রহমতে আলম (সাঃ) : সু-মহান মর্যাদা (পর্ব এক)
বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী আবু জেহেল, আবু লাহাব, উতবাহ, নমরুদ ও ফেরাউনের অনুসারীরা সৃষ্টি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ
মহামানব রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সু-মহান মর্যাদার অবমাননা করার জন্য উটে পড়ে লেগেছে। মূলত তাদের এই কাজ নতুন নয়। বরং এটা তাদের পূর্বসূরীদের অনুসরণ করেই করছে। এতে করে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সু-মহান মর্যাদার তিল পরিমাণ কোন অবমাননা হয়নি হবেও না। বরং কুরআন, হাদীস, সিরাতের বিভিন্ন কিতাব ও ইতিহাস প্রমাণ করে যারাই রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ নাবী রাসূলদের, ইসলাম ধর্মের, কুরআন শরীফের ও হাদীস শরীফের অবমাননা করতে চেয়েছে তারাই ধ্বংস হয়েছে। বিশেষ করে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সু-মহান মর্যাদার অবমাননা করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি আর হবেও না। তার একমাত্র কারণ হলো তাঁহাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সু-মহান মর্যাদার অধিকারী বানিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যে সু-মহান মর্যাদা দান করেছেন, তা আর কাউকে দান করেননি। সৃষ্টি জগতে সর্বোচ্চ সু-মহান মর্যাদার অধিকারী হলেন রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে সূরা ইনশিরাহ এর ৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন- “আর আমি আপনার (মর্যাদার) জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি”।
অর্থাৎ যেখানে আল্লাহ তায়ালার নাম আসবে সেখানে নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামও আসবে। যেমন আযান, ইকামত, শাহাদাত ইত্যাদি। এ হিসাবে সারা বিশ্বে প্রতি মুহূর্তে তাঁর নাম উচ্চারিত ও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া পূর্ববর্তী গ্রন্থেও নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম ও গুণাবলীর বিবরণ রয়েছে। ফেরেশতারাও তাঁর নাম সম্মানের সাথে উল্লেখ করেন। মুসনাদে আহমদে সহীহ সনদে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- একদা হযরত জীব্রাঈল (আঃ) আমার কাছে আগমন করলেন এবং বললেন, নিশ্চয়ই আমার ও আপনার প্রভু আপনার আলোচনাকে কি করে সমুন্নত করবেন তা তিনি জানতে চান? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সেটা আল্লাহ তায়ালা ভাল জানেন। হযরত জীব্রাঈল (আঃ) বললেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমার কথা যখন আলোচনা করা হবে তখন আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথাও আলোচিত হবে”।
সুতরাং আমরা পরিষ্কার ভাবে বলতে পারি সৃষ্টি জগতে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হলেন রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর এই সমস্ত সু-মহান মর্যাদার কথা কুরআন, হাদীস, সিরাতের কিতাব ও বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আদম (আঃ) এর আগেও নবী।
মুসনাদে আহমদ সহ অনেক হাদীসের কিতাবে সহীহ সনদে এসেছে- “হযরত ইরবাস ইবনে সারিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আদম (আঃ) যখন কাদার মধ্যে ভুলুন্ঠিত ছিলেন তখনই আমি আল্লাহর নিকট লাওহে মাহফুযে সর্বশেষ নাবী ছিলাম। আমি আমার পিতা (পিতৃপুরুষ) ইব্রাহীম (আঃ) এর দোয়া, ঈসা (আঃ) এর সু-সংবাদ এবং আমার মায়ের স্বপ্ন যা তিনি দেখেছিলেন যে, তাঁর ভেতর থেকে একটি নূর বের হয়ে সিরিয়ার প্রসাদগুলোকে আলোকিত করেছে। আর এরূপ স্বপ্ন সকল নবীর মা দেখেছিলেন”। তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার নবূওয়াত কখন অবধারিত হয়েছে? তিনি বললেন- যখন আদম (আঃ) তাঁর শরীর ও রুহের মধ্যে ছিল”।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বোত্তম বংশে আগমনকারী।
তিরমিজী শরীফের হাদিসে এসেছে- “হযরত মুত্তালিব ইবনে আবী ওয়াদাআ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে এলেন, মনে হয় তিনি যেন কিছু শুনতে পেয়ে মিম্বারে অরোহন করলেন। অতঃপর বললেন, আমি কে? সাহাবাগণ বললেন, আপনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হউক। তিনি বললেন, আমি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দিল্লাহ ইবনে আব্দিল মুত্তালিব। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি কুলকে সৃষ্টি করে আমাকে উত্তম দলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি উত্তম দলকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করে আমাকে উত্তম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি উত্তম গোত্রকে বিভিন্ন ঘরে বিভক্ত করে আমাকে উত্তম ঘর ও উত্তম বংশের অন্তর্ভুক্ত করেছেন”।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হলেন মহামানব।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন মানুষ। তিনি জিন বা ফেরেশতা ছিলেন না। কেননা জিন ও ফেরশতা থেকে মানুষ উত্তম। তবে মনে রাখবেন আমাদের মত সাধারণ কোন মানুষ না। বরং তিনি অতিব মহামানব। আল্লাহ তায়ালা সূরা তীনের ৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন- “অবশ্যই আমি মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর গঠনে সৃষ্টি করেছি”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সৌন্দর্যের বর্ণনা শামায়েলে তিরমিজী শরীফে এসেছে- “হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একবার পূর্ণিমা রাত্রির স্নিগ্ধ আলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লাল চাদর ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। তখন আমি একবার তার দিকে ও একবার চাঁদের দিকে তাকাতে থাকলাম। মনে হলো তিনি আমার কাছে পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে অধিকতর চমৎকার”।
হযরত হাসান বিন সাবিত (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সু-মহান মর্যাদা ও সু-মহান চরিত্র সম্পর্কে অনেক কবিতা লিখেছেন ও গেয়েছেন। এসবের মধ্যে অন্যতম একটি হলো- অর্থ: “আপনার চেয়ে সুন্দর পৃথিবীর কোনো চোখ দেখেনি, আপনার মতো সুন্দর সন্তান কোনো মা জন্ম দেয়নি। আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে নিখুঁতভাবে, যেন আপনি বলেছ যেভাবে, সেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে”।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সমগ্র সৃষ্টির নাবী।
সূরা ফুরকানের শুরুতেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “কত প্রাচুর্যময় তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন। যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে” এখানে সারা বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হবার যে কথা এখানে বলা হয়েছে এ থেকে জানা যায় যে, কুরআনের দাওয়াত ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রিসালাত কোন একটি দেশের জন্য নয় বরং সারা দুনিয়ার জন্য এবং কেবলমাত্র নিজেরই যুগের জন্য নয় বরং ভবিষ্যতের সকল যুগের জন্য। এ বিষয়বস্তুটি কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিবৃত হয়েছে। যেমন সূরা আরাফের ১৫৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আপনি বলুন, হে মানুষেরা! আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত”। এ বিষয়বস্তুটিকে আরো সুস্পষ্টভাবে নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে বার বার বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় প্রদান করা হয়েছে, যা আমার পূর্বে কোন নাবীকে দেয়া হয়নি। (১) আমাকে এমন প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যা একমাসের দূরত্ব পর্যন্ত অনুভূত হয়। (২) সমস্ত যমীন আমার জন্যে সালাত আদায়ের স্থান ও পবিত্রতা অর্জনের উপায় করা হয়েছে। কাজেই আমার উম্মতের যে কেউ যেখানে সালাতের ওয়াক্ত হয় (সেখানেই) যেন সালাত আদায় করে নেয়। (৩) আমার জন্য গনীমত হালাল করা হয়েছে। (৪) অন্যান্য নাবী নিজেদের বিশেষ গোত্রের প্রতি প্রেরিত হতেন আর আমাকে সকল মানবের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে। (৫) আমাকে সার্বজনীন সুপারিশের অধিকার প্রদান করা হয়েছে”। নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই এই একই বক্তব্য বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্নভাবে পেশ করেছেন। যেমন মুসনাদে আহমদে এসেছে- তিনি বলেছেন, আমাকে সাদা কালো সবার কাছে পাঠানো হয়েছে”। একই কিতাবের অন্য হাদীসে তিনি বলেছেন- আমাকে ব্যাপকভাবে সমস্ত মানুষের কাছে পাঠানো হয়েছে। অথচ আমার আগে যে নবীই অতিক্রান্ত হয়েছেন তাঁকে নির্দিষ্ট জাতির কাছে পাঠানো হতো”।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সু-সংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এসেছেন।
সূরা আস-সাবার ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর আমি তো কেবল আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সু-সংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না”।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নাবী ও রাসূল।
সূরা আরাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “যারা অনুসরণ করে রাসূল ও উম্মী নাবীর, যার উল্লেখ তারা তাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জীলে লিপিবদ্ধ পায়”।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সকল নাবীদের সর্দার।
নবুয়তের দশম হিজরী ২৭ শে রজব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজ রাতে যখন বায়তুল মুকাদ্দাসে গেলেন তখন তিনি সকল নাবীদের নামাজের ইমামতি করেন। এ থেকে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সকল নাবীদের সর্দার।
আল্লাহ তায়ালা হলেন রাব্বুল আলামীন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন রাহমাতুল্লীল আলামীন।
———-চলবে ইনশা আল্লাহ
লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান