হাদীসের আলোকে জিহাদ ও শাসক
স্থান, কাল ও পাত্র বেধে জিহাদ একটি ফরয ইবাদত। এটার অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণিত আছে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের মধ্যে। এবং এটার বিভিন্ন দিক রয়েছে। আমরা এখানে বিস্তারিত আলোকপাত না করে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মোবারক জবান দিয়ে আমাদের জন্য যে কথাগুলো বলে গিয়েছেন তা থেকে মাত্র কয়েকখানা হাদীস মোবারক উল্লেখ করব ইনশা আল্লাহ। সেগুলো হয়ত আমাদের জীবনের অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ ও অনুকরণ ছাড়া আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করা বা জান্নাতে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। সুতরাং আসুন আমরা যেনে নেই জিহাদের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ও একজন শাসক সম্পর্কে হাদীসের মধ্যে কি বলা হয়েছে?
জিহাদকারী উত্তম মানুষ।
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করার জন্য যারা নিজেদের জান-মাল দিয়ে জিহাদ করবেন তাদেরকে উত্তম মানুষ বলা হয়েছে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! মানুষের মধ্যে কে উত্তম? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সেই মুমিন যে নিজের জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে”।
জিহাদ সর্বোত্তম আমল।
মানুষের আমলের মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাকে সর্বোত্তম আমল বলা হয়েছ। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নিবেদন করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সর্বোত্তম আমল কি? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখা ও তাঁর রাস্তায় জিহাদ করা”।
জিহাদের জন্য ডাক এলেই বেরিয়ে পড়তে হবে।
যখন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার আহ্বান আসবে তখন দেরী না করে ময়দানে বেরিয়ে পড়তে হবে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মক্কা বিজয়ের পর আর হিজরত নেই। বরং রয়েছে কেবল জিহাদ ও নিয়ত। যখন তোমাদের জিহাদের ডাক দেয়া হয়, তখন বেরিয়ে পড়বে”।
হাশরের ময়দানে রক্ত ঝরবে।
আল্লাহর রাস্তায় যারা জিহাদ করবেন কাল হাশরের ময়দানে তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে কোন ক্ষত আল্লাহর রাস্তায় পৌঁছে, কিয়ামতের দিনে ক্ষতিগ্রস্ত মুজাহিদ এমন অবস্থায় আগমন করবে যে, তার ক্ষত হতে রক্ত ঝরবে। রক্তের রং তো (বাহ্যতঃ) রক্তের মত হবে, কিন্তু তার গন্ধ হবে কস্তুরীর মত”।
জিহাদকারীর জন্য একশত স্তর।
আল্লাহর দ্বীন কায়েম করার জন্য নিজের জীবনের সব কিছু দিয়ে যারা জিহাদ করবেন আল্লাহ হাশরের ময়দানে তাদের মান সম্মান অনেক বাড়িয়ে দিবেন। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- জান্নাতের মধ্যে একশটি স্তর আছে, যা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীদের জন্য মহান আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন। দুই স্তরের মাঝখানের ব্যবধান আসমান-যমীনের মধ্যবর্তীর দূরত্বসম”।
গাজওয়াতুল হিন্দ।
হক বাতিলের লড়াই ছিল, আছে ও থাকবে। কিন্ত হকের পক্ষে থাকাটা অনেক কঠিন কাজ। আর হকের পক্ষে যারাই থাকবেন তারাই দুনিয়া আখিরাতে সফল। সুনানে আন-নাসায়ী শরীফের হাদিসে এসেছে- “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোলাম হযরত ছাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমার উম্মতের দুটি দল, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দান করবেন। একদল যারা হিন্দুস্থানের জিহাদ করবে, আর একদল যারা ঈসা ইবনে মারিয়াম (আঃ) এর সঙ্গে থাকবে”।
অপর হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে হিন্দুস্থানের জিহাদের ওয়াদা দিয়েছিলেন। যদি আমি তা (ঐ যুদ্ধের সুযোগ) পাই, তা হলে আমি তাতে আমার জান-মাল ব্যয় করব। আর যদি আমি তাতে নিহত হই, তাহলে আমি শহীদের মধ্যে উত্তম সাব্যস্ত হব। আর যদি আমি ফিরে আসি, তা হলে আমি হবো আযাদ বা জাহান্নাম হতে মুক্ত আবূ হুরায়রা”।
নারী যখন শাসক।
সমস্ত সৃষ্টি জগতের একমাত্র শাসক হলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। কিন্ত দুনিয়ার জমিনে মানুষ পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে জীবন পরিচালনার জন্য সাময়িকভাবে কিছু মানুষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে দায়িত্ব যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিধান অনুযায়ী পালন করতে পারেন তাহলে দুনিয়া আখিরাতে অনেক কল্যাণ নিহিত আছে। নতুবা দুনিয়ার জমিনে লাঞ্ছনার জীবনের পাশাপাশি আখিরাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি কথা দিয়ে আল্লাহ জঙ্গে জামাল (উষ্ট্রের যুদ্ধ) এর সময় আমাকে বড়ই উপকৃত করেছেন। (তা হল) নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যখন এ খবর পৌছল যে, পারস্যের লোকেরা কিসরার মেয়েকে তাদের শাসক নিযুক্ত করেছে, তখন তিনি বললেন, সে জাতি কখনো সফলকাম হবে না, যারা তাদের শাসনভার কোন স্ত্রীলোকের হাতে অর্পণ করে”।
উত্তম শাসক ও নিকৃষ্ট শাসক।
প্রত্যেক ভালো কাজের জন্য যেমন মানুষের কাছে সুনাম আছে এবং আল্লাহর কাজে উত্তম প্রতিদান আছে ঠিক প্রত্যেক খারাপ কাজের জন্যও দুর্নাম ও লাঞ্ছনার আছে। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আওফ ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমাদের সর্বোত্তম নেতা হচ্ছে তারাই যাদেরকে তোমরা ভালবাস আর তারাও তোমাদের ভালবাসে। তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, তোমরাও তাদের জন্য দোয়া কর। পক্ষান্তরে তোমাদের সর্ব নিকৃষ্ট নেতা হচ্ছে তারাই যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর আর তারাও তোমাদের ঘৃণা করে। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও আর তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়। বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা কি তাদেরকে তরবারি দ্বারা প্রতিহত করব না? তখন তিনি বললেন, না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে সালাত কায়িম রাখবে”।
বিচারক তিন প্রকার।
মানুষের প্রতিটি ভালো কাজের জন্য আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদান রয়েছে। আবার খারাপ কাজের জন্য জাহান্নামের আগুন অপেক্ষমাণ আছে। সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত ইবনে বুরাইদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতী এবং অপর দুই প্রকার বিচারক জাহান্নামী। জান্নাতী বিচারক হলো, যে সত্যকে বুঝে তদনুযায়ী ফায়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয় বিচারে জুলুম করে সে জাহান্নামী এবং যে বিচারক অজ্ঞতা প্রসূত ফায়সালা দেয় সেও জাহান্নামী”।
পাপ কাজের আদেশ মানা যাবে না।
একজন শাসকের কথা বা নির্দেশ মানা যাবে যতক্ষণ সে কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে ইসলামী শরীয়াহ’র আলোকে কোন নির্দেশ প্রদান করবে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মুসলিমের জন্য (তার শাসকদের) কথা শোনা ও মানা ফরয, তাকে সে কথা পছন্দ লাগুক অথবা অপছন্দ লাগুক, যতক্ষণ না তাকে পাপকাজের নির্দেশ দেওয়া হয়। অতঃপর যখন তাকে পাপকাজের আদেশ দেওয়া হবে তখন তার কথা শোনাও মানাও ফরয নয়”।
নেতৃত্ব অনুতাপের কারণ হবে।
নেতৃত্ব কমবেশি সবাই চায়। কিন্ত এই নেতৃত্ব যদি সঠিকভাবে পালন না করেন তাহলে হাশরের ময়দানে এটা আপনার জন্য হবে অনুতাপের কারণ। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমরা অতি সত্বর নেতৃত্বের লোভ করবে। (কিন্তু স্মরণ রাখো) এটি কিয়ামতের দিন অনুতাপের কারণ হবে”।
মন্দ মন্ত্রী নিযুক্ত করা।
আপনার আশেপাশের মানুষগুলো যদি ভালো থাকে তাহলে আপনাকে ভালো পরামর্শ দিবে। আর যদি খারাপ হয় তাহলে শয়তানী কাজের পরামর্শ দিবে। তাই কাকে আপনার আশেপাশে রাখবেন এটার প্রতি খুব গুরুত্ব দিতে হবে। সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যখন আল্লাহ কোন শাসকের মঙ্গল চান, তখন তিনি তার জন্য সত্যনিষ্ঠ মন্ত্রী নিযুক্ত করে দেন। শাসক কোন কথা ভুলে গেলে সে তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং স্মরণ থাকলে তার সাহায্য করে। আর যখন আল্লাহ তার অন্য কিছু অমঙ্গল চান, তখন তার জন্য মন্দ মন্ত্রী নিযুক্ত করে দেন। শাসক বিস্মৃত হলে সে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় না এবং স্মরণ থাকলে তাকে সাহায্য করে না”।
সঙ্গী মন্দ কাজের প্রতি উৎসাহিত করে।
শয়তান মানুষের চিরশত্রু। সে মানুষের রূপ ধারণ করে আপনাকে সব সময় খারাপ কাজের প্রতি উৎসাহিত করবে। তাই যখন কোন সঙ্গী নির্বাচন করার সময় আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে কোন লোককেই খলীফা বানানো হয় তার জন্য দুজন পরামর্শদাতা থাকে। একজন তাকে সৎকর্মের পরামর্শ দেয় এবং এর প্রতি তাকে উৎসাহিত করে। অন্যজন তাকে মন্দ কাজের পরামর্শ দেয় এবং এর প্রতি তাকে উৎসাহিত করে। নিষ্পাপ হল সেই আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন”।
আমরা সবাই দোয়া করি- আল্লাহ আমাদের সঠিক জানার, বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহর রাস্তায় যেন জীবন উৎসর্গ করতে পারি। আমাদের যেন মজলুম না বানান, জালিম ও না বানান। (আমিন)
লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান