আমার ধর্ম আমার উৎসব (পর্ব এক)

বর্তমান শতাব্দী ইসলামের বিজয়ের শতাব্দী হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ইসলামের কঠিন সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, কিছু বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, “ধর্ম যার যার উৎসব সবার”। বাক্যটি যেহেতু ধর্মকেন্দ্রিক তাই এর বিচার-বিশ্লেষণও ধর্মীয় চিন্তার আলোকেই করতে হবে। একশ্রেণির মানুষ বিধর্মীদের নোংরা সাংস্কৃতিকে পূজি করে ইসলামের শান্তি ও সম্প্রীতিকে কলুষিত করতে সর্বদা তৎপর। এই তৎপরতার চালাচ্ছে এদেশীয় কিছু মুসলিম নামধারী মুশরিক ও মুনাফিক। এক্ষেত্রে তারা তাদের একটি কুফরি বক্তব্যকে বারবার সামনে নিয়ে আসে যখনই ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার বা দুর্গাপূজার মত কুরআন-সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসবের সময় আসে। কিন্তু ধর্ম যার যার উৎসব সবার এসর্ম্পকে মুসলিম মনীষীগণ সাম্প্রতিক সময়ে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরে যাচ্ছেন। এরি ধারাবাহিকতায় “আমার ধর্ম আমার উৎসব” প্রবন্ধটি উপস্থাপন করতে চাই।
প্রকৃত মুসলমান বিধর্মীদের উৎসব বা সাংস্কৃতি পালন করতে পারেনা। আমার বড় পরিচয় আমি মুসলিম। আমার ধর্মের নাম ইসলাম। সূরা আল-ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে ধর্ম হচ্ছে ইসলাম”।
আমার ধর্ম আল্লাহর কাছে মনোনীত ধর্ম তাই আমি মুসলিম হিসেবে আমার সব কাজ হবে ইসলামের হুকুম ভিত্তিক। সূরা বাকারার ২০৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামের মধ্যে পুরোপুরি প্রবেশ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”।
সুতরাং মুসলমানদের উৎসব হবে ঈদ-উল ফিতর ও ঈদু-উল আদ্বহাসহ ইসলামী শরীয়ত যেগুলোকে সমর্থন করে। তাই কোন মুসলিম অন্য কোন অমুসলিমের কোন ধরনের উৎসবে যেতে পারে না। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে কিছু নামধারী মুসলিম আছেন যারা কুরআনের সূরা কাফিরুনের একটি আয়াত দিয়ে বলতে চান “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” (নাউযুবিল্লাহ)। তাই আমরা মুল কথাগুলো উপস্থাপন করার পুর্বে সূরা কাফিরুন এর ফজিলত ও বাংলা অনুবাদ জেনে নিলে বিষয়টি বুঝতে অনেকটা বোধগোম্য হবে। (ইনশা আল্লাহ)
সূরা কাফিরুন এর ফজিলত
ইবনে মাজাহ হাদিসে এসেছে- “হযরত ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক মাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পর্যবেক্ষণ করলাম। তিনি ফজরের (ফরযের) পূর্বে দুই রাকাতে সূরা ক্বুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরূন’ ও ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ পাঠ করতেন”।
সুনানে আবু দাউদ, সুনানে দারেমী ও মুস্তাদরাকে এসেছে- “হযরত ফারওয়াহ ইবনু নাওফাল (রাঃ) হতে তার পিতার সূত্র থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাওফাল (রাঃ) কে বলেন, তুমি “ক্বুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূন” সূরাটি পড়ে ঘুমাবে। কেননা তা শিরক হতে মুক্তকারী”।
সুনানে নাসায়ীতে এসেছে- “হযরত জাবির ইব্ন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাকামে ইব্রাহিমে পৌঁছে তিলাওয়াত করলেন “ওয়াততাখিজু মিম মাক্বামী ইব্রাহিমা মুসাল্লা” তারপর দুরাকাত সালাত আদায় করেন। তিনি সূরা ফাতিহা সূরা কাফিরুন ও সূরা ইখলাস পাঠ করেন। পরে আবার হাজরে আসওয়াদের কাছে এসে তাঁকে চুম্বন করেন। তারপর সাফা পাহাড়ের দিকে যান”।
সূরা কাফিরুনের সরল অনুবাদ
“আপনি বলুন, হে কাফেরকূল, আমি এবাদত করিনা, তোমরা যার এবাদত করো। এবং তোমরাও এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি। এবং আমি এবাদতকারী নই, যার এবাদত তোমরা করো। এবং তোমরাও এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি। তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার জন্যে”।
উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন হাদীসে সূরা কাফিরুন এর ফজিলত সম্পর্কে আমরা জানলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি দিন যখন রাতের পর দিন শুরু করতেন তখন তিনি ফজরের ফরজ নামাজ আদায় করার পুর্বে দুই রাকাত সুন্নাত নামাজ পড়তেন এবং প্রথম রাকাতে সুরা কাফিরুন তেলাওয়াত করতেন। আবার যখন দিন শেষে রাতে ঘুমাতে যাবেন তখন এই সুরা কাফিরুন তেলাওয়াত করে পড়ার নির্দেশ দিলেন এবং বলে দিলেন এটা হলো শিরক হতে মুক্ত। যদি ঘুমানোর পুর্বে কোন ব্যক্তি এই সূরা তেলাওয়াত করে ঘুমায় আর ঘুমের মধ্যে তার মরন হয়ে যায় তাহলে সে ব্যক্তি শিরক থেকে মুক্ত হয়ে মারা গেল। আবার পবিত্র হজ্জ একটি ফরজ ইবাদত সেই ইবাদতের জন্য পবিত্র কাবা শারীফের তাওয়াফ করে দুই রাকাত ওয়াজীব নামাজ আদায় করার সময়ও প্রথম রাকাতে সূরা কাফিরুন তেলাওয়াত করতেন। দিনের শুরু, রাতে ঘুমানোর সময় ও হজ্জের তাওয়াফ করার পরের ওয়াজীব নামাজে এই সূরা তেলাওয়াত করার ধারা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, এই সূরা তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করি। এই কথাটার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আল্লাহ বার বার বলে দিয়েছেন, লক্ষ্য করলে দেখা যায় সূরা কাফিরুনে চার বার এ কথাটি বলা হয়েছে, “আমি এবাদত করিনা, তোমরা যার এবাদত করো। এবং তোমরাও এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি। এবং আমি এবাদতকারী নই, যার এবাদত তোমরা করো। তোমরা এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি”। এখানে আমরা যার ইবাদত করি যিনি একমাত্র ইবাদতের হকদার মহান আল্লাহ তায়ালা। এরপর কাফিরদের উদ্দেশ্যে করে বলা হয় “তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার জন্যে”। আর এই কথাটা পুঁজি করে একদল নামধারী মুসলমান স্লোগান দিচ্ছেন “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” তাই মুসলমান বিধর্মীদের যে কোন ধর্মীয় উৎসবে যেতে পারে। (নাউযুবিল্লাহ) “না”, মুসলমান নামধারী নাস্তিক মুরদাতদের কথাটা সঠিক না। এখানে- “তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার জন্যে”।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন, এ বাক্যটি তেমনি যেমন সূরা ইউনুস এর ৪১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আর তারা যদি আপনার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তবে আপনি বলবেন, আমার কাজের দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের কাজের দায়িত্ব তোমাদের”। এবং সূরা কাসাসের ৫৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “তারা যখন বাজে কথা শোনে তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে, আমাদের জন্য আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ। তোমাদেরকে সালাম। আমরা মূর্খদের (সঙ্গ) চাই না”।
আল্লামা ইবনে কাসীর (রহঃ) দ্বীন শব্দকে দ্বীনী ক্রিয়াকর্মের অর্থে নিয়েছেন। যার অর্থ, প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মের প্রতিদান ও শাস্তি ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ আমার দ্বীন আলাদা এবং তোমাদের দ্বীন আলাদা। আমি তোমাদের মাবুদদের পূজা-উপাসনা-বন্দেগী করি না এবং তোমরাও আমার মাবুদের পূজা-উপাসনা করো না। আমি তোমাদের মাবুদের বন্দেগী করতে পারি না এবং তোমরা আমার মাবুদের বন্দেগী করতে প্রস্তুত নও। তাই আমার ও তোমাদের পথ কখনো এক হতে পারে না।
কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে কিছু জ্ঞানপাপী মনে করে যে, এখানে কাফেরদেরকে তাদের দ্বীনের উপর থাকার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তারা এটাকে ইসলামের উদারনীতির প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন। নিঃসন্দেহে ইসলাম উদার। ইসলাম কাউকে অযথা হত্যা বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে অনুমতি দেয় না। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে কুফরী থেকে মুক্তি দিতে তাদের মধ্যে দাওয়াত ও দ্বীনের প্রচার-প্রসার ঘটানো থেকে বিরত থাকতে বলেনি। ইসলাম চায় প্রত্যেকটি কাফের ও মুশরিক ইসলামের ছায়াতলে এসে শান্তির বার্তা গ্রহণ করুক। আর এ জন্য ইসলাম প্রজ্ঞা, উত্তম উপদেশবাণী, উত্তম পদ্ধতিতে তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর পথে আহ্বান করাকে প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য করণীয় বিষয় হিসেবে ঘোষণা করেছে।
——-চলবে ইনশা আল্লাহ
লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কেকে
