‘‘বাউণ্ডুলে’’- ছুঁয়ে যায় ঢেউ
আজ সাপ্তাহিক ছুটি। কর্মব্যস্ত জীবনে সকালে ঘুমানোর কোন সুযোগ নেই। ভোর হলেই দৌঁড়াদৌড়ি শুরু, আর রাত গভীর হলে কাল হবে এই মনোভাব নিয়ে জীবনের অপরিহার্য্য কাজ অসমাপ্ত রেখেই ক্লান্ত দেহটাকে শক্ত বিছানায় নিথর করে দিতে বাধ্য হই। কিন্তু আজ আর সকাল সকাল উঠব না এই মনোবঞ্চনা নিযে মনে বেশ বড় একটা আশা নিয়ে নিদ্রা দেবীর কোলে মাথা রেখেছিলাম।
বিধি বাম হলো, ভোর হতেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। মাথাটা বালিশের চেপে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। না তবুও হলো না। তারপর মাথাটা বালিশের নিচে রেখে চেষ্টা করলাম। সফল হতে লাগলাম। প্রায় সফল হয়ে গেছি এমন সময় বাধল বিপত্তি। তলপেট মোচড় দিল; উঠতে বাধ্য হলাম। জোয়ারের মতো উত্তাল শরীরের ভাটা নামলো। ফিরে এলাম বিছানায়। হলো না, তারপর আর সফল হলো না নিয়ম ভাঙ্গার এই প্রচেষ্টা।
বুয়ার বানানো নাস্তায় হামলা শেষে বসলাম দক্ষিণের খোলা বারান্দায়। শুরু হলো; একসাথে অনেক কিছু শুরু হলো। চিন্তায়, চেতনায়, বরান্দায়, জানালায় হাঁটা বসা আর পাশের ফ্লাটের…।
তন্বী একটা মুখ পর্দা সরিয়ে আমার দিকে ঝুকে অপলক চেয়ে রইল। মাথাটা ভন করে ঘুরে উঠল। দৌঁড় দিলাম বরান্দা হতে ঘরের ভেতরে যাওয়ার জন্য। এমন সময় শুনলাম একটা শব্দ যা বারবার আমার কানে প্রতিধ্বনিত হলো- কাপুরুষ।
আমি সুপুরুষ হতে চেষ্টা করলাম না। তবে তোলপাড় ঢেউ বহে গেল সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। আমি নিজেও জানি না, সুন্দরী মেয়েরা আমার দিকে তাকালে কেন এমন হয়। পালানোর জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে। আমি তো সম্পূর্ণ সুস্থ, বলিষ্ট এক তরতাজা যুবক। তবুও এই ভয়টা আমাকে কাপুরুষ বানায়। এর কারণ আমি না জানলেও ভালো একজন ডাক্তার হয়তো বলতে পারবেন- কেন এমন হয়।
তন্বী মেয়েটার কারণে সব এলোমেলো হয়ে গেল। এখন কি করি? ভেবেছিলাম বারান্দায় বসে অর্ধেক দিন কাটিয়ে দেব। তা আর হলো না। ওদিকে যাওয়া আমার জন্য আজকের মতো বন্ধ। না; আর ভালো লাগে না। তুমি মেয়ে আকাশ দেখবে, তা অন্য দিক দিয়ে দেখ না; কেন আমার দিকে না দেখলেই হচ্ছে না?
কি করবো এখন ঘরে বসে। হ্যা- বসে বসে টিভি দেখা য়ায়।
বিছানায় উঠে ঘাড়ের নিচে বালিশ দিয়ে রিমোট কন্ট্রোলটা ডান হাতে নিয়ে শুরু করলাম। ঘরে টিভি একটা আছে বটে তবে তা চালানো হয় না। হঠাৎ অসময়ে একটু চালিয়ে তারপর বাথরুমে ঢুকে যাই। এভাবেই টিভি চলে টিভির মতো আর আমি চলি আমার মতো। না; আজ আর এমন করবো না। ডিস বিল তো প্রতিমাসেই দিতে হচ্ছে। আজ একটু বিলটা উসুল করি।
এক থেকে শুরু করলাম- মাশাল্লাহ, মেদ ভুড়ি দেখানো হচ্ছে আর ভুড়ি কমানোর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও ঔষধের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। দুই টিপলাম- একটা সিগারেট কোম্পানির বিভিন্ন ব্যান্ডের সিগারেটের বিজ্ঞাপন। অপেক্ষা করলাম তিন মিনিট। না, বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছু দেখাচ্ছে না। সবাই তাদের নিজেদের মিথ্যেকে সত্য বানিয়ে জয়গান গাচ্ছে। তিন টিপলাম- টিভির পর্দা জুড়ে একটা বিশাল নাভি দুলে উঠল। লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। এসব ব্যাপারে আমি একটু অনাড়ি। ভেবে পেলাম না মানুষ সপরিবারে এসব কিভাবে দেখে। এরপর পর্দায় নাভির পরিবর্তে যা ভেসে উঠল তা দেখে আমি কুকড়ে গেলাম।
পাশের ফ্লাটের মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। মাগো মা- মুহূর্তের নোটিশে চার টিপলাম- টক শো না বকবক শো কি একটা চলছে। হ্যা, দেখা যায় এটা; একটু নড়েচড়ে বসলাম। আর সাথে সাথে অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেল। উপস্থাপক অতিথিকে কথাটা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ব্রেক ছাড়া গাড়ির মতো অবিরাম চলছে তো চলছেই। উপস্থাপক ভদ্রলোক কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। কিন্তু আমি উনাকে থামিয়ে দিলাম। টিপে দিলাম পাঁচ- খবর।
এই তো এখন আমি দেশ দেশান্তর হবো। কতো কি? খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, এই সেই ইত্যাদি। ওমা, এসব কি বলছে- ও, বুঝেছি- একটু পানি পানের বিরতি। শুরু হলো ডিম, আলু, মাছ, টেলকম পাউডার, সাবান, তেল, ব্রা, পেন্টি, জন্মবিরতিকরন পিল, কন্ডম ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ নেই, অনন্তকাল ধরে চলছে তো চলছেই। প্রায় আট মিনিট পর দেখলাম- এবার আপনাদের নিয়ে যাব চেন্নাই।
আমি চেন্নাই গেলাম কিন্তু একটা মশার জ্বালায় কিছুই দেখা হলো না। যখন মশাটা জানালা দিয়ে উড়ে গেল তখন দেখলাম আমি আমার মাতৃভূমির পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে অশান্তির ভূমিকম্প দেখছি। মানুষের কষ্ট দেখলাম, রক্ত দেখলাম, গলিত লাশ দেখলাম আর দেখলাম বড় বড় মেদ ভুড়ি। আচ্ছা এই মোটা মোটা লোকেরা কি মেদ ভুড়ির বিজ্ঞাপন দেখে না? না কি এটাও তাদের একটা গর্ব।
যাক খবরের যবনিকায় বলবো- বিশ মিনিটের খবরে ত্রিশ মিনিট বিজ্ঞাপন দিলে আমার মতো যারা, তাদের তালগোল পাকিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।
অবশেষে খবর শেষ হলো, শুরু হলো বিজ্ঞাপন। সব মিথ্যের ফেরিওয়ালা। একটা মিথ্যা যদি এভাবে দিনে একশত বার করে বলে প্রতারণা করা হয়- মানুষ মিথ্যাটাকে সত্য ভাবতে বাধ্য হয়ে যায়। বিজ্ঞাপন শুধু বিজ্ঞাপন। আমি চলে গেলাম ছয়ে- ঝগড়া চলছে। টক শো- টক, মিষ্টি, ঝাল হয়ে গেছে। আমি রিমোটের বাটন টিপলাম। বিজ্ঞাপন। আবার টিপলাম। এখানেও বিজ্ঞাপন। চ্যানেলের পর চ্যানেল। বিজ্ঞাপনের পর বিজ্ঞাপন। একেকটায় একেক ধরনের বেহায়াপনা। একেকটায় একেক ধরনের ছবি- লাল, নীল, কালো, হলুদ, সাদা আরও কতো রং। শুধু রং আর রং।
না, আর ভাল লাগে না। বিনোদনের জিনিসে বিনোদন নেই। আছে বিরক্তিকর কিছু অনুভূতি। আছে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঝামেলা। আছে মাঘের শীতে শরীর গরম হয়ে যাওয়ার মতো কিছু স্পর্শ। বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন। আজকাল নাকি স্বাধীনতার বিজ্ঞাপনও দেখা যায়। বাহ, চমৎকার! বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের দেশকে, নিজের অস্তিত্বকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। মানুষ! এ দেশের মানুষ নিজেদের কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছে। নিজেদের প্রজন্মকে হারিয়ে দিচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকায়। হারিয়ে দিচ্ছে গ্রহ গ্রহান্তরে। এ দেশের মানুষকে দেখে মনে হয়, ফার্মের মুরগির মতো। আমরা একেকজন খোপে বড় হচ্ছি আর মাংসল হচ্ছি। কারও একটু সময় নেই। অকাজে ব্যস্ততা।
টিভিটা বন্ধ করে নীরবে বসে রইলাম। কলিং বেল বেজে উঠল। বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আলতো করে দরজার কবাট খুললাম। ভয়ে দিশাহারা হলাম। এবার যে পালানোর পথে যম দাঁড়িয়ে।
প্রায় এক ঘন্টা। আমি মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে এসেছি। পাশের ফ্লাটের সেই তন্বী যুবতী আমাকে জড়াতা কাটানোর টিপস দিয়েছে। এক সময় আমার কান গরম হয়ে গেল। আমি ছটফট শুরু করলাম। সে খুব আন্তরিকার সাথে আমার জন্য চা করে নিয়ে এলো। আমার সামনে বসে তার কাপে চুমুক দিল। আমি বোবা হয়ে রই আর বোকা হয়ে তাকে অনুসরণ করি।
ধীরে ধীরে সে আমার কাছে আসার কারণ ব্যাখ্যা করলো। সে আমাকে জাগাতে চায়। আমাকে এ সমাজের ঘুনে ধরা ছাদের মিস্ত্রী বানাতে চায়। তার খোচা দেওয়া মিষ্টি ভালোবাসার কথায় আমি সুপুরুষ হই। সে তার অভিলাষ প্রকাশ করে; সে নাকি এভাবে ঘুমন্ত কিছু যুবককে জাগাতে চায়- যারা একত্রে এ দেশের জন্য অন্ততপক্ষে একটা ভালো কাজ করবে এবং কমপক্ষে একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। এভাবে কালক্রমে একের পর এক- একজন যুবতী তার যৌবনের উজ্জল আলোয় ঘুমন্ত কিছু যুবককে জাগালে একদিন হয়তো আমরা কাঙ্ক্ষিত সোনার দেশ পাব। সোনার মানুষ হয়ে গর্বভরে বুক চিতিয়ে বলতে পারব- আমরা পেরেছিলাম, আমরা পারছি, আমরা পারব।
যুবতী চলে যাওয়ার পর পরই শরৎ-এর সন্ধ্যা নামলো। এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নির্জন হলো। একটা অমসৃণ দাগ মিটে গেল আমার মনের আকাশ থেকে। ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
ঘুম আসে না। কেমন যেন একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করি নিজের মাঝে। বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে টিভিটার সামনে দাঁড়াই। সুইচ টিপে রিমোট হাতে নিয়ে পুনরায় বিছানায় বসে পড়ি। ভাবি এখন হয়তো ভালো কিছু দেখতে পারব। না, আশা নিরাশায় রূপ নেয়। দিনে যা রাতেও তা। আমি চ্যানেলান্তর হই।
এক সময় একটা চ্যানেলে থামতে বাধ্য হই। একটা প্রাপ্তবয়স্কদের ছবি। সাউন্ড ছাড়াই মানব-মানবীর কীর্তিকলাপ। পায়ে মশা কামড়ায়। দৃশ্যগুলো যদিও আমাকে নাড়ায় তারপরও মনটা যেন কেমন অপরাধবোধে ভোগে। সুইচ বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। কূল কিনারা পাই না। ভাবি তন্বী মেয়েটার কথা। সমাজ তো এমন একটা জাগরনের মন্ত্র চায়। এমন একটা মা, এমন একটা বোন, এমন একটা স্ত্রী যদি আমরা পাই, আমরা বারবার বলতে পারি- আমরা পেরেছিলাম, আমরা পারছি, আমরা পারব।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কেকে