এক গল্পকারের গল্প

অরণ্য একজন লেখক। তার সৃজনশীলতা লতাকে যেমন পাগল করে তুলে তেমনই লতার অপূর্ব সৌন্দর্য্য তাকেও মায়াজালে জড়িয়ে ধরে। ফলস্বরূপ হাতছানি। পাশাপাশি এসে পরস্পরকে বোঝা। তারপর প্রেম প্রেম খেলা দীর্ঘ তিনটি বছর। অতঃপর সংসার। ভালোবাসার সাগরে সাঁতার কাটা। জন্ম পরীর।

স্বামী স্ত্রী দু’জনই চাকরী করেন। একজন সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আর অন্যজন শিক্ষক। সংসার জীবন যখন সুন্দর বোঝাপড়ার মাঝেই চলছিল তখন হঠাৎ করেই মেঘে ঢেকে গেল সূর্য। কালবৈশাখী ধেয়ে এলো এই তাজমহলে।

পরীর বয়স যখন তিন বছর। অরণ্যের সাহিত্যিক জীবন তখন পুরোধমে চাঙা। এমনই এক সন্ধ্যায় অরণ্য যখন রিক্সায় অফিস থেকে বাসায় ফিরছে তখনই এলো দশ নম্বর সতর্ক সংকেত নিয়ে এক ঝড়ের পূর্বাবাস।

বরাবরের মতো সে মুহূর্তেও অরণ্য বুঝলো ধেয়ে আসা ঝড় কিভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে তাকে। তবুও নিজেকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হলো। এবং যা হবার তাই হলো- একটা আগ্রাসী সাইক্লোন বহে গেল তার ওপর দিয়ে। কিন্তু লতা আর পরী বুঝতেই পারলো না সেই ঝড়টা তাদের অজান্তে তাদের দিকেই ধেয়ে আসছে।

বর্ষা নামের যে মেয়েটি অরণ্যকে ফোন করেছিল- তার কন্ঠে ছিল এক চুম্বক শক্তি। সেই টানে অরণ্য নিজেকে কোনভাবেই ধরে রাখতে পারলো না। শুরু হলো পাশাপাশি আসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। বিশ্বাস, মর্যাদা, স্নেহ, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ সব জলাঞ্জলি দিয়ে অরণ্য যখন বর্ষার প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে তখন নিজের অজান্তেই বর্ষাকে তার পরিবার সম্পর্কে জানালো। বর্ষা সব জেনেও পিছ পা হলো না।
অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো প্রথম দু’জন দেখা করবে। তারপর আজীবন পাশাপাশি থাকবে; না দু’জনার দু’টি পথ দু’দিকে চলে যাবে- তার ফয়সলা হবে।

নিয়তি বড় নিষ্ঠুর খেলা খেললো অরণ্য আর বর্ষাকে নিয়ে। আর অজান্তে সেই খেলার ছায়া পড়ে গেল লতা আর পরীর ওপর।

অরণ্য অফিসের কাজে ঢাকা যাচ্ছে বলে চলে গেল বর্ষার সাথে দেখা করতে। তাদের দেখা হলো এক শ্রাবণ সন্ধ্যায়, নির্জন এক পার্কে। তীব্র একটা অজানা টানে পরস্পর মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল সেদিনই।

মিরাকল নাকি বর্ষার কারুকাজ- অরণ্য সে কথা একবারও ভাবলো না। বরং বর্ষা যখন জানালো- তার বাসা আজ খালি এবং সে চায় অরণ্য আজ রাত যেন তার কাছে থাকে; প্রস্তাবটা পাওয়ার সাথে সাথে অরণ্য হাওয়ায় ভাসা বেলুনের মতো বর্ষার আহবানে সাড়া দিল।

সমস্ত রাত দু’জন ডুবে থাকলো দু’জনের মাঝে। একটা আকাঙ্ক্ষা, একটা শিহরণ দু’জনকে ভুলিয়ে দিল পৃথিবীর সবকিছু, এমন কি নিজের অস্থিত্বও। তারপর রাতের আঁধারকে দূরে সরিয়ে যখন পূব আকাশে লাল সূর্য্য উঠল তখন এক বোঝা অপরাধবোধ নিয়ে অরণ্য সংসারে ফিরতে পা রাখলো পিচ ঢালা কালো রাস্তায়। আর বর্ষা সেই রাতের অসীম পাওয়াকে মনে ও শরীরে ধরে সুঁতা ছেড়া ঘুড়ির মতো উড়তে লাগলো অজানার পানে।

লতার অজান্তেই দু’জনের ফোনালাপ হলেও একসময় অজানা থাকলো না এসব। কিন্তু অরণ্য পরিস্কার অস্বীকার করলো। এমন সময় অরণ্যের কাছে খবর এলো এক সত্যের। বর্ষা জানালো- সে মা হতে চলছে। অরণ্য যেন দ্রুত ঢাকায় এসে তার সাথে দেখা করে।

আবার দেখা হলো দু’জনের। বাস্তবতা, কল্পনা, স্ত্রী, সন্তান, সমাজ, নিষ্ঠুরতা, ভাঙা, গড়া সব বিষয়ে আলোচনা হলো। বর্ষা বাস্তববাদী মেয়ে। তাই সে তার মতো করে সিদ্ধান্ত নিল। জানালো- তার ভুলে অন্য একজন মেয়েকে অন্য একটা সন্তানকে সে কষ্টে ডুবতে দেবে না। ভুল যা ছিল সব তার; এখন এর প্রতিদান তাকেই বহন করতে হবে। তাই সে খুন করে দেবে তার অনাগত সন্তানকে।

এ কথায় অরণ্যের পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে যায়। একদিকে সংসার অন্যদিকে বর্ষার সর্বনাশা প্রেম; অরণ্যকে দিশেহারা করে দেয়। অনাগত সন্তানের নিষ্পাপ মুখটা ভেসে উঠে মনের আয়নায়।

প্রচণ্ড কষ্ট হয় পৃথিবীর আলো দেখার আশায় জন্ম নেয়া অস্তিত্বটার জন্য। তাই অরণ্য সিদ্ধান্ত নেয়- সে বর্ষাকে, তার সন্তানকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু বর্ষা তার কথায় অবিচল। তবুও অরণ্য অনুরোধ করে আরও একটু চিন্তা ভাবনা করার জন্য। আশ্বাস দেয়- সে তো আছে বর্ষার জন্য এক পায়ে দাড়িয়ে।

দশদিন পর বর্ষা জানায় সে এখন ভারমুক্ত। অরণ্যকে অনুরোধ করে মরীচিকা এই সম্পর্ক সে যেন আর ধরে না রাখে।

সবকিছু ঠিক হলেও অরণ্য আর নিজেকে ঠিক করতে পারেনি। বর্ষার কাছে হেরে যাওয়া; বিশেষ করে বর্ষার সততা আর সুন্দর মন অরণ্যকে পাগল করে দেয়। বর্ষার কাছে আবার সে তার জোড় হাত নিয়ে দাঁড়ায়। বর্ষা অবশ্য তাকে ফিরে যেতে বলে।

কিন্তু ফেরা হয় না অরণ্যের। সর্বনাশা প্রেম আবার তাদের জড়িয়ে দেয় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতে। অরণ্য শত প্রতিবাদ উপেক্ষা করে বর্ষার ব্যাংক একাউন্টে প্রায় দুই লক্ষ টাকা জমা করে। কিন্তু বর্ষা এক পয়সাও ছুঁয়ে দেখেনি। যেমন ছিল তেমন করেই পড়ে থাকে ব্যাংকে।

তার প্রতি অরণ্যের ভালোবাসা আর অরণ্যের সংসার- পরস্পর মুখোমুখি হয়ে বর্ষাকে রাতের পর রাত ঘুমহীন করে তুলায় সে একসময় দেশান্তর হতে বাধ্য হয়। তবুও যোগাযোগ থাকে পরস্পরের। শত চেষ্টায়ও ভুলতে পারে একজন আরেকজনকে।

লতার হাতে প্রমাণসহ অরণ্য ধরা পড়ে। ভেঙে যায় লতার বিশ্বাসের পৃথিবী। কৈফিয়ত চায় অরণ্যের কাছে- কিসের অভাবে সে এমন করলো?

দাবানলে পুড়া অরণ্য ক্ষমা চায় লতার কাছে। বলে- মেয়েটা আমার প্রাণ, মান-সম্মান বাঁচিয়েছে। এরপর লতা বিস্তারিত জানতে চাইলে সে নিরোত্তর থাকে। শেষে বলে- আর কিছু জানতে চেও না। আমি বলতে পারব না। থাক না আমার একটা নষ্ট অধ্যায় তোমার কাছে গোপন।

লতা জানে তার ভালোবাসা, প্রেম, সংসার সবকিছুই আজ ছিন্নভিন্ন। তবুও সমাজের দিকে লক্ষ্য রেখে হেঁটে যায় স্বাভাবিক গতিতে। অন্তর যখন কেদে কেদে অস্থির তখন সামাজিকতা রক্ষার্থে স্বামীর হাত ধরে দাঁত বাহির করে হাসতে বাধ্য হয়।

বড় কষ্ট হয় জীবনের এই সময়টাকে ভাবলে- যখন অরণ্য তার ছাড়া আর কারও ছিল না। লতা মানতে পারে না শিক্ষিত, মর্যাদাসম্পন্ন, ভালো-মন্দ বুঝতে পারা এই স্বপ্নের নায়ক বিশ্বাস ভেঙে অভিসারে যাবে স্ত্রী ও মেয়ের কাছে নিষ্পাপ মানুষ সেজে।

লেখকঃ কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কেকে
আরও সংবাদ