মনস্তাত্ত্বিক গল্পঃ ‘স্বপ্নলাল’
অনিশা’র সঙ্গে আমার যে এভাবে হঠাৎ শপিং মলে দেখা হয়ে যাবে তা কল্পনাও করিনি। সেদিন অকারণে ফোনে দু’জনের বেশ কথা কাটাকাটি হওয়ার পর কেউ কারো সঙ্গে কথাই বলিনি। অবশ্য আমি বেহায়ার মতো অনেকবার ট্রাই করেছিলাম। কিন্তু অনিশার ফোনটা বারবার সুইচড অফ বলছিল।
এটা নতুন কিছু নয়। একটু রেগে গেলেই অনিশা সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে রেখে দেয় কয়েকদিন। আবার একটু মাথা ঠাণ্ডা হলে নিজেই যোগাযোগ করে আমার সঙ্গে। আমি তাকে টুনটুনি-ঝুনঝুনি বলে আদর-সোহাগে ভরিয়ে দেই।
কিন্তু এবারে বেশ অনেকদিন হয়ে গেল অনিশা যোগাযোগ করলো না। তাই ভেবেছিলাম আজ অফিস থেকে ফেরার সময় অনিশার সঙ্গে দেখা করে আসবো।
একটা ভালো গিফট কিনে অনিশার “সামানা” থেকে বেরোতে যাব এমন সময় হঠাৎ করেই তার সামনে পড়ে গেলাম!
আমার অনিশা, আমার টুনটুনি ঝুনঝুনি- আমাকে দেখেই দ্রুত হেটে রাস্তায় নেমে গেল। তার এমন আচরনে হতবাক হয়ে গেলাম। মুহূর্ত সময় পরে যখন নিজেকে ফিরে পেলাম তখন দেখলাম অনিশা ফুটপাতে দাড়িয়ে আছে।
একটা লাল মারুতী গাড়ি এসে থামল অনিশার কাছ ঘেষে। সে হাসি মুখে এক অচেনা যুবকের পাশে উঠে বসলো। আমার মস্তিষ্কে হাজার প্রশ্ন, বুকে বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে অনিশা টুনটুনি ও অচেনা যুবক আর লাল মারুতী দ্রুতবেগে ছুটে চললো দক্ষিণমুখী হাওয়ার সাথে।
কল্পনায়- জীবনের অনাগত সময়ে অনিশাকে স্থাপন করে হিসাব মেলাতে চাইলাম। হিসাব অসমাপ্ত রয়ে গেল বারবার। আমাকে কি ভাবলো অনিশা! আমিও তো একটা মানুষ- নাকি!
শরৎ এর গোধূলী যৌবনে পা দিয়েছে। তা দেখে কেন জানি নিজের ওপর একটা প্রচণ্ড রাগ হলো। রাস্তায় নেমে এসে কেনা গিফটটা অন্ধ ভিক্ষুক মহিলাকে দিয়ে দিলাম।
এমন সময় হঠাৎ রাস্তার ওপাশে অনিশাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ক্ষণকাল আগে সে যখন লাল মারুতীতে উঠে চলে গিয়েছিল তখন তার পরনে ছিল সাদা ড্রেস আর এখন মুহূর্ত সময় পর সে আকাশী রং এর ড্রেসে নিজেকে সাজিয়ে আরও অপরূপা হয়ে হাতছানি দিয়ে আমকে ডাকছে।
ভালোবাসা নাকি অনিশা- কে আমাকে সম্মোহিত করলো আমি নিজেও জানিনা। অদ্ভুত এক সম্মোহনি শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে গেল রাস্তার ওপারে। এমন সময় সেই যুবক আর লাল সেই মারুতী গাড়ি এলো। অপূর্ব টুনটুনির নির্দেশে কোন কথা না বলে আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি এবার উত্তরের পাহাড়ি রাস্তা ধরে ছুটে চললো।
আমি যখন নিজেকে ফিরে পেলাম- তখন বাহির থেকে তালা দেওয়া “অনিশা হেভেন” নামক অনিশার বাড়ির সদর দরজায় দাড়ানো অবস্থায় আবিষ্কার করলাম!
অতঃপর আর একটি অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য কথা প্রকাশিত হলো। পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে জানা গেল- গত দশ বছর ধরে এখানে অনিশা অথবা টুনটুনি নামে কেউ থাকে না! অথচ আমি এর আগে দু’ দু’বার এখানে এসেছিলাম!
একবার এসে শুধু বাসাটা চিনে গিয়েছিলাম। সেবার অনিশাই আমাকে সাথে করে নিয়ে এসেছিল; যদিও সেদিন তাদের বাসায় আমি ঢুকেনি। তবে পরে আরেকদিন অনিশার আমন্ত্রণে এই বাসায় এসেছিলাম। সেদিন তার বাবা মা কেউই বাসায় ছিলেন না। ফাঁকা বাসায় দু’জন এক সাথে প্রায় তিন ঘণ্টা থেকেছিলাম। কল্পনায় কত রঙিন ফানুস উড়িয়েছিলাম- তার হিসাব রাখতে দু’জনই সেদিন ভুলে গিয়েছিলাম।
আজ এখানে- এ অস্থীর মুহূর্তে হঠাৎ অনুভব করলাম বাতাসে ভেসে আসছে অনিশার গা’য়ের সেই চির চেনা সুগন্ধ। অতঃপর রাস্তায় শত শত লাল মারুতী গাড়ি দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। অদৃশ্য চোখে দূরের এক দৃশ্য ভেসে উঠলো- লাল বেনারশী শাড়ি পড়ে অমলিন হাসিতে ভেসে যাচ্ছে আমার মনমোহিনী অনিশা। পাশেই সেই লাল মারুতী গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে অছে অচেনা সেই যুবক। অনিশা যুবকের কাঁধে মাথা রেখে একহাতে তার কোমর পেচিয়ে ধরে আছে।
সিনেমার ধীর মোশন দৃশ্যের মতো একটু একটু করে যুবকের চেহারাটা আমার দিকে ঘুরলো। এ চেহারা এ মুছকি হাসি আমার খুব পরিচিত; বহুবার দেখা হয়েছে আয়নায়। এ যুবককে আমি চিনি বহুকাল ধরে। আমি আয়নায় যখনই দাঁড়াই- একেই দেখি। অদ্ভুত হলেও সত্যি, সে আর কেউ নয়- এ তো আমি নিজেই!
লেখকঃ কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান