গ্রীন বেল্ট
অপূর্ব এই জায়গাটা। ওয়াকলী গ্রিনবেল্ট । এই জায়গাটায় এত গিয়েছি গত পনের বছর, এখানটার প্রতিটা অলিগলি আমাদের চেনা। কিন্তু এবার মনে হল কিছুই চিনিনা,কিছুই দেখিনি চক্ষু মেলিয়া ।এত বছর ধরে আমরা কেবল এর হৃদকেন্দ্রটা দর্শন করেই চলে যেতাম।পাতা ঝরে যাবার পরে গাছবৃক্ষ,লতাপাতা নিঃস্ব হয়ে যাবার সময়টা অক্টোবর-নভেম্বরে আসিনি কখনও। এই বছরই এই সময়টাতে প্রথম আসা।প্যানডেমিক না হলে হয়তো এবারেও এখানে আসতামনা,চলে যেতাম এরই কাছাকাছি মেরব্লু বগে। তাহলে এই গ্রিনবেল্টের অঙ্গে যে এত রূপ এত বিশালতা তা বুঝতে পারতামনা কোনোদিনও । ওয়াকলী থেকে নাতিউচ্চ পাহাড় বেয়ে বেয়ে সুদূর এন্ডারসন রোড পর্যন্ত গিয়েছি কিন্তু কূলকিনারা পাইনি , চারদিকে ছড়ানো এই বেল্টের বিস্তার। এসব গ্রিনবেল্ট এই দেশের শহর পরিকল্পনারই অংশ। যেন নাগরিক যন্ত্রণার উপশমে মৃতসঞ্জীবনী এইসব গ্রিনবেল্টগুলো। নাগরিক যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে একটুখানি প্রকৃতির কাছে বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়া,ক্ষণিকের জন্য প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মত প্রাচীন পরিবেশটা চোখেমুখে মেখে নেওয়া,সারা অঙ্গে,সারা অস্তিত্বে মেখে নেওয়া।তারপর প্রফুল্ল চিত্তে ঘরে ফেরা।
সামারে এখানে হরেক রঙ্গের বনফুলের ছন্দেছন্দে আনন্দে দোল খাবার দৃশ্যটা মন কাড়ে যেকোনো বেরসিকেরও।আমার হাজবেন্ডের এই সবুজের রাজ্যে আসার আগ্রহ আমার বাচ্চাদের চেয়ে কম ছিলনা।এর একটা বিশেষ কারণ এইসব বুনোফুল।কোনো জংলি ফুলের ঝাড় দেখিয়ে বলতো,এই দেখো এস্টারের আদিমাতা এটি।আমাদের বাগানে ফল সিজনে যে হাইব্রিড এস্টারগুলো আছে কয়েক রংগের,এদের সকলেরই আদিমাতা এটি।আর ঐযে দেখা যাচ্ছে আরেকটা মনকাড়া রঙ্গের একই জাতের ফুলটি,এটা হলো বুনো এস্টারের প্রাকৃতিক হাইব্রিড।মানুষ করেনি এটা,প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে করেছে।পরে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে,তুমি কি বলতে পারবে এই নতুন রঙ্গের এস্টারটা কতদিন হবে দুনিয়াতে এসেছে ? আমি বেকুব বনে যাই এই প্রশ্নে,ধমকের সুরে বলি,আমি কেমনে বলবো ?
ধারণা করে বা বুদ্ধি খাটিয়ে বল,চেয়ে দেখ চারদিকে কেবল নীলের কাছাকাছি পারপুল রঙ্গের এস্টারে ছেয়ে আছে,কিন্তু এই একটামাত্র কিউট পিংকি এস্টার,এটা কেমনে এলো?
আমাদের বাগানেতো এই রঙ্গের কাছাকাছি একটা ঝোপা আছে ?
সে বলে,সেটা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা জিনবিজ্ঞানীদের হাইব্রিড।এজন্য অনেক কম্পেক্ট ও প্রায় একফিট উঁচু।আধুনিক কালের বাগানের জন্য ফুলের হাইব্রিড জাত সৃষ্টি করা হয় নানাদিক বিবেচনা করে।কিন্তু এটা দেখো,তিনফিট উঁচু আর অন্যান্য জংলি এস্টারের মতই ছড়ানোছিটানো ডালপালা।এর মানে এটার জন্ম প্রকৃতির খেয়ালে হয়েছে।প্রকৃতি আমরা মানুষের বাগানে চাষের কথা কেয়ার করেনা।ন্যাচারের অন্ধ প্রক্রিয়া বলতে পার।দ্বিজেনদা’র বইগুলো পড়ে দেখলে বুঝতে পারবে।ভাল কিছুইতো পড়তে চাওনা,কীকরে প্রকৃতি বুঝবে ?
আমি মুখ ঝামটা দেই,তোমার মত গাছপালার ছাওডিম আমার জানার দরকার নাই,যত্তসব !
সে বলে,না না,পড়তে হবেনা দ্বিজেন শর্মার বই।হুমায়ূন আহমেদ পড়। উতল হাওয়া পড়।পড়ে পড়ে বায়োবীয় হয়ে যাও।হাওয়ামে উড়তা যায়েংগে……
কিন্তু ঝগড়াটা বেশি জমাতে পারলামনা,এত বাউলা বাতাস বইছে আর ফেয়ার তাপমাত্রা শরীর-মনকে চনমনে করে রেখেছে।নাহলে দেখাতাম আমার প্রিয় লেখকের গিবত করে কার এমন বুকের পাটা !
বাচ্চারা যখন ছোট ছিল তখন প্রতি উইকেন্ডে যেতাম সেখানে। তখন দেখতাম , মাত্র একটা বা দুইটা গাড়ি পার্ক করা। কখনও গাড়ি মালিকের সঙ্গে দেখা হতনা । এত সবুজ গহীন জঙ্গল,পায়ে হাঁটার পথগুলো নানাদিকে চলে গেছে।সেইসব তেপান্তরের পথ ধরে গোটা কতেক পর্যটক কোথায় যে হারিরে গেছে তা ঠাহর করার উপায় নাই। শহরের পরিধিতে এত বড় গ্রিনবেল্ট কিন্তু বাহির থেকে বোঝা যায়না,আবার সবুজের ভেতরে ঢুকে গেলে ঠাহর করার উপায় নাই যে,একটা আলো-ঝলমল আধুনিক যান্ত্রিক শহরের শিরার ভেতর এক গা-ছমচম প্রাচীন নিরবতার বসবাস।সেটাতে ঢুকে গেলে শহরের সমস্ত ধাতব শব্দগুলো যেন কোথায় হারিয়ে যায়।নাগরিক কোলাহলের কোথাও কোনো অবশেষ নাই,কেবল প্রকৃতির নম্র ধ্বনি,পাখির কাকলি,কাঠবিড়ালীর দৌঁড়ঝাপ,কাছের ডোবায় বুলফ্রগের ঘ্যাঙরঘ্যাঙ ।মাঝারী সাইজের চিত্রা হরিণের দেখা মিলতো কচিত।একবার আমার মেয়ে একটা সদ্যজাত ফুরফুরে হরিণ শাবকের পেছনে দৌঁড়াতে গিয়ে প্রায় তিনফিট ঘাসের রাজ্যে হারিয়ে যায়।আমি চিৎকার দিয়ে উঠি।ওর বাবা গিয়ে ওরে ঘাসের আড়াল থেকে বের করে আনেন।এত নিশ্চিদ্র তৃণ,দেখতে ঠিক আমাদের আধপাকা ধানিজমির মত বাতাসের সাথে খেলছে।সিডহেডগুলো পাকাধানের ছড়ার মত।আমাদের দেশের অবারিত ধানের মাঠে বাতাস খেলার দৃশ্যটার মতই লাগে।
আমার বাচ্চাদের ছোটবেলা অনেক স্মৃতি এখানে। আমার অনেক ভয় হত ভেতরে যেতে,তাই বাচ্ছাদের নিয়ে আমরা বেল্টের কেন্দ্রের কিঞ্চিৎ উঁচু টিলাটার উপরে ও এটার চারপাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম।প্রায় তিন কিলোমিটার পথ কাটতে হত টিলাটাকে একপাক দিতে।অনেক চওড়া পথ,গ্রাবেল বিছানো।দুইপাশে বনফুলের মেলা।খরগোশগুলো রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আমরা আগন্তকদের দেখে,বিপদ ঠাওরালে পালিয়ে যায়।
বাচ্চারা অনেক ছোট ছিল তখন।ওরা উইকেন্ড এলেই বলতো,মা,পেইরি ল্যান্ডে যাব।আমি যেতে চাইতামনা,বলতাম,অন্য কোথাও যাই।কিন্তু বাচ্ছারা এখানেই যেতে চায়। ওদের বাবা বলতো, আরে আসোতো ,কেনেডার জঙ্গলে বিষধর সাপ নেই,মানুষখেকো বাঘও নেই। আমার ছেলেটা পোকা ধরবে বলে নেট নিয়ে দৌঁড়াচেছ ,সাথে টুনটুনিটাও। আহ! কী মায়াময় দৃশ্য ! এখনও এই ছবিটা ইমাজিনেশনে চলে আসে চোখের সামনে । মনে হয় বাচ্ছারা ছোট থাকলেই ভাল । মনটা থাকে আবুধি।সামান্য একটা ঘাসফরিং এদের অপার আনন্দ দিতে পারে। চোখের সামনে যেন সেই দৃশ্যটা দেখতে পাই ,ছেলের হাতে লম্বা লাঠির মাথায় নেট আর টুনটুনির হাতে ঘর থেকে লুকিয়ে আনা প্লাস্টিকের কন্টেইনার। কী আনন্দে , কী মহা উৎসাহে দুইজন এই গহীন জঙ্গলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিত পোকা পতঙ্গ দেখতে দেখতে । বাচ্ছাদের অল্পতে আনন্দ দেখলে মা-বাবার প্রাণ জুড়ায়।জাগতিক বাস্তবতার বাইরে বাচ্ছাদের এই আনন্দ অপার্থিব মনে হয়। কিন্তু ওরা বড় হয়ে গেলে এই ডিজিটাল যুগের বাচ্ছাদের কিসে যে আনন্দ হয় সেটা বুঝতে আমাদের ঘাম ঝরে।
এই জঙ্গলটার কেন্দ্র গোলাকার আর ধীর লয়ে উঁচু হতে হতে অনেক উপরে উঠে।
এই জঙ্গলটার কেন্দ্র গোলাকার আর ধীর লয়ে উঁচু হতে হতে অনেক উপরে উঠে গেছে।পুরো টিলাটাই নানা জাতের তৃণঘেরা।কোথাও সমান উচ্চতার ঘাসগুলো মাথায় সিডহেড নিয়ে কার্তিকের ধানিজমির মত বাতাসের সাথে দুলতে থাকে।আমরা অনেকবার টিলার উপরে চড়েছি এই দ্শ্য চোখ জুড়িয়ে দেখার জন্য।কোথাও আবার বুনোফুলের রাজ্য।প্রকৃতির নন্দন কানন।টিলাটাকে চক্কর দিয়ে হাঁটার জন্য মেঠোপথের আদলে গ্রাবেল বিছানো।পুরো টিলা একবার চক্কর দিয়ে আসতে তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়।কিন্তু ক্লান্তি আসেনা।বুকভরে নির্মল বাতাস নেয়া যায় বলেই মনে হয় ক্লান্তি ধরেনা।লেইট স্প্রিং থেকে আরলি ফল সিজনে টিলাটার বাইরের চারপাশ মনে হবে গভীর জঙ্গল।আমাদের প্রত্যেক সমারেই যাওয়া হয় এখানে কিন্তু ঐযে মেঠোপথ প্রায় তিন কিলোমিটারের মত করে রেখেছে এতটুকুন হেঁটেই চলে আসতাম।বাচ্ছারা বড় হওয়ার পরও গিয়েছি অনেক ভিন্ন ভিন্ন সিজনে। তেমন আগন্তকের ভিড় দেখিনি কোনোদিন।কিন্তু এইবার অটামে গিয়ে অবাক হলাম লোকসমাগম দেখে ! বেশ দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে গাড়ির পার্কিং লাইন দেখে। ছোট বাচ্চা, নিনি, দিদু কেউই বাকি ছিলনা। সব বয়সি লোকের সমাগম ছিল, কিন্তু জায়গায়টা অনেক বড়, তাই এত মানুষের সমাগম ভেতরে ঢুকে পড়লে বোঝা যায়নি। ঐ যে বললাম না,তিন কিলোমিটার মেঠোপথ হেঁটেই চলে আসতাম বরাবর।কিন্তু এইটার ভেতরে চারপাশে যে বনভূমিগুওলো যেন অনন্তের দিকে ছড়িয়ে গেছে উওরদক্ষিণ,পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই সেইসব এলাকাগুলো এতই নিশ্চিদ্র যে কোনোদিন ঢুকিনি অজানার পথে।যদিও পায়েহাঁটা সরু পথ চলে গেছে বনানীর অন্দরে কিন্তু আমার সাহস হয়নি যেতে। মাঝে মধ্যে দেখতাম সাইকেলিষ্টগুলো চড়ুইপাখির মত ফুড়ুৎ করে চোখের পলকে হারিয়ে যাচ্ছে সেইসব পথ ধরে।এবারে দেখলাম প্রকৃতির আরেক শিল্পকর্ম।চিরহরিৎ পাইনবৃক্ষ ছাড়া বৃক্ষশাখের সকল পত্র বৃন্তচ্যুত হয়ে সারা বনভূমি ছিন্নপত্রের গালিচা হয়ে গেছে।ঝরে গিয়েও পাতায় রঙের বাহার ফিকে হয়ে যায়নি।যেন নকশিকাঁথা বিছানো।আর পত্রহীন বৃক্ষগুলো যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা শূন্যতার শোকসভা।আমরা দুইজন প্রায় দশ কিলোমিটার হেঁটেছি পত্রশূণ্য বনভূমির নানাপথ ধরে।একটানা এত দীর্ঘপথ কোনোদিন হেঁটেছি মনে পড়েনা।শখের বশে এত পথ হাঁটতে গিয়ে একবার মনে হল আর পারিনা,পাগুলো যেন অচল হয়ে পড়ছে।মনে হল যেন পায়ের তলায় শিকর গজিয়ে মাটিতে চারিয়ে গেছে,টেনে তুলতে পারছিনা।ইচ্ছে হয়েছিল,আকাশের পানে দুইহাত তুলে আঙ্গুল্গুলো বৃক্ষশাখের মত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মানুষবৃক্ষ হয়ে।এর পরও গ্রিনবেল্টের সামান্যই দেখা হল।
এখন প্রকৃতিতে হেমন্তের শূন্যতা। আরলি ফলে যেতে পারিনি বলে খুব অফসোস হচ্ছে, কেন গেলাম না। ফল সিজনে পাতাদের বিয়ে হয় ।গাছেগাছে পাতাদের বিয়ের অপূর্ব সাজ দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম এই গ্রিনবেল্টটার। আবার এক বছর পর দেখা হবে যদি সময় পাই আর আসা হয় এখানে।অবশ্য এই সিজনে এদেশে যেদিকেই চোখ যায় কেবল রঙের মেলা আর আউলা বাতাসের মোহন বাঁশির সুর।আমাদের শহরের অনেকেই তখন গাতিনো পার্কে যায় ।চল্লিশ কিলোমিটার দৈর্ঘ গাতিনো পার্ক।জলাশয়গুলোর পাথরের চাঙ্গড়ের উপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে,সেলফি নিতে কারনা মন চায়। ।কানাডায় ম্যাপল পাতা বলুন,অক বা বার্চবৃক্ষ বলুন ফল বা অটাম সিজনে চোখ ধাঁধানো রঙ্গিন হয়ে যায়।একই গাছে কখনও দুই রঙের রঙ্গধনু দেখা যায়।দূরের পাহাড়ে তাকালে মনে হয় আগুনের হলকা।এক ভদ্রলোক কানাডার ফল সিজন নিয়ে একটা সত্যি গল্প বলে আমাদের হাসিয়েছিলেন খুব।চমৎকার গল্পবাজ তিনি।বহুবছর আগে কল্লাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে তিনি অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম কানাডায় আসেন। ল্যান্ড করার জন্য মন্ট্রিয়ল মহানগরীর উপর দিয়ে প্লেনটা যখন ক্রমাগত চক্কর খাচ্ছে তখন পড়তি বিকেলের সোনালি আভায় গাছগাছালি বনবনানীর এমন রঙ্গধনু দ্রশ্য দেখে তার নাকি হেলুসিনেশন হয়।তার কাছে মনে হয়,প্লেনটা ভুল করে বেহেশতের বাগানে ঢুকে পড়েছে ,এখন প্লেনটা ল্যান্ড করতে পারলেই তিনি সোজা জান্নাতুল ফেরদৌসে প্রবেশ করবেন।কাঁচের জানালা দিয়ে তিনি নাকি তালাশ করছিলেন সিদরাতুল মুনতাহা বৃক্ষটির যেটার ডালডালে ঝুলন্ত পরীরা রয়েছে পাতার মত।কয়েক মিনিটের জন্য তিনি নাকি ভুলে গিয়েছিলেন তার কল্লাকাটা অবৈধ পাসপোর্টের দুশ্চিন্তার কথা । অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের কথা।আগের দিনে ইন্টারনেট ছিলনা , ইউরোপ আমেরিকার প্রারম্ভ হেমন্তের বাহার খুব কম লোকই দেখেছে।অতএব রঙ্গিন মন থাকলে হঠাৎ চেনা প্রকৃতির বাইরে অন্য দেশের প্রকৃতিতে এই অপরূপ রূপ দেখে হেলুসিনেশন হতেই পারে।আমার হাজবেন্ডেরও নাকি হয়,মনের ভেতর স্বর্গীয় অনুভূতির হাওয়া খেলে,সারা ধমনীর রক্ত নাকি পু্লকে শিহরিত হয়।একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম,কওতো দেখি,পাতা কেন রঙ্গিন হয়,গাছের কেন এমন বিয়ের সাজ হয় ?বলতে নাপারলে সারা জীবিন ধরে তোমার এই প্রকৃতিপ্রেম আর বৃক্ষপ্রীতি ষোলআনাই বৃথা,বুঝলে ?
ভেবেছিলাম,এমন কঠিন প্রশ্নে ওকে জব্দ করে দিতে পারলাম।যেহেতু ওর সায়িন্স ব্যাকগ্রাউন্ড নয় তাই বলতে পারবেনা । দ্বিজেন শর্মা নাপড়ার খোটা এবার লেবু কচলে দেবার মত করে চিপে দেব।প্রশ্ন করে মৃদু হাসলাম।কিন্তু না।সে বলে,এটা ক্লোরোফিল,জ্যান্তফিল ও বিটা ক্যারোটিনের হেরফেরের জন্য হয়।পাতার জীবনচক্রে কাজ করে এক ধরনের জারক রস বলতে পার।আমাদের রক্তে যেমন হিমোগ্লোবিন,শ্বেতকণিকা,লোহিতকণিকা হেরফের হলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। রঙ বদলানোটা আসলে পাতার মৃত্যুঘন্টা।যখন স্পৃং সিজনে গাছে নতুন কুঁড়ি আসে তখন বাড়ন্ত সময়ে সবুজ ক্লোরোফিল পিগমেন্টের মাত্রা বেশি থাকার কারণে পাতার রঙের সবুজ সক্রিয় থাকে।পাতায় কিন্তু কমলা রঙের বিটা ক্যারোটিন ও হলুদ জ্যান্তফিলও থাকে অল্প।হেমন্তের আগমনে তাপমাত্রা যখন কমতে শুরু করে তখন পাতায় ক্লোরোফিলের মাত্রা কমে যায়।পাতাগুলোতে তখন জ্যান্তফিল ও বিটা ক্যারোটিন সক্রিয় হয়ে গেলে পাতার রঙ বদলে যায়।এজন্য পাতার রঙ হলুদ হয় ,কমলা হয় ,কোনোটা আবার কমলা ও হলুদের জারকে মিলেমিশে হয়ে যায় টুকটুকে লাল।যত নয়নকাড়া সুন্দরই দেখাক আদতে পাতার মৃত্যুঘন্টা এই বিদায়ের সাজ।দেখতে দেখতে দুই তিন সপ্তার মধ্যেই সব পাতা ঝরে যায়।একসময় তুষারঝড়ে তলিয়ে যায় বনানীতে পাতার নকসিকাথা।বৃক্ষশাখা মুড়িয়ে যায় স্ফটিকের মত স্বচ্ছ আইস কখনও। স্টিটলাইট বা নক্ষত্রের আলাে প্রতিফলিত হয়ে সেই স্ফটিকের গায় রাতকে করে রাখে অপার্থিব নান্দনিক জগতের মত।হিমের মাত্রা বেড়ে গেলে তুষারের কাফনে মােড়া পৃথিবীটা যেন পড়ে থাকে মহাশূন্যের চাদরের তলায়।আমরা দিন গুনতে থাকি কখােন আসবে বরফ গলার । দিন , বনানীতে নাচবে সবুজ পাতা , হরেক জাতের পাখি গাইবে নব – বসন্তের গান ।
লেখকঃ কানাডা থেকে
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/ফুয়াদ