জীবনের গল্পঃ ‘অণু’


(১)
তার সাথে আমার প্রথম দেখা মস্কো’র চেরেমেতেইভো এয়ারপোর্টে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের যাত্রীবাহী প্লেন থেকে নেমে মেঘলা আকাশ আর ঝড়ো বাতাসের মাঝেই টারমাক ধরে এগোচ্ছি। লৌহযবনিকার অভ্যন্তরে একটা আলোড়ন, একটা স্পন্দন মনে নাড়া দেয়। হঠাৎ দেখি টারমাকের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে অস্থির প্রকৃতির এক যুবতী। এক হাতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ লেখা একটা ট্র্যাভেল ব্যাগ। ওপর হতে একটা পানামা হ্যাট। পরনে নীল টপকোট আর নীল ট্রাউজার; পায়ে কালো জুতো। চঞ্চল চোখ নিজের চারিদিকে কি যেন খোঁজছে সবসময়। স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য্য, কোমলতা, উচ্চতা আর ব্যক্তিত্বের অপূর্ব একটা সমাবেশ ঘটেছে মেয়েটার মাঝে। ফর্সা লালচে মুখ আর গভীর চোখ জোড়ায় যেন কিসের একটা অপরাধ খেলা করছে। তারপরও স্থির দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় যেন কোন দক্ষ ভাস্করের সারা জীবনের সাধনার ফল।

কাস্টমস ডেস্কের কাজ শেষ করলাম। চারিদিকে মানুষের স্রোত; যে কোন আন্তর্জাতিক টার্মিন্যালে এটাই স্বাভাবিক। উজ্জ্বল লাল-নীল-কালো-হলুদ সিল্ক ঝলমল করছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম মেইন গেইটের একটু ভিতরে ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে সেই মেয়েটি। স্পন্দিত হৃদয় নিয়ে তাকে দেখলাম। সে চোখ ঘুরিয়ে নিল। আমি বোকার মত তাকিয়েই থাকলাম। আমার তাকানো টের পেয়ে ধীরে ধীরে সেও ঘাড় ফিরিয়ে নিঃশব্দে তাকাল। তার দেহ, মুখ-ভঙ্গি আর দৃষ্টি থেকে শুধু আমার জন্য একটাই ভাষা বিচ্ছুরিত হল- ভালোবাসতে জান।
ভালোবাসতে জানি কিনা নিজেই বুঝি না। তবে মেয়েটি সেদিন আমাকে কোন কথা না বলে শুধু ভাবনায় ভাসিয়ে দিয়ে নিজে জনারণ্যে ভেসে গেল।

(২)
প্রায় পনের দিন পর কমসোমলস্কায়া যাওয়ার জন্য পাভোলেতস মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। স্টেশনটা দেখে মুগ্ধ হলাম। প্ল্যাটফর্মের ধারে ফুলের বাগান। চারিদিক ঝকঝক তকতক। কোথাও একটা ছেঁড়া কাগজ বা সিগারেটের টুকরোও নেই। স্টেশনের বিশাল থামগুলো আসলে থাম নয়, একেকটা স্ট্যাচু। সংখ্যায় এত বেশি যে মনে হয় গুনে শেষ করা যাবে না। স্টেশনের অপূর্ব কারুকাজ যখন আমার চোখকে ছাড়ছে না তখন ট্রেন এসে ধীরে ধীরে স্টেশনে থামল। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে কালো টানেল থেকে বেরিয়ে আসা ট্রেনটাকে আমার কাছে এই সুন্দর পরিবেশে একেবারেই বেমানান লাগল।

সারা দুনিয়ার ট্রেন যাত্রীদের যেমন দেখায়; এখানেও তেমনই। ট্রেন এসে থামতেই ক্লান্ত, একঘেয়েমির শিকার, আত্মকেন্দ্রিক কিছু লোকের সাথে উঠে পড়লাম। নির্ধারিত সিটে গিয়ে বসলাম। দেখলাম পাশের সিটে বসে আছে হৃদয়ে স্পন্দন সৃষ্টিকারী ভেনাস- এয়ারপোর্টে দেখা সেই মেয়েটি। পরস্পরের দেখা হওয়ায় বিস্ময় আর ভালোলাগার একটা ঝিলিক আমার মত তাকেও ছুঁয়ে গেল।

হাই, হ্যালো দিয়েই কথা শুরু। জানলাম তার নাম অণু; কলিকাতার মেয়ে। এই পরিচয়গুলো যখন সারছি ট্রেন তখন মস্কোর মাঝখান থেকে উত্তর-পূর্বদিকে যাচ্ছে। যখন তাগানস্কায়া স্টেশন অতিক্রম করি তখন আমরা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছি। আর কুরস্কায়া ছাড়ার আগেই আমরা একে অন্যের অনেক কিছুই জেনে গেলাম। কথায় কথায় যখন কমসোমলস্কায়া পৌঁছালাম তখন আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে যখন একে অপরের কাছে থেকে বিদায় নিলাম তখন দেখলাম আমার মত অণুর কথাগুলোও গলায় আটকে যাচ্ছে। বিচলিত একটা অবস্থায় বিশাল এই পৃথিবীর বুকে নিজ নিজ পথে পা বাড়ালাম।

(৩)
আমার ঘনিষ্ট বন্ধু পিটি মস্কো’র এক স্যানিটারী ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানীর ট্রাক চালক। কমসোমলস্কায়া মেট্রো স্টেশন থেকে মাত্র সিকি মাইল দূরে ঐ কোম্পানীর এক ওয়্যারহাউজে থাকে সে। আমার নির্দিষ্ট কাজ শেষে তার সাথে দেখা করতে গেলাম। বন্ধু আমাকে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল। প্রস্তাব রাখল- এবার কিন্তু কমপক্ষে পাঁচদিন থাকতে হবে। আমিও ফ্রি থাকায় রাজি হয়ে গেলাম।

পরদিন রাতে পিটি জানাল কাল তাকে একটা হোটেলের জরুরী অর্ডার নিয়ে কুইবিশেভ যেতে হবে। একা যাচ্ছে তাই প্রস্তাব রাখল তার সাথে যাওয়ার জন্য। আমিও খুশি মনে রাজি হয়ে গেলাম।

কুইবিশেভ বিলিয়ারস্ক থেকে একশো মাইল দক্ষিণের ছোট একটা শহর। মস্কো থেকে কুইবিশেভের দূরত্ব প্রায় সাতশো মাইল। এপ্রিলের চমৎকার একটা সকালে আমরা রওয়ানা হলাম। এবং খুব ভালোভাবেই পৌঁছে ডেলিভারি দিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।

ফিরতি পথে কাজানের একটু আগে ভালগার ওপর লিনিন ব্রিজে একটা মেয়ে লিফট চাইল। কাছাকাছি আসতেই অণুকে দেখে অবাক হলাম। বিশাল ট্রাকের ক্যাবে তাকে উঠালাম। জানলাম তার এখানে আসার কারণ।

প্রায় দশ ঘন্টা ঝাঁকি খেয়ে শরীর থেঁতলে গেল। বাতাস আর ইঞ্জিনের একটানা গর্জন অস্থির করে তুলল। মন আর চোখ একঘেয়েমির শিকার হল না শুধু অণুর জন্য। চারিদিকে আধো আলো আধো অন্ধকার, বৈচিত্রহীন, নিঃশ্ব, ধূসর খাঁ-খাঁ প্রান্তর; সেই উরাল পর্যন্ত যার বিস্তৃতি, বিলিয়ারস্ক ছাড়িয়ে আরও দুশো মাইল। এগুলো সব ভুলিয়ে দিল অণু।

তাকে ক্যাবে উঠানোর পর যখন বন্ধু পিটি বুঝল আমাদের মাঝে ভালোবাসার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে তখন সে চুপ হয়ে গাড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর পিটির সেই নীরবতার মাঝে দীর্ঘ একটা সময়ে অণু আমাকে শেখাল ভালোবাসা, শেখাল বাউণ্ডুলে জীবনের সমাপ্তির গান, শেখাল স্বপ্ন দেখা। বিদায়ের আগে হল মোবাইল নাম্বার বিনিময়, হল ফেসবুক আইডি লেনদেন।

(৪)
কেটে গেল একটা বছর। প্রতিদিন প্রতিরাত কথা হত দু’জনের। নেটেও যোগাযোগ হত। দূরে বসবাস করলেও প্রায়ই দেখা করতাম দু’জন। অণু আমাকে আশা দিত, ভালবাসা দিত, স্বপ্ন দিত, বিশ্বাস দিত, আশ্বাস দিত আর দিত একটা নীড়ের প্রত্যাশা।

একসময় আমরা দু’জনই চাইলাম একটা সংসার। দু’জন নিঃসঙ্গ বাউন্ডুলে এক হব, থামব জীবনের পথে, গড়ব একটা ছোট নীড়; এই আনন্দে অণু পরমাণুতে বিভক্ত হতে লাগল।
আমরা একটা তারিখ ঠিক করলাম। দু’একজন বন্ধু-বান্ধব থাকবে আমাদের বিয়েতে। ছোট পরিসরে সব সারার সিদ্ধান্ত নিতে পারায় আমরা শান্তির নিশ্বাস ছাড়লাম।

নির্ধারিত তারিখের দুই দিন আগে ঘটে গেল আমার জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত, কষ্টদায়ক এক ঘটনা। রাতে যখন ঘুমাতে যাব রোজকার নিয়মে অণু ফোন দিল। দীর্ঘ এক ঘন্টা কথা বলার পর আমরা থামলাম। মোবাইল বালিশের পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙ্গাল রিং টোনে সেট করা নচিকেতা। ঘড়ি দেখলাম। রাত দু’টা। দেখলাম অণু কল করেছে। রিসিভ করলাম। আর সাথে সাথে আমার কানে যা ভেসে আসল তা শুনার আগে আমার মরা উচিত ছিল।

অণু হয়তো মোবাইলটা তার বালিশের পাশে রেখেছিল। আর অস্থির সময়ে তার অজান্তেই টিপ পড়ে গেছে বাটনে। ডায়েলের প্রথমেই হয়তো আমার নাম্বারটা ছিল। তাই অণুর অজান্তে একটা যন্ত্র- মোবাইল ফোন আমাকে জানিয়ে দিল আমি কাকে ভালোবেসে স্বপ্ন দেখেছি বাউণ্ডুলে জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে নীড় গড়ার। কাকে ভালোবেসে থেমে যাচ্ছি ভুল সরাইখানায়।

কিছু ফিসফিসানি, বিছিন্ন কিছু ভালোবাসার কথা, অণুর আন্দোলিত আর্তনাদ, একটা পুরুষ কন্ঠের বিচিত্র শব্দ, ছড়ছড়-ফড়ফড়, অণুর হাসি, খাটের স্পিং- এর ছন্দময় সুর, দু’জন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্রত উঠানামা।

এলোমেলো হয়ে গেল আমার পৃথিবী। আলতো করে মোবাইলের লাল বাটনটা টিপলাম। পৃথিবীর কেউ জানবে না, এমন কি অণুও জানবে না, কোন জবাবদিহিতা না চেয়ে, কোন ক্ষমা চাওয়া জোড় হাতের সামনে না দাঁড়িয়ে, আগের কষ্টের বোঝাটা খুলে আরও কিছু কষ্ট ঢুকিয়ে বোঝাটা ভারি করে কাঁধে নিয়ে পিটটা বাকা করে হারিয়ে যাব পৃথিবীর পথে, হারিয়ে যাব জনারণ্যে, হারিয়ে যাব হয়তো অসীম অরণ্যে, অসীম মৃত্তিকায়, অসীম সাগরে।

পরদিন মস্কো’র উদিত লাল সূর্য্য দেখল এক বাউণ্ডুলে গতানুগতিকভাবে হাটছে হইওয়ে ধরে এলোমেলোভাবে। হাটছে হারিয়ে যেতে। হাটছে নিজেকে ভুলে যেতে।

লেখকঃ কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ