ওয়েস্টার্ন গল্পঃ আগন্তুক

আগন্তুক কখন যে শহরে ঢুকেছে কেউ তা জানে না। কিন্তু সন্ধ্যায় যখন সে শহরের উত্তর প্রান্তে এক হোটেলে কাউন্টারের গায়ে অলস ভঙ্গিতে ঠেস দিয়ে দাড়ালো তখনই পাঁচ ছয় জোড়া চোখ তার দিকে দৃষ্টি দিল।

লোকটা একা। দেখে মনে হয় না কোন তাড়া আছে। আবার এও মনে হয় না খুব বেশি সময় হাতে নিয়ে ঘুরছে। গায়ের রং ধূলোয় ধূসর। কালো চোখ জোড়া যেন অন্যের মনের গভীরে শীতল শিহরণে ছুঁয়ে যায়। অলস ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকলেও স্পষ্ট বুঝা যায় লোকটা সদা সতর্ক। যদিও চেহারা নিস্পৃহ, তবুও একটু ভালো ভাবে তাকালেই বুঝা যায়- সে জীবনের বোঝা বহে বেড়াচ্ছে অনন্তকাল ধরে।

টেক্সাস সীমান্তের এক ট্রেইল টাউন এই জিপসী। আগন্তুকের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহর ঘিরে। তাই ভুল করে ফেলে যাওয়া হীরের খুঁজে আজ ছয় বছর পর আবার এখানে ফিরে আসতে বাধ্য হলো। কিন্তু এখানে পৌঁছানোর পর থেকেই মনটা কেমন যেন ছটফট করতে লাগল। নিজেই বুঝে উঠতে পারল না কেন এমন হচ্ছে। যার টানে শতশত মাইল ফাঁড়ি দিল- সে কি এখনও আগের মতো আছে। নাকি সেই চির বসন্ত- বর্ষায় রূপ নিয়ে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে।

পরিচিত কারো সাথে দেখা হলো না। এখানকার জীবনটাই এমন। দু’একজন ছাড়া এখানে কেউ স্থায়ী হতে আসে না। ঠাণ্ডা মনোভাব নিয়ে একটা চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিল দু’ঘন্টা। তারপর রাতের খাবারটা সেরে বেরিয়ে পড়লো। সে জানে কোথায় রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে। দৃঢ় পদক্ষেপে দু’শ গজ উত্তরে সরে এসে শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা আবাসিক হোটেলে ঢুকে পড়লো।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ফ্রেস করে নিল। উথাল-পাতাল ভাবনা মনে শুধু ঝড় তুলছে। আনমনেই জানালা দিয়ে তাকাল। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে রেড রিভার। নদী ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে বিস্তীর্ন এলাকায় চলে গেল তার দৃষ্টি।

ষোল বছর আগে আপনজন সব হারিয়ে সম্পূর্ন একা সে এসেছিল এই শহরে। অনাহারে আর অসুস্থতায় যখন প্রায় মারা যেতে বসেছিল ঠিক তখনই নায়েক পরিবারের কর্তা শওকত নায়েক তাকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের রেঞ্জে।

পশ্চিমের এই অবাঞ্চিত এলাকায় এই নায়েক পরিবার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার পেছনেও আরেক বিশাল কাহিনী জড়িয়ে আছে। যাক- ঐ পরিবারের একজন সদস্য হয়েই জীবনের স্পর্শকাতর একটা সময় পার করেছিল ওখানে। নায়েক পরিবারে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষার জন্য একমাত্র মেয়ে তানিয়া নায়েক ছাড়া আর কোন ছেলে সন্তান ছিল না। তাই ঐ পরিবার থেকে সে অসীম ভালোবাসা পেয়েছিল। আর সে যা পেয়েছিল, তার প্রতিদানে নিজের সম্পূর্ণ জীবন তাদের তরে বিলিয়ে দিলেও এর শোধ হবে না।

জীবনের সব শিক্ষা সে নায়েক পরিবারের কাছেই পেয়েছিল। পরিবেশের কারণেই শরীর, মন সব দিক থেকেই সে আলাদাভাবে গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে তানিয়ার সাথে তার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সবার অজান্তে। তানিয়া মেয়েটা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিল। মেধায়, কর্মে, ভাষায়, ভালোবাসায়, রূপে, গুণে ছিল অসাধারণ। তাই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভালোবাসায় গড়াতে বেশি সময় লাগেনি। সবার অগোচরে তানিয়াও তার ভালোবাসার সীমাহীনতা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিল বিভিন্ন আচার-আচরণে।

নায়েক পরিবার যদিও টেক্সাসের এই এলাকায় একমাত্র মুসলমান পরিবার ছিল; তবুও তারা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতো নিজেদের মতো করে। পরিবারের মধ্যেই এর সীমাবদ্ধতা থাকলেও আনন্দের কোন ঘাটতি ছিল না।

শুধু তার মনটা নিজ দেশের জন্য মাঝে মাঝে হাহাকার করে উঠতো। কিন্তু সেটা সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে বিস্তার করার আগেই তানিয়া তার ভালোবাসার দৃঢ়তা দিয়ে থামিয়ে দিত। আশাতীত ভালো সময় পার হতে লাগল ট্রেইল টাউন জিপসী আর নায়েক পরিবারের এই সবুজে ছাওয়া রেঞ্জে।

দিন যায় দিন আসে। মাস যায় মাস আসে। এভাবে পার হয় বছরের পর বছর। এমন করেই চলে গেল দশটা বছর। এলো এক কষ্টের দিন। ছোট্ট একটা ব্যাপার নিয়ে তানিয়ার সাথে কথা কাটাকাটি হলো। এক সময় তানিয়া তাকে পরিচয়হীন যাযাবর বলে আখ্যায়িত করলো।

যদিও সে বরাবর ধৈর্যশীল ছিল তবুও সেদিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। রাগে অন্ধ হয়ে কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে। নিজের রাগ যখন থামল, দেখল অনেক পথ পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে। আর ঠিক তখনই বুঝলো- তানিয়া তার হৃদয়ের কতখানি জুড়ে ছিল এবং আছে।

ফিরতে চাইল ফেলে আসা পথ ধরে। কিন্তু ভাগ্য তাকে থামিয়ে দিল। অনাকাঙ্ক্ষিত এক মারামারিতে জড়িয়ে গেল। ফল স্বরূপ ছয় বছর জেল।

মুক্ত হওয়ার পর সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে যতটা দ্রুত পারা যায়; ফেলে যাওয়া নায়েক পরিবারের দিকে ছুটলো পাগলের মতো।

পুরাতন স্মৃতি একটা দীর্ঘশ্বাস বের করে দিল আগন্তুকের হৃদয়ের গভীর থেকে। হোটেল থেকে বেরিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে ছোট্ট একটা ট্রেইল ধরে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হলো। ঘন্টাখানেক হাঁটার পরই সবুজের সমাহার ছুঁয়ে গেল তার মন প্রাণ। সামনে শুয়ে আছে চির চেনা বিশাল প্রেইরি। দেখে মনে হয় দিগন্তের সাথে মিশে গেছে ঘাসে মোড়া সবুজ জমি। ডান পাশে একসারিতে দাঁড়িয়ে আছে সিডার, পাইন আর ব্রাশে ছাওয়া উপত্যকা। ঘাসে মোড়া উপত্যকার বুক ছিড়ে ডান দিকে চলে গেছে আরেকটা ছোট্ট ট্রেইল। আগন্তুক সেই ট্রেইল ধরে পা বাড়াল। প্রায় দেড়ঘণ্টা হাঁটার পরই হঠাৎ করে তার দৃষ্টি সীমায় ধরা পড়লো পিক্যান ক্রীকের তীরে উঁচু ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা চির চেনা সেই রেঞ্জ হাউজটা।

রেঞ্জ হাউজের উঠানেই দেখা হলো শওকত নায়েকের সাথে। আগন্তুককে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে অভিমানে কেঁদে উঠলেন ভদ্রলোক। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললেন- কোথায় ছিলে এতদিন এই ছেলে কাঙ্গাল বাবাটাকে ফেলে!

এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই আগন্তুকের কাছে। তবুও কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বাহির করার আগেই একে একে পরিবারের সবাই বেরিয়ে এলো রেঞ্জ হাউজ থেকে। সবার চোখের অশ্রু আর মমতা জড়ানো স্পর্শই বুঝিয়ে দিল এ পরিবার তাকে কতটা ভালোবাসে।

সবার কৌতুহল যখন একটু শান্ত হলো ততক্ষণে দুপুর আর বিকেল একে অন্যকে ছুঁয়ে দিতে চাইছে। নিজেরও একমাত্র কৌতুহল এতক্ষণে নিবারণ হয়েছে। জানতে পেরেছে তানিয়ার অনুপস্থিতির কারণ।

আগন্তুকের চোখ এ পর্যন্ত ব্যাকুল হয়ে চারিদিকে খুঁজেই চলছে হৃদয় রাণীকে। অপেক্ষার প্রহর যেন আর কাটতেই চাচ্ছে না। নিজেই নিজেকে বারবার প্রশ্ন করছে- কখন ফিরবে তানিয়া জিপসী থেকে?
তানিয়া যখন ফিরল, তখন দুপুর বিকেলের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন করেছে।

তানিয়া একা আসেনি! সাথে এক অপরিচিত যুবক। বুলেট আকৃতির মাথা, ঈগলের ঠোঁটের মতো নাক। চাপা কাঁধ আর বুক অপেক্ষা মোটা কোমর। ফ্যাকাসে সাদা চেহারা। কাছাকাছি বসানো গাঢ় সবুজ চোখ দুটো- কেন যেন সাপের কথাই বার বার মনে করিয়ে দেয়। লোকটাকে দেখলেই বুঝা যায়- নিবুদ্ধিতা আর লোভের অদ্ভুত সংমিশ্রনে গড়া।

লোকটা নিজেই তানিয়ার স্বামী বলে পরিচিত হলো। তারপর তানিয়াকে রেখে রেঞ্জ হাউজে ঢুকে গেল। তানিয়া আগন্তুকের সামনে এসে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ভালোবাসার মানুষটির চোখের গভীরে। তার এই দৃষ্টির ভাষা আগন্তুক স্পষ্ট বুঝতে পারলো- বন্ধু, ফিরতে বড় বেশি দেরি করে ফেলেছ।

আগন্তুকের সব আশা, ভালোবাসা, নিরাশার প্লাবনে কোথা থেকে কোথায় যে হারিয়ে গেল সে নিজেও জানলো না। ফিরে এসে ভুল করেছে- এ রকম একটা অনুভূতি তার মাঝে কাজ করতে লাগলো। শুভ কামনা জানানোর জন্য মুখটা কেবল খুলেছে এমন সময় তানিয়া বলে উঠলো- কি লাভ হলো এই ফিরে আসায়। চলে যাও এখান থেকে। তুমি এখানে থাকলে আমি নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারব না।

উত্তরে কিছুই বলতে পারলো না আগন্তুক। শুধু তানিয়ার দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ তার শিরা-উপশিরায় রক্তের গতি বাড়িয়ে দিল। ব্যর্থতার কষ্ট তাকে সিদ্ধান্তে আসতে সফল করলো। আগন্তুক ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বললো- তুমি মুখে যাই বলো না কেন, মনে রেখ তোমার চেহারা দেখেই অন্তরের কথা আমি বুঝে গেছি।

আগন্তুকের জীবনের মতো- চারিদিক আঁধার করে লুকিয়ে পড়ার সব প্রস্তুতি শেষ করেছে লাল সূর্যটা। উল্টোদিকে কালো মেঘগুলো দিগ্বিদিকে ছুটছে ঝড়ো বাতাসে। দেখলে মনে হয় হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেওয়া যাবে। দূরে বিদ্যুতের উজ্জ্বল সাদা রেখা আকাশ থেকে নেমে মাটি স্পর্শ করতে শুরু করেছে।

আগন্তুক জিপসী থেকে আসছি বলে একটা ঘোড়ায় চড়ে ছুটলো শহর পানে। আর মিথ্যে অপেক্ষায় বসে রইলো ছেলে কাঙ্গাল এক বাবা এবং ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়ার জন্য ব্যাকুল একটা পরিবার।

শহরের কাছাকাছি এসে আগন্তুক ঘোড়াটা ছেড়ে দিল রেঞ্জের দিকে। জানে এ প্রাণীটা কোনদিন বেইমানি করবে না নায়েক পরিবারের সাথে।

আগন্তুক শহরের আলো ছেড়ে দক্ষিণে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। নায়েক পরিবারের অন্য সবার মতো তানিয়াও হয়তো আশায় থাকবে- আগন্তুক ফিরবে আবার। কিন্তু কেউ না জালনেও আমি তো জানি, আর কোনদিন আমার ফেরা হবে না ঐ সবুজে ছাওয়া রেঞ্জের দ্বার প্রান্তে, তানিয়ার মায়ার ছায়ায়, তার চোখের ভাষায় কাছে টানার আকুল আবেদনের খসড়া পড়ার জন্য- মুকুল ঝরা প্রহরের ব্যাকুল সন্ধ্যায়।

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ