আমার স্বপ্ন কেনে- কখনো অনেক দামে, কখনো নাম মাত্র কয়েকটা পয়সায়; আবার কখনো আমি নিজেই অভিলাসী হয়ে আমার স্বপ্ন এমনিতেই দান করে দেই।

আজ অনেক বছর পেরিয়ে গেছে আমি এই পেশাতে এসেছি। এরই মধ্যে আমি অসংখ্য স্বপ্ন ফেরি করেছি। এখনো নতুন নতুন স্বপ্ন ফেরির ডালিতে সাজিয়ে ফেরি করতে চেষ্টা করি। কিন্তু আগের মতো আর ক্রেতা নেই। তাই নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে এখন কোন বিনিময় ছাড়াই স্বপ্ন বিলিয়ে দিতে চেষ্টা করছি। আর স্বপ্নের এক নীড় গড়ে তোলার জন্য নিজেকে নিঃস্বার্থে ভাবে পৃথিবীর পথে সপে দিয়েছি।

নিজের স্বপ্নের ফেরি বাড়ানোর জন্য আমি অনেক ছল-চাতুরির আশ্রয় নেই, নিতে বাধ্য হই। আর এই ছল-চাতুরিই ধীরে ধীরে আমার ব্যবসা ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। যে একবার আমার মন ভোলানো গানে আবেগী ছলনায় মজে আমার স্বপ্ন কিনেছে, সে দ্বিতীয়বার আমার ধূলোও মাড়ায়নি। সে তো স্বপ্ন কিনে তারপর বুঝেছে- কিন্তু আমি তো স্বপ্নের জন্ম দিয়েই বুঝেছি, স্বপ্ন তো স্বপ্নই থাকবে তা কখনো বাস্তবে রূপ নেবে না। তবুও আমি প্রতারনা করি আর বিধাতার সব সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়েও নিজের বিবেক বুদ্ধির দরজা তালা দিয়ে আমার স্বপ্ন কিনতে ভিড় জমায় সেই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিরা। আর শেষে দোষ দেয় আমি নন্দঘোষের।

আমার স্বপ্নগুলো এখন আর কেউ কিনতে চায় না। তাই চারিদিকে যখন অস্তিত্ব এলোমেলো, ঠিক সেই ধ্বংসাত্বক সময়ে আমি আমার সওদায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার চাহিদা মতো স্বপ্ন আনতে পারলাম না। তার বদলে আমার স্বপ্নে চলে আসল কিছু বিষণ্ণ মুখ। যারা আমার মতো নিছক একজন ফেরিওয়ালা ছিল না, ছিল অসংখ্য রঙিন স্বপ্নের স্রষ্টা। আমার বিবেক তাদের নিয়ে একটা জাগ্রত স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। আমার অষ্ট প্রহর দখল করে নিল বিবেকবোধ আর শুভ বুদ্ধির এক সাহসিকতাময় অনুভূতি।

আমার স্বপ্ন আমাকে নিয়ে গেল সেই বিষণ্ণতায় ছাওয়া মুখগুলোর কাছে। তবুও আমি স্বপ্ন দেখি প্রতিনিয়ত। এসব স্বপ্ন দেখে লজ্জায় মরে যাই। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি- যখন স্রষ্টার শ্রেষ্ট সৃষ্টিদের ধোঁকা দিয়ে ফেরি করতাম তখন তো এতটা কাপুরুষ ছিলাম না। তবে এখন কেন সেই বিষণ্ণ মুখগুলোর তাড়া খেয়েও ঘাতক ট্রাকটা থামানোর বদলে বোবা কাপুরুষ হয়ে যাই? কেন সেই নিষ্পাপ আত্মাগুলোর প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়াতে পারি না? এটা কার লজ্জা, আমার না অন্য কারো?

আমার স্বপ্ন আমাকে প্রতি মুহূর্তেই লজ্জা দেয়। একসময় এই লজ্জিত স্বপ্নকে অনেক কষ্টে চোখের পাতা থেকে সরাতে চেষ্টা করি। কিন্তু হাজার স্মৃতির ধারক সেই স্বপ্নের কোন হস্তক্ষেপ করতে পারি না। সেখানে নেই কোন লোডশেডিং, তাই অন্ধকারও হয় না। স্পষ্ট সবকিছু আমাকে জোর করে গিলাতে থাকে আমার অপ্রত্যাশিত স্বপ্ন; কারণ আমি যে স্বপ্ন ফেরিওয়ালা।

আমার স্বপ্ন আমাকে অস্থির সময়ের একটা পর্বে নিয়ে গেল- বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতা, সামাজিক অসাম্যের তীব্রতা, পিটিয়ে মানুষ খুন, ইভটিজিং, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, এসিড নামের হিরোশিমা, অগ্নিদগ্ধ, অপহরণ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি লজ্জাময় দৃশ্যের স্বপ্ন আমার উপর ঢেলে দিল আমার মনুষত্য। আমি সাহসী হয়ে পুনরায় দাঁড়াতে চাইলাম। কিন্তু স্বপ্নের ভারে মেরুদন্ড ভেঙ্গে অচল হয়ে গেলাম। চারদেয়ালের ভিতরে আমার রাজত্ব চলতে লাগলো, স্বপ্নগুলো ডালিতে সাজিয়ে ফেরিতে যাওয়া আর হলো না। আমার স্বপ্নের স্বপ্ন তখন বিদ্রোহী হয়ে দেখা দিল। যেন একে একে আমাকে নগ্ন করে আমার পরিসমাপ্তি ঘটাতে চায়।

গভীর মূল্যবোধ দিয়ে উপলব্ধি করলাম; আমার ফেরিওয়ালা জীবনে কত গলদ, কত চোখের জল, কত নিষ্ঠুরতা, কত ময়লা, কত অসভ্যতা, কত হিংসার আগুন প্রতিনিয়তই বহে গেছে এবং এখনো প্রতিনিয়ত বহেই যাচ্ছে। ধর্ম-শুভবুদ্ধি-বিবেক-মহত্ববোধ আর অনুভুতিগুলোকে চরমভাবে অপমানিত করে কতবার যে পুনমঞ্চস্থ করা হয়েছে ‘‘জোর যার মুল্লুক তার’’ নামক নাটকটি; তার কোন সঠিক হিসাব আমার জানা নেই।

দৃষ্টির অন্তরস্থল থেকে দৃষ্টি দিয়েও ভালো কোন দৃশ্য পেলাম না, সব দৃশ্যেই শুধু কাদার ছড়াছড়ি। তবুও ইচ্ছায় অনিচ্ছায় স্বপ্ন দেখি, দেখতে বাধ্য হই। দেখি ক্ষয়ে যাওয়া জীবন হঠাৎ থেমে যাওয়া নামক ষ্টেশনের দিকে ক্রমশ বেগবান হচ্ছে। হয়তো একদিন হঠাৎ করেই সবকিছু এলোমেলো রেখে, ‘সকাল নয়টার ট্রেন বিকাল পাঁচটায়’ এই অনিয়মের নিয়মটা বাতিল করে দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যাব সেই ষ্টেশনে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে হয়তো আমার উত্তরসুরী কোন এক সাহসী ফেরিওয়ালা আমার স্বপ্নগুলো তার রঙিন ডালিতে সাজিয়ে সেই ষ্টেশন ত্যাগ করে প্রভাত ফেরির গান গেয়ে গেয়ে চলে যেতে লাগবে পরবর্তী ষ্টেশনের দিকে। হয়তো আমার কাপুরুষত্বের জালে জড়ানো বাস্তব স্বপ্নগুলো তার ডালি থেকে কিনে নেবে অস্থির সেই সব সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিরা। সাহসী ফেরিওয়ালার সেই স্বপ্নে থাকবে না কোন ক্লেশ, থাকবে না কোন পরাজয়। হয়তো সেই স্বপ্নই আমাদের মনুষত্বকে নাড়া দেবে। হয়তো সেদিনই দৃঢ় কন্ঠে দাবী করতে পারব- ‘আমরা স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।

লেখকঃ কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ